মধ্যে বাঁকিপুর (বাঁকিপুর, মুরাদপুর, মিঠাপুর) বর্তমান শাসন কেন্দ্র। পশ্চিমে দানাপুর প্রধানত সেনানিবাস।
অনেকেরই জানা নেই যে, ভারতের বিহারের রাজধানী পাটনার বাঁকিপুরে উপমহাদেশের একটি অতুলনীয় গ্রন্থাগার আছে। এর নাম খোদাবক্স লাইব্রেরি। বইয়ে পাওয়া তথ্যের বাইরে এ গ্রন্থাগার সম্পর্কে সশরীরে পরিদর্শনের ভিত্তিতে আমাকে প্রথম সরাসরি তথ্য অবহিত করেন কিশোরগঞ্জের ইতিহাস-গবেষক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন শাহজাহান। পরে আরও অবহিত হই স্যার যদুনাথ সরকারের লেখা থেকে। পুরাতন ফারসি ও আরবি হস্তলিপি, ছবি, মুদ্রা, ঐতিহাসিক উপাদানসমূহের অপূর্ব-মূল্যবান সংগ্রহ এখানে আছে, যা ইউরোপের বিখ্যাত লাইব্রেরি ভিন্ন বিশ্বের কোথাও নেই। এমনকি, এ লাইব্রেরির বহু সংগ্রহ ইউরোপেও অপ্রাপ্য। ছবি, মুদ্রা, পুথি, পুস্তকের ঘরগুলো রাজবাড়ির ন্যায় সুসজ্জিত। সবগুলোর মূল্য শত কোটি টাকা। খাঁন বাহাদুর খোদাবক্স সিআইই সবকিছু সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য ওয়াকফ করে দিয়ে গেছেন। ইতিহাসের নমস্য পণ্ডিত স্যার যদুনাথ সরকার স্বীকার করেন যে, ‘জ্ঞানের এমন দাতা ভারতে আর হয় নাই। বডলী সাহেবের নাম অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জগদ্বিখ্যাত বডলিয়ান লাইব্রেরি চিরস্মরণীয় করিয়াছে। তেমনি খোদাবক্স ভারতীয় বডলী বলিয়া গণ্য হইবে। সার্থক তাহার নাম খোদাবক্স, অর্থাৎ ‘ঈশ্বরের (আল্লাহর) দান’ যেমন সংস্কৃত দেবদত্ত, কারণ এরূপ সাধারণের উপকারী লোক ক্ষণজন্মা, ঈশ্বরপ্রেরিত’। [পুরাতন বানান অপরিবর্তিত] যদুনাথ সরকার, ‘খোদাবক্সের কীর্ত্তি’ (প্রবাসী, ভাগ ১৬, খ- ২, সংখ্যা ৪, মাঘ, ১৩২৩) শীর্ষক প্রবন্ধে এসব কথা সবিস্তারে লিপিবদ্ধ করেছেন।
বিহারের ছাপরা জেলার একটি মুসলমান বংশে খোদাবক্স ০২ আগস্ট ১৮৪২ সালে জন্ম নেন। তার পূর্বপুরুষরা নির্ধন হলেও জ্ঞানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। পূর্বপুরুষদের একজন, কাজি হায়বতউল্লাহ, সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ও নির্দেশে অন্যান্য মুসলমান পণ্ডিতদের সঙ্গে ‘ফতওয়াহ-ই-আলমগিরি’ নামক সুবিখ্যাত ইসলামী আইন গ্রন্থ সঙ্কলনে সাহায্য করেন। খোদাবক্সের পিতা মুহাম্মদ বক্স পাটনায় ওকালতি করতেন। আরবি ও ফারসি হস্তলিপি সংগ্রহ তার জীবনের ব্রত ছিলো। আর্থিক অবস্থা ভালো না হলেও তিনি পৈত্রিক ৩০০টি হস্তলিপির সংগ্রহকে বাড়িয়ে ১৫০০টি করেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি খোদাবক্সকে আজ্ঞা করেন যে, প্রত্যেক বিষয়েই গ্রন্থসংগ্রহ সম্পূর্ণ করতে হবে এবং এগুলো সংরক্ষণ ও ব্যবহারের জন্য একটি দালান নির্মাণ করে জনসাধারণকে দান বা ওয়াকফ করতে হবে। খোদাবক্স অম্লান বদনে পিতৃ-আজ্ঞা গ্রহণ করেন। যদিও তাদের পরিবারে অর্থকষ্ট ছিলো ও পিতা একটি পয়সাও রেখে যাননি, তথাপি খোদাবক্স হতোদ্যম হননি। খোদাবক্স লাইব্রেরি পিতার আদেশ পালনের অমর দৃষ্টান্ত এবং এক কর্মবীর-মহাপুরুষের জ্ঞান বিষয়ক চিরস্মরণীয় কীর্তি।
