ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

হাজার দুয়ারি প্রাসাদে শেকলবন্দি নবাব

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩০ ঘণ্টা, মে ৫, ২০১৭
হাজার দুয়ারি প্রাসাদে শেকলবন্দি নবাব মুর্শিদাবাদের পথে পথে

মুর্শিদাবাদ ঘুরে: এই প্রাসাদ ভারতবর্ষে ইউরোপীয় স্থাপত্যকলার এক জীবন্ত নিদর্শন। বলা যায়, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আধিপত্য কায়েমের এক উল্লেখযোগ্য নজির এই হাজার দুয়ারি প্রাসাদ।

প্রাসাদের নামকরণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না, তবে সাধারণভাবে প্রচলিত যে, এই প্রাসাদে এক হাজার দরজা রয়েছে। প্রাসাদে ৯শটি আসল দরজা ও ১শটি নকল দরজা রয়েছে।

 

হাজার দুয়ারি প্রাসাদ/ছবি: লেখক

বাংলা বিহার উড়িষ্যায় মোট তিনটি রাজবংশ নবাবি করেছে। এর মধ্যে প্রথম দু’টি রাজবংশ ছিলো স্বাধীন। নাসিরি রাজবংশ যার শুরু মুর্শিদকুলি খাঁ ও শেষ সরফরাজ খাঁর মাধ্যমে। এ রাজবংশ মাত্র ২৪ বছর রাজত্ব করেছে (১৭১৭-১৭৪০)। দ্বিতীয়টি হলো আফসার রাজবংশ যার শুরু আলীবর্দী খাঁ ও শেষ হয় সিরাজ-উদ-দৌলার মাধ্যমে। এই রাজবংশ রাজত্ব করেছে মাত্র ১৭ বছর (১৭৪০-১৭৫৭।  

তৃতীয় রাজবংশের নাম নাজাফি রাজবংশ যার শুরু হয় বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর থেকে আর শেষ হয় ওয়ারিস আলী মীর্যার মাধ্যেমে। তারা ব্রিটিশদের গোলামি করে রাজপদ বহাল রাখতে পেরেছেন মোট ১শ ৪৪ বছর (১৭৫৭-১৯০১)।  

হাজার দুয়ারি প্রাসাদ/ছবি: লেখক

মাঝে ১৮৮২ সাল থেকে বাংলার নবাব পদটি বিলুপ্ত করে ব্রিটিশরা শুধু মুর্শিদাবাদের নবাব পদ রাখে।

ইতিহাসের ‘বৃহদাকার হস্তি লোপ পাইয়া তেলাপোকা টিকিয়া থাকার রহস্য এখানেই’। ব্রিটিশ আধিপত্য স্বীকার করে দেড়শো বছর গদিতে ছিলো মীরজাফরের বংশধর আর তা না করায় বিশ্বাসঘাতকতার অনলে নিশ্চিহ্ন হয়েছে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য।  

হাজার দুয়ারি প্রাসাদ সংলগ্ন একটি গেট/ছবি: লেখক

১৮২৯ সালের ২৯ আগস্ট গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম ক্যাভেন্ডেস ও বহু স্বনামধন্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে নবাব নাজিম হুমায়ুন ঝাঁ এই প্রাসাদের ভিত্তি স্থাপন করেন। এর নির্মাণ কাজে ব্যয় হয় ১৮ লাখ টাকা। এর গাঁথুনির কাজে নাকি অসংখ্য ডিমের কুসুম ব্যবহৃত হয়েছিল বলে শোনা যায়।

এই প্রাসাদটি তিনতলা। প্রাসাদটি বর্তমানে মিউজিয়াম। এর একতলায় বর্তমানে অস্ত্রাগার, অফিস-কাছারি ও রেকর্ডরুম রয়েছে। অস্ত্রাগারে মোট ২৬শটি অস্ত্র আছে। পলাশির যুদ্ধে ব্যবহৃত অনেক অস্ত্রও এখানে আছে। পলাশির প্রান্তরে ব্যবহৃত মীর মর্দনের কামানটিও রয়েছে এখানে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য যে অস্ত্র রয়েছে এর মধ্যে –আলীবর্দীর ব্যবহৃত তলোয়ার ও বহুনল বিশিষ্ট বন্দুক, নাদিরশাহের শিরস্ত্রান, মীরকাসিমের ছোরা, বিভিন্ন ধরন ও আকারের কামান, ছোরা ইত্যাদি।  

প্রাসাদ সিঁড়ির সামনে কামান/ছবি: লেখক

যে ছোরার সাহায্যে মোহাম্মদী বেগ সিরাজকে হত্যা করেন সেটিও এখানে রক্ষিত আছে।  
 
দুই ও তিন তলায় আর্ট গ্যালারি ও লাইব্রেরি। গ্যালারিতে বহু বিখ্যাত চিত্র শিল্লীর চিত্রকলা স্থান লাভ করেছে- যেমন The Burial of Sir John More, Adom & Eve, Black Bent।  

