ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

পর্ব ৩১

নিমক হারাম দেউড়ি ও মীর জাফরের বাড়ি

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৯ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১৭
নিমক হারাম দেউড়ি ও মীর জাফরের বাড়ি মীর জাফরের বাড়ি

যুগে-যুগে, কালে-কালে মীর জাফরকে বাংলার মানুষ এক বিশ্বাসঘাতক বলেই জানবে। মীর জাফর বলতে আমরা বিশ্বাসঘাতকদেরই বুঝে থাকি। পলাশী যুদ্ধ হয়েছে আজ থেকে প্রায় ২৬০ বছর আগে। এর মাঝে গঙ্গা-ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টাও হয়েছে অনেক। মীর জাফরের বংশধর বাংলার পরবর্তী নবাব ও ব্রিটিশরা মিলে ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টাও কম করেনি। তা না পেরে ভিন্নভাবে ইতিহাস রচনা ও রটনার চেষ্টা করেছে। 

সেই চেষ্টা আজও অব্যাহত রয়েছে। মুর্শিদাবাদে আজও মীর জাফরকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা হয়।

কিন্তু ইতিহাসের সরল ও সত্য পাঠতো এই যে, মীর জাফর এক বিশ্বাসঘাতক ছাড়া আর কিছুই নন।

নিমক হারাম দেউড়ি

বাংলার পরাধীনতার ইতিহাস যেমন লেখা হয়ে গেছে, তেমনি লেখা হয়ে গেছে মীর জাফরের ইতিহাস। মুর্শিদাবাদের পদে-পদে, পথে-পথে লেখা আছে বাংলার স্বাধীনতা ও পরাধীনতার ইতিহাস, দেশপ্রেম আর বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। সেই ইতিহাসে মীর জাফর এক বিশ্বাসঘাতকের নাম।  

পলাশীর প্রান্তরে পরাজয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি দরজা। এই দরজা বা গেট টি ‘নিমক হারাম দেউড়ি’ বা বেইমানের দরজা নামেই সবার কাছে পরিচিত। বিশ্বাসঘাতকদের সর্দার মীর জাফরের বাড়ির প্রধান ফটককেই জনসাধারণ ওই নাম দিয়েছে।

নিমক হারাম দেউড়ি

মীর জাফরের পুরনো সেই প্রাসাদ বাড়িটি এখন আর নেই। সেখানে রয়েছে ছোট দু’টি ভবন। ওই ভবন দু’টি আসলে বর্তমানে ইমামবাড়া, যা প্রায় সবসময়ই বন্ধ থাকে।

মীর জাফরের বাড়ির প্রধান ফটক বা ‘নিমক হারাম দেউড়ি’র বর্তমান অবস্থা ভগ্নপ্রায়। এর ভেতর দিয়ে ঢুকলে আরেকটি গেট আছে। এই দ্বিতীয় গেটটির ভেতরেই বর্তমান বাড়িটি রয়েছে।

নিমক হারাম দেউড়ি

সিরাজ-উদ-দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর সপরিবারে এখানেই বসবাস করতেন। তার প্রাসাদের প্রধান ফটকই পরে স্বাধীনতচেতাদের কাছে ‘নিমক হারাম দেউড়ি’ নামে বেশি পরিচিতি লাভ করে।

মীর জাফর বিলাসবহুল ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপন করতেন। তার প্রাসাদেও ছিল সেই জৌলুস ও বিলাসিতা। তখন তার প্রাসাদটি সবসময় কামান, সৈন্য-সামন্ত দ্বারা সুরক্ষিত ছিলো। ইমামবাড়া

কথিত আছে, পলাশীর যুদ্ধের আগের দিন মীর জাফরের এই বাড়িতে ষড়যন্ত্রকারীরা বৈঠক করেছিল। ইংরেজদের কাসিমবাজার কুঠি ও ঘসেটি বেগমের মতিঝিলে ইতিপূর্বে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে যে বোঝাপড়া হয়েছিল, তারই চূড়ান্তরূপ দিতে ষড়যন্ত্রকারীরা সেদিন এখানে এক হয়েছিল। বাংলা ও সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন করতেই মীর জাফরের প্রাসাদে বৈঠক হয়েছিল।

এই বৈঠকে সেদিন অংশ নিয়েছিলেন কাসিমবাজার কুঠির প্রধান ওয়াটস, মীর জাফর ও তার পুত্র মীরনসহ অন্যান্যরা। মীর জাফরের ছিল পাঁচ ছেলে। তাদের মধ্যে মীরনই প্রধান ষড়যন্ত্রকারী। শুধু তাই নয়, মীরনের নির্দেশেই মোহম্মদী বেগ হত্যা করে সিরাজকে। সেদিন মীরনই ওয়াটসকে তার প্রাসাদে নিমন্ত্রণ করেন। এই প্রাসাদের হারেমেই ষড়যন্ত্রের নীল নকশা প্রণয়ন করা হয়।  