আর্থিকভাবে বিপন্ন বালক খোদাবক্স কিছুদিন পাটনায় এবং তারপর কলকাতায় ইংরেজি পড়েন। কিন্তু ইতোমধ্যে পিতার পক্ষাঘাত রোগ হলে তাকে বাঁকিপুরে ফিরে আসতে হয়। সংসারের অবস্থা বড় খারাপ, এজন্য তিনি চাকরির খোঁজ করতে থাকেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এক মুন্সেফের কাছারিতে নায়েবগিরি প্রার্থনা করে তিনি বিফল হন, অথচ তিনিই পরে ভারতবর্ষের এক রাজধানীতে চিফ জাস্টিস হয়েছিলেন। কিছুদিন চেষ্টার পর তিনি যদিও বা জজের পেশকার হন, কিন্তু জজ মিস্টার লাটুরের সঙ্গে বনিবনা না-হওয়ায় বিরক্ত হয়ে পদত্যাগ করেন। তারপর তিনি ১৫ মাস ডেপুটি ইন্সপেক্টর অব স্কুল পদে চাকরি করেন। শেষে ওকালতি পরীক্ষা (তৎকালীন প্লিডারশিপ) পাশ করে ১৮৬৮ সালে বাঁকিপুরের কাছারিতে আইন ব্যবসা আরম্ভ করলেন। কথিত আছে যে, আদালতে যাওয়ার প্রথম দিনই তিনি ১০১টি মামলার ওকালতনামায় দস্তখত করেন। এমন সফলতার বিবরণ আর কোনো উকিলের বিষয়ে জানা যায়নি। ওকালতিতে তার যথেষ্ট আয়-রোজগার হতে থাকে এবং তিনি প্রথম শ্রেণীর উকিল হিসাবে গণ্য হয়ে অবশেষে সরকারি উকিল পদে নিযুক্তি লাভ করেন। খোদাবক্সের স্মরণশক্তি এমনই তীক্ষè ছিলো যে, যদিও প্রত্যহ অসংখ্য মোকদ্দমা করতে হতো অথচ শুধু একবার চোখ বুলিয়েই তিনি নথি অভ্যস্ত করে নিতেন, বাড়িতে খাটতে হতো না। একবার হাইকোর্টের এক সাহেব জজ (স্যার লুই জ্যাকসন) বাঁকিপুরে ভ্রমণে এসে আদালতে খোদাবক্সের বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হন এবং জানতে পারেন যে, খোদাবক্স বাঁকিপুরে সাহেবের জজিয়তিকালীন পরিচিত ও আদৃত উকিল মুহাম্মদ বক্সের পুত্র, তখন তিনি শয্যাগত মুহাম্মদ বক্সের বাড়ি গিয়ে দেখা করেন এবং খোদাবক্সকে একটি সাব-জজের চাকরি দিতে আগ্রহী হলেন, এমনকি, পরে ‘স্ট্যাটুটারি সিভিলিয়ান’ নামক উচ্চ পদে তদবির করারও আশা দিলেন। কিন্তু খোদাবক্সেও তখন খুবই পশার, তিনি স্বাধীন আইন ব্যবসা ছেড়ে সরকারি চাকরি নিতে আগ্রহী হলেন না।
জনকল্যাণে খোদাবক্স এমনভাবে লিপ্ত ছিলেন যে, সাধারণ হিতের জন্য বিনা পয়সায় খেটে মামলা করতে কখনও বিমুখ ছিলেন না। স্কুল কমিটির সদস্য হয়ে জ্ঞান বিস্তারে সাহায্য করায় ১৮৭৭ সালের দিল্লি দরবারে তাকে সম্মানের সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। পরে যখন লর্ড রিপনের আমলে সায়ত্ত্বশাসন প্রবর্তিত হয়, তখন খোদাবক্সই সবার সম্মতিতে পাটনা মিউনিসিপ্যালিটি ও ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি পুরাতন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ছিলেন। ভাগ্যের আহ্বানের সঙ্গে কর্মের সংযোগ স্থাপন করে তিনি ১৮৯৪ সালে নিজামের আগ্রহে হায়দারাবাদের উচ্চ বিচারালয়ের প্রধান বিচারপতি পদ নেন। ভারতের আইন পেশার ইতিহাসে এরূপ চরম উন্নতি ও কৃতিত্ব বিরল। ১৮৮৩ সালে খোদাবক্স ‘খাঁন বাহাদুর’ এবং ১৯০৩ সালে ‘সিআইই’ উপাধি লাভ করেন। মুসলমান লেখকদের জীবনী ও গ্রন্থ সম্পর্কে খোদাবক্সের অদ্বিতীয় অভিজ্ঞতা ছিলো। এ বিষয়ে তিনি বিলাতের ‘নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি’ কাগজে এক প্রবন্ধ লেখেন। এবং নিজের সংগৃহীত হস্তলিপির অনেকগুলোর বিস্তৃত বর্ণনাসহ একটি ক্যাটালগ ফারসিতে প্রকাশ করেন। যদুনাথ সরকার জানান, ‘একদিন আমার সম্মুখে তিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় হতে ৮০০ হিজরি পর্যন্ত যতো আরব জীবনচরিতকার ও সমালোচক ছিলেন, তাদের নাম ও গ্রন্থের ধারাবাহিক উল্লেখ করেন এবং প্রত্যেকের দোষ-গুণ ও গ্রন্থসীমা বর্ণনা করেন। এসবের অনেকগুলোই তিনি তার গ্রন্থাগারের জন্য যোগাড় করেছিলেন। কিন্তু ভারতের মুসলমানদের মধ্যেই বা আরবির গভীর চর্চা কয়জন করেন?’ ১৮৯৮ সালে হায়দারাবাদের চাকরিকাল শেষ করে খোদাবক্স বাঁকিপুরে ফিরে আসেন এবং পুনরায় ওকালতি পেশায় যোগ দেন। কিন্তু কঠোর পরিশ্রমে তার স্বাস্থ্য ভেঙে যায় এবং তার মতিভ্রম ঘটে। অসুস্থাবস্থাতেই তার মৃত্যু ঘটে।
পিতৃ আজ্ঞায় খোদাবক্স যে লাইব্রেরি বাড়ি তৈরি করেন, তা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। বাড়িটি দোতলা। চারিদিকে প্রশস্ত বারান্দা। পশ্চিম বারান্দা, দুই সিঁড়ি এবং নিচের মেঝেগুলো মার্বেল পাথরে মোড়ানো এবং নানা কারুকার্য খচিত। কোথাও বা দাবা খেলার ঘরের মতো চতুর্কোণ, কোথাও বা নানা রঙের পাথর বসিয়ে ছক কাটা। বারান্দা ও মেঝে রঙিন ইটে আবৃত। সন্দেহ নেই, এ গ্রন্থাগার খোদাবক্সের সমস্ত হৃদয়-মন জুড়ে উপস্থিত ছিলো। জাগরণে ও স্বপ্নে তিনি এ বিষয়েই ভাবতেন। নিজের ভাষাতেই তিনি সেসব কথা বিবৃত করেছেন: প্রথমে আমি বড়ই কম পুথি পাই। কিন্তু এক রাতে স্বপ্নে দেখি, কে যেন আমাকে বলছে, ‘যদি হস্তলিপি চাও তবে আমার সঙ্গে এসো। ’ আমি তার সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে লক্ষ্ণৌয়ের ইমামবাড়ার মতো একটি প্রকাণ্ড অট্টালিকার দ্বারে উপস্থিত হই। পথ প্রদর্শক একাকী ভেতরে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে বের হয়ে এলো এবং আমাকে সঙ্গে নিয়ে পুনরায় অট্টালিকার মধ্যে প্রবেশ করল। দেখি, ইমামবাড়ার প্রশস্ত হলের মধ্যে এক মহাপুরুষ বসে আছেন। তার মুখ আবৃত। চারপাশে তার সঙ্গীরা উপবিষ্ট। পথ প্রদর্শক আমাকে দেখিয়ে মহাপুরুষকে বিনয়ে সঙ্গে বললেন, ‘এই লোকটি হস্তলিপি চায়। ’ মহাপুরুষ উত্তর দিলেন, ‘তাকে দাও। ’ এরপর হতে আমার গ্রন্থাগারে নানাদিক হতে হস্তলিপি এসে জুটতে লাগল। বলা হয়, খোদাবক্সের স্বপ্নদৃষ্ট মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার চারপাশে তার সঙ্গীরা, আসহাব।
খোদাবক্স আরও জানান যে, একরাতে আমি স্বপ্নে দেখি গ্রন্থাগারের পাশের রাস্তা লোকে লোকারণ্য। কারণ জানার জন্য বাড়ি হতে বের হলে সবাই বলল, ‘ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ তোমার পুস্তকালয় দেখতে এসেছেন আর তুমি এতোক্ষণ অনুপস্থিত ছিলে?’ আমি তাড়াতাড়ি উপরে পুথির ঘরে গিয়ে দেখি যে তিনি চলে গেছেন। কিন্তু দু’টি হাদিসের হস্তলিপি টেবিলের উপর খোলা রয়েছে। লোকে বলল যে, প্রেরিত পুরুষ এ দু’টি পড়ছিলেন। এ দুই হাদিস গ্রন্থের উপর খোদাবক্স স্বহস্তে নির্দেশনামা লিখে রাখেন ‘এ গ্রন্থ কখনও পুস্তকালয় হতে বাইরে নিয়ে যেতে দেবে না। ’