এছাড়া এখানে রয়েছে প্রিন্স হাসান আলী মীর্জা ও হুসেন আলী মীর্জার শৈশবের পেইন্টিং। এর বিশেষত্ব হলো, ছবিগুলো যেদিক থেকেই দেখা হোক না কেন; মনে হবে যেনো শিশু দু’টি দর্শকের দিকেই ঘুরে আছে। এমনকি তাদের জুতো, কোল-বালিশ ও জুতার ফিতা পর্যন্ত সব দর্শকের দিকে।   

লাইব্রেরিতে রয়েছে বহু ধর্মপুস্তক, চুক্তিপত্র, নাটক, নভেল, তাম্রলিপি, ইতিহাস, প্রয়োজনীয় দলিল-দস্তাবেজ ও বিদেশি ভাষার গ্রন্থ ইত্যাদি।

প্রাসাদের উল্টো পাশে ইমামবাড়া ও মদিনা মসজিদ/ছবি: লেখক

আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরির পাণ্ডুলিপিও রয়েছে এখানে। এখানে রয়েছে একটি অ্যালবাম আছে যা তিন হাত দীর্ঘ ও প্রস্থে দুই হাত, ওজন ২০ কেজি। এছাড়া রয়েছে বাগদাদের বিখ্যাত লেখক হারুন অর রশিদের হস্তলিখিত কোরান।

বর্তমান কম্পাউন্ডের আয়তন ৪১ একর। এই প্যালেসের সামনে রয়েছে মনোরম বাগান। একতলা প্যালেসের সামনের বিশাল সিঁড়ি দরবার কক্ষ পর্যন্ত উঠে গেছে। সামনে লম্বা গোলাকার স্তম্ভে সুন্দর নকশার কাজ রয়েছে ও সিঁড়ির দু’পাশে দু’টি সিংহ মূর্তি ও দু’টি ছোট সেলামি কামান এর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সেলামি কামানের মাধ্যমে নবাবরা ব্রিটিশরা আসলে তাদের সেলাম দিতেন। এভাবে সেলাম দিয়ে পরবর্তী দেড়শো বছর রাজত্ব করেছে এই হাজার দুয়ারি প্রাসাদের রাজবংশ।

সিংহ ও শেকলবন্দি ঘোড়া/ছবি: লেখক

হাজারদুয়ারি প্রাসাদে সংগৃহীত সামগ্রীর বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। নবাবি আমলের অনেক জৌলুসই এখানে দেখা যাবে। নিমিষেই হারিয়ে যাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায়।  

প্রাসাদ ভবনে প্রবেশদ্বারের ঠিক উপরেই রয়েছে একটি প্রতীকী খোদাই চিত্র যাতে রয়েছে একটি সিংহ ও একটি ঘোড়া। ঘোড়াটি শেকল দিয়ে বন্দি কিন্তু সিংহটি মুক্ত। এই সিংহ ব্রিটিশরাজত্বের প্রতীক আর বন্দি ঘোড়া পরাধীন নবাবি ও পরাধীন বাংলার প্রতীক। এভাবেই কেটে গেছে পরাধীনতার ১শ ৯০ বছর।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১১ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০১৭
এসএনএস

আগের পর্ব পড়ুন:
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ
** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে
** ৬ষ্ঠ পর্ব: নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ শোনা যায় নসীপুর প্রাসাদে
** ৭ম পর্ব: কিরীটেশ্বরী মন্দির ও জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম
** ৮ম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি!
** ৯ম পর্ব: হেস্টিংসের স্ত্রী, মেয়ের সমাধি ও একটি আর্মেনিয়ান চার্চ
** ১০ম পর্ব: মুজিবনগর ও পলাশী: বাংলার ইতিহাসের দুই আম্রকানন 

** ১১তম পর্ব: ৩শ বছরের ডাচ সিমেট্রি ও যোগেন্দ্র নারায়ণের মন্দির
** ১২তম পর্ব: সতীদাহ ঘাটের পাতালেশ্বর মন্দির

** ১৩তম পর্ব : আশি টাকার গাড়ি ও সোনার রথ
** ১৪তম পর্ব : ষড়যন্ত্রের গ্রিনরুম ছিল কাসিম বাজার

** ১৫তম পর্ব: কাসিম বাজার ছোট রাজবাড়ির বড় আয়োজন
** ১৬তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর জগৎজয়ী কামান
** ১৭তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি
** ১৮তম পর্ব: ফুটি মসজিদ: নির্মাণের অপেক্ষায় ৩শ বছর
** ১৯তম পর্ব: রোশনিবাগে শুয়ে আছেন নবাব সুজাউদ্দিন
** ২০তম পর্ব: মুর্শিদাবাদের শেষ নবাবের প্রাসাদ
** ২১তম পর্ব: বৈচিত্র্যময় মুর্শিদাবাদের খাবার
** ২২তম পর্ব: গ্রামের পথে খোসবাগ থেকে রোশনিবাগ
** ২৩তম পর্ব: রেশম যুগের মুর্শিদাবাদ
** ২৪তম পর্ব: বাচ্চাওয়ালি কামান ও ইমামবাড়া

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।