এই প্রাসাদে বসেই মীর জাফর পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ না করার অঙ্গীকার করেন। পলাশীর যুদ্ধে তিনি তার ‘কথা’ রাখলেন। কিন্তু রাখলেন না বাংলার জনগণ আর নবাবকে দেওয়া কথা। বেইমানি করলেন সিরাজ ও বাংলার সঙ্গে। মীর জাফরের বাড়ি

পলাশীর যুদ্ধের পর সিরাজকে কোথায় হত্যা করা হয়েছে তা নিয়ে নানা মত আছে। কেউ কেউ মনে করেন এই প্রাসাদেই হত্যা করা হয়েছে সিরাজকে। আবার অনেকে মনে করেন, হত্যার পর নবাব সিরাজের মরদেহ সারারাত ফেলে রাখা হয় জাফরাগঞ্জের এ প্রাসাদেই।  

ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। ইতিহাস বেইমানকে তার ‘মর্যাদা’ দিয়েছে। মীর জাফরের নামটি বেইমানের খাতায় লেখা হয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। বেইমান মীর জাফরের কুকীর্তির সাক্ষ্য হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে ওই ‘নিমক হারাম দেউড়ি’। ভগ্নপ্রায় এ দরজাটি হয়তো নিশ্চিহ্ন হয় যাবে একদিন, মাটির সঙ্গে মিশে যাবে কোনো একদিন। কিন্তু তাতে কি মানুষ ভুলে যাবে ইতিহাসের এই বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরকে?

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৯ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১৭
এইচএ/

আগের পর্ব পড়ুন
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ
** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে
** ৬ষ্ঠ পর্ব: নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ শোনা যায় নসীপুর প্রাসাদে
** ৭ম পর্ব: কিরীটেশ্বরী মন্দির ও জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম
** ৮ম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি!
** ৯ম পর্ব: হেস্টিংসের স্ত্রী, মেয়ের সমাধি ও একটি আর্মেনিয়ান চার্চ
** ১০ম পর্ব: মুজিবনগর ও পলাশী: বাংলার ইতিহাসের দুই আম্রকানন 

** ১১তম পর্ব: ৩শ বছরের ডাচ সিমেট্রি ও যোগেন্দ্র নারায়ণের মন্দির
** ১২তম পর্ব: সতীদাহ ঘাটের পাতালেশ্বর মন্দির

** ১৩তম পর্ব : আশি টাকার গাড়ি ও সোনার রথ
** ১৪তম পর্ব : ষড়যন্ত্রের গ্রিনরুম ছিল কাসিম বাজার

** ১৫তম পর্ব: কাসিম বাজার ছোট রাজবাড়ির বড় আয়োজন
** ১৬তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর জগৎজয়ী কামান
** ১৭তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি
** ১৮তম পর্ব: ফুটি মসজিদ: নির্মাণের অপেক্ষায় ৩শ বছর
** ১৯তম পর্ব: রোশনিবাগে শুয়ে আছেন নবাব সুজাউদ্দিন
** ২০তম পর্ব: মুর্শিদাবাদের শেষ নবাবের প্রাসাদ
** ২১তম পর্ব: বৈচিত্র্যময় মুর্শিদাবাদের খাবার
** ২২তম পর্ব: গ্রামের পথে খোসবাগ থেকে রোশনিবাগ
** ২৩তম পর্ব: রেশম যুগের মুর্শিদাবাদ
** ২৪তম পর্ব: বাচ্চাওয়ালি কামান ও ইমামবাড়া
** ২৫তম পর্ব: হাজার দুয়ারি প্রাসাদে শেকলবন্দি নবাব
** ২৬তম পর্ব: রহস্যে ঘেরা ঘসেটি বেগমের ধনভাণ্ডার
** ২৭তম পর্ব: ষড়যন্ত্রের আখড়া ঘসেটির প্রাসাদ

** ২৮তম পর্ব: মতিঝিল: ষড়যন্ত্রস্থলে আজ প্রকৃতি তীর্থ
** ২৯তম পর্ব: জগৎশেঠের বাড়ি ও তার পরিণতি
** ৩০তম পর্ব: মীর জাফর ও পরাধীন নবাবদের সমাধিক্ষেত্র

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।