আসলেই খোদাবক্সের সমস্ত হৃদয়, সমস্ত মন, এ গ্রন্থাগারে মগ্ন ছিলো। শেষ বয়সে মতিভ্রমের সময় তিনি প্রায়ই গ্রন্থাগার সম্পর্কে নানারূপ কাল্পনিক বিপদের কথা চিন্তা করে ব্যস্ত ও ব্যাকুল হতেন। প্রতিটি পুস্তককে তিনি চোখে চোখে রাখতেন। মৃত্যুর দু’দিন আগেও একখানা ‘মসনদ’ নামক গ্রন্থের আলমারি ও সেলফ ঠিক-ঠাক করছিলেন। শেষ বয়সে গ্রন্থাগারের বারান্দায় অথবা বাগানে খোদাবক্স প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যা কাটাতেন। সবাই তার ধবলকেশ ও শ্মশ্রুযুক্ত স্থির গম্ভীর অবয়ব দেখতে পেত। কখনও আগন্তুকের সঙ্গে কথা বলতেন; কখনও হস্তলিপির পাতা উল্টিয়ে গ্রন্থের খোঁজ-খবর নিতেন। গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার প্রেমিক খোদাবক্সের কবরও হয়েছে গ্রন্থাগারের আঙিনায়। গোরটি নিচু ও সাধারণ ধরনের, যিনি ভারতবর্ষের জন্য রাজা-রাজড়ার চেয়েও বেশি মূল্যবান জ্ঞান-ঐশ্বর্য দান করে গেছেন। প্রতি জেলাতেই খোদাবক্সের মতো একাধিক পেশাজীবী থাকেন। কিন্তু তার কীর্তি অদ্বিতীয়। ইতিহাস-পণ্ডিত স্যার যদুনাথ সরকার যথার্থই বলেছেন, ‘যতই আমাদের জ্ঞানের চর্চা বাড়িবে, ততই আমরা খোদাবক্স-গ্রন্থাগারের প্রকৃত মূল্য বুঝিতে পারিব। এখন আমাদের দেশের পুরাতত্ত্ববিদগণের সংখ্যা বড়ই কম; তাহাদের অধিকাংশই সংস্কৃত ও পালির চর্চা করেন; ফারসির দিকে দুই তিন জন মাত্র গিয়াছেন; আরবির দিকে কেহই না। ’ যদুনাথ সরকারের কথা খুবই সত্য। কারণ, গ্রন্থাগার পরিদর্শনকারী একজন বিলাতি পণ্ডিত খোদাবক্স গ্রন্থাগার পরিদর্শন করে বলেন, পুস্তকের জন্য কী সুন্দর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইউরোপে হলে এ লাইব্রেরিতে প্রত্যহ শত শত লেখক তত্ত্বান্বেষণ করত; কিন্তু এখানে একটিও পাঠক নেই!
প্রসঙ্গত বলা যায়, ইংরেজদের একটি মহা গুণ এই যে, তারা যেখানেই যান, হস্তলিপি, প্রাচীন কলাবস্তু, বৈজ্ঞানিক সামগ্রী প্রভৃতি সযতেœ সংগ্রহ করেন এবং সেগুলো নিজের দেশের মিউজিয়াম ও গ্রন্থাগারে দান করে স্বজাতির জ্ঞান বাড়াতে সাহায্য করেন। ভারত হতে তারা এতোই বিপুল জ্ঞান সম্পদ নিয়ে গেছেন যে, ইংল্যান্ডে একাধিক লাইব্রেরি ও মিউজিয়াম গড়ে উঠেছে। এখন ভারত বা বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করতে হলে ইংল্যান্ডের লাইব্রেরিসমূহে যেতে হয়। সেখানে এগুলো যতো সহজলভ্য ও প্রচুর, এদেশে তেমন নয়। প্রাচীন মিশর সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন গিয়ে যত তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে, নব্য-মিশরে তা সম্ভব নয়।
কিন্তু খোদাবক্স লাইব্রেরি বিরল ও ব্যতিক্রম। এখানে প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজ ও তথ্য-উপাত্তের এতোই বিপুল সমাবেশ ঘটেছে, যা অকল্পনীয়। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ভবিষ্যৎ গণনা করার জন্য এক কপি হাফিজের পদ্যাবলী হঠাৎ খুলে যে ছত্রে প্রথম দৃষ্টি পড়ত, তার অর্থ গ্রহণ করতেন। এবং কোনো ঘটনা সম্পর্কে কোনো তারিখে বইটি দেখেন ও ভবিষ্যৎ বাণীর কী ফল হলো, সেটি স্বহস্তে ছত্রটির পাশেই লিখে রাখতেন। যেমন মধ্যযুগে ইউরোপের লোক ভার্জিনের পদ্য দেখত। এজন্যই কবি হাফিজের আরেক নাম ‘লিসান-উল-গাইব’ বা ‘অদৃশ্য জিহ্বা’ বা ‘ভবিষ্যৎ কথা’। জাহাঙ্গীরের হস্তলিপিযুক্ত গ্রন্থটি খোদাবক্স লাইব্রেরিতে আছে। আওরঙ্গজেবের মুন্সি বা সেক্রেটারি এনায়েতউল্লাহ খাঁর ‘আহকাম-ই-আলমগীরী’ বইটি সম্পর্কে লোকে কেবল নামই জানত। ভারত বা ইউরোপের কোনো গ্রন্থাগারে বইটি ছিল না এবং কোনো ঐতিহাসিক সেটি পাঠও করেনি। সবাই বইটি সম্পর্কে আলোচনা ও সূত্ররূপে উল্লিখিত হতে জেনেছে এবং নাম শুনেছে। এ বইটিও একমাত্র খোদাবক্স লাইব্রেরিতেই আছে।
