আলীমুদ্দীন লাইব্রেরি নামে সেই প্রতিষ্ঠান সুদীর্ঘ ১১৪ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে পালন করে চলেছে গৌরবময় এবং ঐতিহাসিক ভূমিকা।
বাংলাদেশের অন্য দশটি এলাকার মতোই কিশোরগঞ্জ তখন এক অতি পশ্চাৎপদ বাজার মাত্র।
লাইব্রেরিই আমাদের পৈত্রিক ব্যবসা। পেশাগত দিক থেকেও আমরা পুস্তক সংশ্লিষ্ট বিষয়েই পারদর্শী। অন্য কোনো পেশাতেও আমাদের বংশের কেউ নিয়োজিত হননি। কিশোরগঞ্জ শহর ও আশেপাশে ৮-১০টি লাইব্রেরি পরিচালনা করেন আমাদের আত্মীয়-পরিজন, জানালেন মুহাম্মদ কামালউদ্দিন।
শতবর্ষী এই প্রতিষ্ঠানকে কেবল ব্যবসার কেন্দ্র বলে মনে করেন না শহরবাসী। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চেতনা বিকাশের ক্ষেত্র মনে করেন। আজও শহরের অধ্যাপক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, আইনজীবীদের মিলনকেন্দ্র এই লাইব্রেরি। এখানে অনির্ধারিত আড্ডা ও আলোচনায় প্রতিদিন জমায়েত হন স্থানীয় সুধী সমাজের প্রতিনিধিরা। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকেন স্কুল, কলেজের অনেক শিক্ষক।
সুস্থ আলাপ-আলোচনা ও শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কথা-বার্তা বলার আনন্দ পাওয়া যায় আলীমুদ্দীন লাইব্রেরিতে, বলেন কিশোরগঞ্জ সামাজিক আন্দোলনের নেতা অ্যাডভোকেট নাসিরউদ্দিন ফারুকী।
আলীমুদ্দীন লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা-ইতিহাস ও প্রেক্ষাপটটিও বেশ চমকপ্রদ। পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বর্তমান পরিচালক মুহাম্মদ কামালউদ্দিন বলেন, কৃষিভিত্তিক কিশোরগঞ্জের প্রাচীন ব্যবসা ছিলো গরুর গাড়ি নির্মাণ, চাকা তৈরি, ট্যাঙ্ক, স্টুকেসের ব্যবসা। আর ছিলো বিড়ির কিছু ছোট ছোট ফ্যাক্টরি। প্রচুর মাছ পাওয়া যাওয়ায় এখানে ছিলো শুঁটকি মাছের স্থানীয় ধরনের শিল্প। জেলায় রামানন্দ স্কুল, আজিমউদ্দিন স্কুল, মঙ্গলবাড়িয়া মাদ্রাসাসহ অনেকগুলো পাঠশালা ছিলো। তাদের শিক্ষা উপকরণ মেটানোর ব্যবস্থা ছিলো খুবই অপ্রতুল। আর মুসলমান সমাজের লোকজন সে আমলে ব্যবসা-বাণিজ্য বলতে গেলে কিছুই জানতেন না। এই অচলাবস্থা ভাঙতে এগিয়ে এসেছিলেন আমার পিতা হাজি আবদুর রশিদ।
তার কথা থেকে জানা যায়, হাজি আবদুর রশিদ উৎসাহ পেয়েছিলেন চাচার কাছ থেকে। চাচা ছিলেন অলিউল্লাহ মাস্টার নামে সে আমলে সর্বমহলে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। শহরের শিশু শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক চর্চায় তার সুনাম ছিলো। তিনি তার ভাতিজা আবদুর রশিদকে লাইব্রেরি করতে উদ্বুদ্ধ করলেন। তখন লাইব্রেরির ব্যবসা ছিলো খুবই নতুন। বাজার ছিলো সঙ্কুচিত। শিক্ষা বিস্তারের অভাবে বই, খাতা-পত্র সংগ্রহ করা এবং বাজারজাত করাও ছিলো কঠিন। তেমনই একটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় সাহসের সঙ্গে নিয়োজিত হয়ে সমগ্র জেলায় জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালালেন হাজি আবদুর রশিদ তার প্রতিষ্ঠিত আলীমুদ্দীন লাইব্রেরির মাধ্যমে। সেই আলোকশিখা শতবর্ষ পরে এখনও দ্বীপ্তিমান।