পুথি-পুস্তকের মতোই খোদাবক্স লাইব্রেরির প্রাচ্য চিত্রমালার সংগ্রহ দেখে খোদ ইংরেজ-গবেষকরাও মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন, যার মধ্যে মিস্টার হ্যাভেল অন্যতম। মুঘল সম্রাটদের অনেক ছবি, ছবির বই ও অ্যালবাম, মিনিয়েচার, সচিত্র ইতিহাস গ্রন্থের হস্তলিপি, শিখ নৃপতি রণজিৎ সিংহের অনেক হস্তলিখিত সচিত্র গ্রন্থ, দিল্লি ও লক্ষ্ণৌয়ের রাজকীয় অভিজাত সম্প্রদায়ের অ্যালবাম-সদৃশ্য ‘রয়েল মুরাক্কা’ খোদাবক্স লাইব্রেরিতে আছে। কিছু বই আছে ‘খাবালিগ’ নামের কাগজের, যা মুঘল বাদশাহগণ বুখারা, সমরকন্দ ও কাশ্মীরের শিল্পীদের দ্বারা প্রস্তুত করেছিলেন। বহু গ্রন্থ নিলামে কিনে এখানে চামড়ায় বাঁধিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
গ্রন্থ সংগ্রহ করাও খোদাবক্সের জন্য সহজ ছিলো না। সে আমলে ছাপার বইয়ের রমরমা যুগ শুরু হয়নি। প্রাচীন পুথি, হস্তলিখিত পুস্তক ইত্যাদি শৈল্পিক গ্রন্থই সংগ্রহের জন্য পাওয়া যেত, যেগুলোর মূল্য ছিলো আকাশচুম্বী। কারণ, মুঘল-মুসলিম আমলে বহু অর্থ ব্যয়ে, বহু যোগ্য শিল্পীর পরিশ্রমে ও দীর্ঘদিনের চেষ্টায় একেকটি গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হতো। এছাড়াও মুসলিম সম্রাটদের অনুগ্রহ লাভের আশায় শ্রেষ্ঠ হস্তলিপি পুস্তক দিল্লির বাদশাহের দরবারে এসে জুটত। সেগুলো উপযুক্ত হলে শত শত, এমনকি, সহস্র মোহর দিয়ে কেনা হতো। অনেক পুস্তক বাদশাহের বেতনভোগী লেখক ও চিত্রকরদের দ্বারাও রচিত হতো। আবার অনেক পুস্তক যুদ্ধের সময় বিজিত দেশ হতেও সংগৃহীত হয়। কখনও কখনও আমির-ওমরাহদের মৃত্যুর পর তাদের সম্পত্তির মধ্যে পুস্তক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য-সামগ্রী বাদশাহি খাজাঞ্চিতে দাখিল হতো। সম্রাট আকবরের সভাকবি ফৈজির মৃত্যুর পর তার চার হাজার ৩শ হস্তলিপি বাদশাহি লাইব্রেরিতে জমা হয়। এভাবে ষোড়শ ও সতের শতকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও মূল্যবান গ্রন্থাগার দিল্লির মুঘলদের অধীনে ছিলো। মুঘল শক্তির অবক্ষয়কালে আঠারো শতকে এসবের কিছু অংশ লক্ষ্ণৌয়ের নবাবদের হস্তগত হয়। অবশেষে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে মুসলিম শক্তিকে পরাজিত হলে দিল্লি ও লক্ষ্ণৌয়ের রাজবাড়ি, দরবার, প্রাসাদ, পাঠাগার তথা সব কিছু লুটতরাজ করা হয়। লুটের মালের সঙ্গে পুরাতন পুথি-পুস্তক-হস্তলিপি চারদিকে ছড়িয়ে গেলো। কলকাতা, পাটনা ইত্যাদি কোনো কোনো শহরে সেগুলো ওজন-দরেও বিক্রি করে ইংরেজ সিপাহী ও অন্যান্য লুটেরারা। সেসময় রোহিলখন্দের নবাব ইংরেজের পক্ষে ছিলেন। দিল্লি জয়ের পর তিনি ঘোষণা করেন, প্রতি পুথি এক টাকা দরে কিনবেন। এভাবে তিনি সিপাহীদের কাছ থেকে বহু মূল্যবান পুথি কিনে নেন।
সে পরিস্থিতির সময়কালের কিছু বৎসর পরে খোদাবক্স লাইব্রেরি গঠন ও পুথি-পুস্তক সংগ্রহে মন দেন। তখনও তিনি দেখতে পান যে, পবিত্র কোরআন-হাদিস গ্রন্থসহ ইসলাম ধর্মের মর্যাদাসম্পন্ন বহু বই-পুস্তক বাজারে বাজারে অপমানিত হচ্ছে এবং আজেবাজে মালামালের সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে রয়েছে। খোদাবক্স স্বপ্নাদিষ্ট বা হৃদয়ের টানে পুথি-পুস্তক রক্ষায় নিয়োজিত হন। তিনি কেবল একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারই প্রতিষ্ঠা করেননি; ভারতবর্ষের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় সম্পদও রক্ষা করেছেন। খোদাবক্স পুথি ক্রয় ও সংগ্রহের জন্য অভিজ্ঞ লোক নিয়োগ করেন। যারা আরব, মিশর, পারস্য, সিরিয়ার আসল পুথি-পুস্তক ভারতের আনাচে-কানাচে ঘুরে সংগ্রহ করে দিত। তিনি মুহাম্মদ মক্কী নামক একজনকে তৎকালে ৫০ টাকা বেতনে ২০ বৎসর পুথি-পুস্তক সংগ্রহের জন্য চাকরিতে নিযুক্ত করেন। এ লোকটি বহু মূল্যবান ও দু®প্রাপ্য পুথি-পুস্তক সংগ্রহ করে দেন। পুথি-পুস্তকের প্রতি খোদাবক্সের দরদ ও ত্যাগের নানা উদাহরণ আছে। তিনি নিয়ম করেন, যেকোনো হস্তলিপি-পুস্তক বিক্রেতা বাঁকিপুরে এলে তিনি বই কেনেন বা না-কেনেন, লোকটির আসা-যাওয়ার রেলভাড়া ও রাহা খরচ দিতেন। এভাবে ভারতময় তিনি বিখ্যাত হন এবং তার নাম দেশব্যাপী ছড়িয়ে যায়। ফলে পুথি-পুস্তকের বিক্রেতারা প্রথমেই তার কাছে এসে হাজির হতো। একবার খোদাবক্স লাইব্রেরির একজন পূর্বতন দপ্তরী রাতে গ্রন্থাগারে গিয়ে ২০টি মহামূল্যবান হস্তলিপি চুরি করে লাহোরের একজন দালালের কাছে বেচতে পাঠায়। দালাল সর্বপ্রথম খোদাবক্সকে এ তথ্য দিয়ে জানতে চান, তিনি বইগুলো কিনবেন কিনা? বই দেখতে গিয়ে চোর ধরা পড়ে। খোদাবক্স লাইব্রেরির পক্ষে ধর্মের কল বার বার বাতাসে নেড়েছে। মিস্টার জে.বি. এলিয়ট নামে পাটনার একজন প্রাদেশিক জজ খোদাবক্স লাইব্রেরি হতে কামালউদ্দিন ইসমাইল ইস্পাহানির দুর্লভ পদ্যাবলী ধার নিয়ে পরে ফেরত দিতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, যত দাম চাও, দেবো, কিন্তু বই আমার কাছেই থাকবে। বই পাওয়া গেলো না; পয়সা নেওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। পরে যখন মিস্টার এলিয়ট পেনসন নিয়ে ইংল্যান্ডে যান, তখন তার সব ভালো পুথিগুলো কয়েকটি বাক্সে প্যাক করে জাহাজে পাঠান। অকেজো কাগজ-পত্র ও সামগ্রী নিলামে বিক্রির জন্য আরেকটি বাক্সে বন্ধ করে পাটনাতেই রেখে গেলেন। ধর্মের বিচার এমনই যে, খোদাবক্স লাইব্রেরি থেকে কেড়ে নেওয়া হস্তলিপি এবং আরও ৪/৫টি অমূল্য পুথি-পুস্তক, যার একটিকে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের সই ছিল, ভ্রমক্রমে পাটনার বাক্সেই রাখা হয়। খোদাবক্স লাইব্রেরি নিলামে এগুলো কিনে পুনরায় গ্রন্থসমূহের অধিকারী হয়। সাহেব বিলাতে বাজে কাগজের প্যাকেটটি পেয়েছিলেন। কিন্তু তখন তার আর কিছুই করার ছিলো না।
পুস্তক সংগ্রহের নেশার সঙ্গে ভাগ্য এসেও খোদাবক্সকে অকৃপণভাবে সাহায্য করেছে। খোদাবক্স একবার জানতে পারেন যে, পাটনার একজন প্রাচীন বংশের মুসলমানের কাছে একটি দুর্লভ হস্তলিপি আছে। যদিও লোকটি বইয়ের একটি অক্ষরও পড়তে পারেন না, তথাপি তিনি সেটা বিক্রি করতে রাজি ছিলেন না। অবশেষে খোদাবক্স পুথিটি তিন দিনের জন্য ধার নিলেন। এবং মলাট কেটে বইটি বের করে সে মলাটের মধ্যে একটি অসার হস্তলিপি সেলাই দিয়ে ফেরত পাঠালেন। মালিক অক্ষরজ্ঞানের অভাব হেতু কিছুই টের পেলেন না। বরং বই ফেরত পেয়ে খুশি হলেন। ইতিহাসবিদ ব্লকম্যানের মৃত্যুর পর কলকাতায় তার হস্তলিপিসমূহ নিলামের সময় খোদাবক্স সেখানে গিয়ে বিশিষ্ট লেখক ও পণ্ডিত, জজ সৈয়দ আমির আলীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাম হাঁকতে হাঁকতে বললেন, ‘আজ দেখব জজ না উকিল জয়ী হয়?’ খোদাবক্সের আগ্রহ ও তৎপরতা দেখে জজ পিছিয়ে গেলেন। একবার হায়দারাবাদ থেকে ফেরার পথে খোদাবক্স তীক্ষè চোখে দেখতে পেলেন যে, এক মুদির অন্ধকার দোকানের মধ্যে ময়দার বস্তার উপর কয়েকটি পুথি অবহেলায় রাখা আছে। সম্ভবত এগুলো দিয়ে ময়দার প্যাকেট বানানো হবে। খোদাবক্স সহ্য করতে পারলেন না। তৎক্ষণাত গাড়ি থামিয়ে সেগুলোর পাতা উল্টিয়ে দেখতে দেখতে দাম জিজ্ঞাসা করলেন। মুদি বলল, ‘এসব পুরাতন কাগজ অন্য কারও কাছে বেচলে ১/২ টাকায় দিয়ে দিতাম। কিন্তু হুজুর যখন নিতে চাচ্ছেন, তখন এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও দামী বিষয় আছে। আপনার কাছে আমি ২০ টাকা চাই। ’ খোদাবক্স কাল-বিলম্ব না করেই ২০ টাকায় পুথিগুলো কিনে নেন। এগুলোর মধ্যে একটি আরবি জীবনচরিত ছিল, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। পরে স্বয়ং নিজাম পুস্তকটি দেখে ৪০০ টাকায় কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খোদাবক্স বইটি হাত-ছাড়া করলেন না।
খোদাবক্স লাইব্রেরি কেবল পুথি-পুস্তক সংগ্রহ সংখ্যার দিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ নয়, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব আর উৎকর্ষের দিক থেকেও অতুলনীয়। এতে এমন কিছু অতি দুর্লভ বই-পুস্তক রয়েছে, যা পৃথিবীতে অন্য কোথাও নেই। সম্রাট জাহাঙ্গীর-কর্তৃক ভাগ্য-গণনায় ব্যবহৃত হাফিজের গ্রন্থ এ রকমই একটি বই। বিশ্বে যার দ্বিতীয় কপি নেই। এটি শুধু গ্রন্থই নয়, জাদুঘরের সংগ্রহে রাখার মতো ঐতিহাসিক বস্তুও বটে। তুর্কি ওসমানিয়া সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের কনস্টান্টিনোপল ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ জয়ের বিবরণ এক মহাকাব্য আকারে রচনা করে সেটি সচিত্র পুস্তক রূপে গ্রন্থকার ১৫৯৩ সালে তুর্কি সুলতান তৃতীয় মুহাম্মদকে উপহার দেন। তুর্কি রাজপ্রাসাদ হতে হাত ঘুরে ঘুরে বইটি সম্রাট শাহজাহানের আমলে ভারতে আসে। এ বইটি খোদাবক্স লাইব্রেরিতে আছে। পৃথিবীতে বইটির দ্বিতীয় কোনো কপি নেই। ফারসি লেখায় নূর আলী ভারতবর্ষে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন। তার কারুকার্যময় হস্তলিখিত কবি জামি রচিত ‘ইউসুফ ও জুলেখা’ কাব্য বাদশাহ জাহাঙ্গীর সে আমলেই হাজার মোহর দিয়ে কেনেন। এটি এখন খোদাবক্স লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছে। সম্রাট শাহজাহানের স্বাক্ষর করা দু’টি বই আছে। একটি বই ১৪ বছর বয়সে তিনি সই করেন। শাহজাদা দারাশিকোহ-এর স্বহস্তে লিখিত ‘সফিনাত-উল-আওলিয়া’ (আওলিয়াচরিত), গোলকুণ্ডার সুলতানের নিজস্ব ব্যবহারের ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ’-এর কপি, আমির খসরুর ‘মসনবি’, যা বুখারার সুলতান হস্তলিপিবিদ মীর আলীকে তিন বছর জেলে বন্দি রেখে রচনা করিয়েছিলেন, ফারসি ও গুরুমুখী অক্ষরে রচিত শিখযোদ্ধা রণজিৎ সিংহের সামরিক