কিশোরগঞ্জের ইতিহাসচর্চাকারীদের কাছ থেকে জানা গেছে, সে আমলে বই-পত্র সংগ্রহ করতে হতো রাজধানী কলকাতা থেকে। তখনও ঢাকায় বইয়ের বাজার গড়ে ওঠেনি। বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ রদের আমলে (১৯০৫-১৯১১) ধীরে ধীরে ঢাকার বিকাশ ঘটতে থাকে। বেশ পরে ঢাকায় মাত্র কয়েকটি লাইব্রেরি গড়ে ওঠে। যেমন, চকবাজারের হামিদিয়া লাইব্রেরি, ইসলামপুরের ইসলামিয়া লাইব্রেরি, ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরি। বাংলাবাজারে তখনও বইয়ের মার্কেট গড়ে ওঠেনি।
শুরুর দিকের প্রথম ১৫-২০ বছর আলীমুদ্দীন লাইব্রেরি পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলো কলকাতার বই-বাজারের ওপর। তেমনই একটি সঙ্কুল পরিস্থিতি থেকে তিলে তিলে বই-পুস্তকের ব্যবসায় নেমে আলীমুদ্দীন লাইব্রেরিকে পাড়ি দিয়ে হয়েছে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি। পাঠ্যপুস্তক, সাহিত্য, ধর্ম গ্রস্থসহ সব ধরনের বইয়ের একটি আলোকিত জগত তৈরি করেছে লাইব্রেরিটি। কোনো বই না থাকলে অতি স্বল্প সময়ে বইটি সংগ্রহ করে পাঠকদের কাছে পৌঁছানোর সুনাম অদ্যাবধি তারা ধরে রেখেছেন। শুধু কেনা-বেচা নয়, বই পাঠ ও বই দেখার উদার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। কিশোরগঞ্জের শিক্ষিত সমাজ এবং বিদ্ব্যৎজনেরা আলীমুদ্দীন লাইব্রেরিকে মনে করেন নিজস্ব প্রতিষ্ঠান এবং ঐতিহ্যের ভাণ্ডার। ১১৪ বছর অতিক্রম করে প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় ইতিহাস ও সমাজ প্রগতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের বিদ্বৎ সমাজের অনেকেই বলেন, আমাদের শৈশব-কৈশোরে আলীমুদ্দীন লাইব্রেরি একটি উজ্জ্বল নাম। তখন শহরে এতো জনসংখ্যার চাপ ছিলো না এবং মুখ ও চেহারা দেখে সবাই সবাইকে চিনতেন; জানতেন কে কোন বাড়ির লোক। বই নিয়ে না কিনেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে পড়া যেতো তখন লাইব্রেরিতে। পাবলিক লাইব্রেরি ছাড়াও আলীমুদ্দীন লাইব্রেরিতে বসে অনেক বই পড়েছি।
আরও ছিলো সরকারি স্কুলের কামাল স্যারের পুস্তক বিতান, কিশোর লাইব্রেরি, তরুণ লাইব্রেরি, অনিমা লাইব্রেরি, ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরি। নতুন নতুন বই সেখানে বসে বসেই পড়ে ফেলার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা জীবনের বিরল প্রাপ্তি। তখন টেলিভিশন বা কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ছিলো না, এসব লাইব্রেরিই ছিলো জ্ঞানের বাহন। আর ছিলো নিউজ পেপার স্টল। গৌরাঙ্গ বাজারে ব্রজেশ ভট্টাচার্যের ‘পেপার হাউজ’ এবং রেল স্টেশনের বুকস্টল। ব্রজেশ বাবুর দোকানে পত্রিকা আসা মাত্রই সবগুলো কাগজ একের পর এক পড়ে ফেলার সেই যে অভ্যাস হয়েছে, এখনও তা অটুট অনেকেরই। যে কোনো শহর বা এলাকায় পাঠাগার, লাইব্রেরি নিঃসন্দেহে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা ও সংস্কৃতি বিকাশে অন্যতম প্রধান উৎস।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ লাইব্রেরি কলকাতার গর্ব এবং জ্ঞানচর্চার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। বাংলাদেশের সিলেটের মুসলিম সাহিত্য সমাজের লাইব্রেরিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ঢাকার কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি এবং এশিয়াটিক সোসাইটির লাইব্রেরিসহ বিভিন্ন পাঠাগার সমাজ, সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। কিশোরগঞ্জের আলীমুদ্দীন লাইব্রেরি জ্ঞান-চর্চায় তেমনি এক প্রোজ্জ্বল বাতিঘর।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৭
এসএনএস