পরিকল্পনা গ্রন্থ, আলী মর্দান খাঁন সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় যে সচিত্র ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ উপহার দেন, আমির খসরুর গ্রন্থাবলী, সম্রাট আকবরের মাতা হামিদা বানুর মোহরযুক্ত হাতিফির কাব্য ‘শিরীন ও খসরু’, অতি সূক্ষè অক্ষরে লিখিত সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী, যা গোলকুণ্ডার রাজাকে উপহার দেওয়া হয় এবং পরে আওরঙ্গজেব গোলকুণ্ডা জয়ের সময় অধিকার করেন, সচিত্র তৈমুর বংশের ইতিহাস, সচিত্র শাহজাহানের ইতিহাস, মুঘল মিনিয়েচার ছবির অ্যালবাম, প্রাচীন কাব্য-মহাকাব্য, পুথি-পুস্তক খোদাবক্স লাইব্রেরির শোভা, সমৃদ্ধি ও ঐতিহ্য বৃদ্ধি করেছে।
খোদাবক্স লাইব্রেরিতে গ্রন্থপঞ্জি সুগ্রন্থিত। বহু বিভাগের পুথি-পুস্তক আলাদা-আলাদাভাবে সজ্জিত হয়েছে। কেবল মাত্র প্রাচীন, দুর্লভ ও দু®প্রাপ্য বই-পত্রের জন্যই লাইব্রেরিটি পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠকেন্দ্ররূপে বিবেচনার যোগ্য। আরবি বিভাগে ‘তাফসির-ই-কবির’ নামে পবিত্র কোরআনের তিন খণ্ডের প্রকাণ্ড টীকা-ভাষ্য গ্রন্থ আছে, যা অতি ক্ষুদ্র অথচ পরিষ্কার ও আগাগোড়া একই রকমের অক্ষরে লিখিত। কী পরিশ্রমে তা লেখা হয়েছে, ভাবলে অবাক হতে হয়। ইউরোপ যখন অন্ধকারে তখন দক্ষিণ স্পেনের আন্দালুসিয়ায় মুসলমানরা জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়েছিল। সে আমলের বহু গ্রন্থও এখানে আছে। আরব বৈজ্ঞানিক জোহরাবি-এর অস্ত্রচিকিৎসার একটি প্রাচীন পুথি আছে, যাতে বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রী ও যন্ত্রের নিখুঁত ছবি দেওয়া আছে। আছে গ্রিক উদ্ভিদবিদ্যার আরবি অনুবাদ গ্রন্থ ‘কিতাব-উল-হাশায়েশ’। বইটি অতি পুরাতন এবং এতে বিভিন্ন উদ্ভিদের রঙিন ছবি শাখা-কাণ্ড-মূল-শিকড়সহ স্পষ্টভাবে অঙ্কিত রয়েছে। একখণ্ড ভেড়ার চামড়ায় তৈরি কাগজে (পার্চমেন্ট) কতগুলো কুফিক অক্ষরে আরবি লেখা আছে, যেগুলো হয়রত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর বলে কথিত। সেসময় আরবিতে জের-যবর-পেশ ইত্যাদি ব্যবহার শুরু হয়নি। সম্রাট আকবরের জন্য আরবিতে প্রণীত দোয়ার বই এবং তারই জন্য ফারসিতে লিখিত ঈসা নবী (আ.)-এর জীবনী ‘দাস্তান-ই-মাসিহ’ নামক পুস্তকও এখানে আছে, যা আকবরের মৃত্যুর পূর্বে পাদ্রি জেরো এবং হমনু প্রণয়ন করে দিয়েছিলেন।
লর্ড কার্জন, যিনি ইতিহাস-ঐতিহ্য-স্থাপনা-বই-পুস্তক রক্ষার জন্য আইন করে বিখ্যাত হয়েছিলেন এবং মুঘল-মুসলিম ঐতিহ্যকে অধিগ্রহণ করে লুটপাট ও ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করে স্মরণীয় হয়ে আছেন, তিনি খোদাবক্স লাইব্রেরি পরিদর্শনকালে বিমোহিত চিত্তে দিল্লির ‘দেওয়ান-ই-খাস’-এর তোরণে সোনার হরফে লিখিত ফারসি পদ্যটি স্বকণ্ঠে আবৃতি করতে করতে এ লাইব্রেরির মাহাত্ম্য প্রকাশ করেন:
আগর ফির্দ্দৌস বররু-এ-জমিনস্ত
হমিনস্ত ও হমিনস্ত ও হমিনস্ত ॥
অর্থাৎ, ধরাতলে যদি কোথা স্বর্গলোক-বেহেশত থাকে/এই তা, এই তা, এই তা বটে।
খোদাবক্স লাইব্রেরির সবচেয়ে সঠিক মূল্যায়ন ঐতিহাসিক এ কথার অধিক আর কিছুই হতে পারে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৭
এসএনএস