তিন দিনের এ মেলায় শুধু বাউল আর সাধু নয়, আসেন সাধারণ জনগণও। মন ভরে শোনেন ও উপলব্ধি করেন মহাত্মা লালন ফকিরের অমিয় বাউল সঙ্গীত।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। দিনের অন্য সময়ের থেকে মেলায় বাড়তে থাকে জনসমাগম। ঘড়ির কাঁটা রাত ১০টার কাছাকাছি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ভিড় জমে যায় মেলার প্রবেশ গেটে। জনগণের ভিড় সামলে সবাইকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করানোর উদ্যোগে প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকদের দাঁড়াতে হয় লাইন ধরে।
মেলার শেষদিন বুধবার পেরিয়ে বৃহস্পতিবার হয়ে গেছে। রাত তখন প্রায় দু’টো। মূল মঞ্চের বাইরে মাজারের পাশে ঘর বেঁধেছেন হাজারো বাউল সাধু। তাদের মধ্যেই কেউ একজন হঠাৎ গেয়ে উঠলেন, ‘তিন পাগলের হলো মেলা নদে এসে’। সঙ্গে সঙ্গে ভিড় জমে গায়েনকে ঘিরে। ছুটে আসেন লালনভক্তরা। জমে ওঠে মাঝ রাতের আসর।
প্রথম গান শেষ হতেই হৈ-হুল্লোড় আর হাততালিতে মেতে ওঠে দর্শক। সমবেত সুর ওঠে ‘আরো একটি’র জন্য। চিৎকার করে বাউল শিল্পী তুরান মন্ডল বলেন ‘ভায়েরা চিল্লায়েন না। গান বাজানো জায়েজ, গান বাজানো না-জায়েজ। সেটা কেন তা আমাদের বুঝতে হবে। এভাবে হৈ-হুল্লোড় করলেই গান আমাদের জন্যে না-জায়েজ। তবে যদি মন দিয়ে সে গান উপলব্ধি করেন, দীক্ষা নেন, জীবনবোধ বুঝতে চেষ্টা করেন, তবে তা আপনার জন্য না-জায়েজ না। ’ দর্শকদের হৈ-চৈ থামে। তারা এবার গোল হয়ে ঘিরে ধরে শিল্পীকে। ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’ গাইতে শুরু করেন তুরান মন্ডল।
বাউলের একতারার সঙ্গে কুষ্টিয়াবাসীর অন্বয় বহুদিনের। তাইতো রাত ৩টা বাজলেও মূলমঞ্চে চলতে থাকে বাউল গানের আসর। সে আসরে কমতি নেই ঘুমহীন শ্রোতার। মূল মঞ্চের পাশে কথা হয় শ্রোতা ইমরানের সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, বাউল গানের এমন আসর তো খুব কম হয়। দেশের জনপ্রিয় বাউলেরাও এ আসরে সমবেত হয়ে গান পরিবেশন করেন। এমন সুযোগ তো সচরাচর পাওয়া যায় না। তাই গভীর রাত অবধি বন্ধুরা গান শুনছি। লালনের দর্শন বোঝার চেষ্টা করছি।
লালন একাডেমি ও কুষ্টিয়া জেলা প্রসাশনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ উৎসবে রাতের অন্ধকারেও জনগণের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এ সময় যেন জেগে ওঠে বাউলদের গানবোধ। তাইতো তারাও কণ্ঠ ছাড়েন গভীর রাতে।
কথা হয় বাউল মৌমিতা চক্রবর্তীর সঙ্গে। মধ্যবয়সী এ বাউল মধ্যরাতে নিজেকে সম্পূর্ণ আধুনিক বাউলের সাজে সাজিয়ে গান করছিলেন। তিনি বলেন, গানের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। যখন ভাব আসে, তখনই গান আসে। সাঁইজি নিজেও গানকে সময়ের শিকলে বাঁধেননি। তিনিও মাঝরাতে গানের আসর বসাতেন। আর কেন জানি না, অন্য সময় থেকে শেষ রাতের দিকে বাউল গানের সৌন্দর্য বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
লালন স্মরোণোৎসব দেশের সমগ্র অঞ্চলে থাকা বাউল সাধুরা ছুটে আসেন প্রাণের টানে। আসেন তাদের শিষ্য-প্রশিষ্য আর সাধন সঙ্গিনীরা। বাউলতত্ত্বের মর্মকথা জানতে, সর্বোপরি তাদের লালন তত্ত্বে জীবন দর্শন সম্পর্কে জানতে ছুটে আসেন সাধারণ জনগণও। বাউল গানের স্বাদ নিতে আসা মানুষকে সাধুরা তাদের সে তত্ত্ব বুঝিয়ে দেন গানের মধ্য দিয়ে। রাত জেগে চলে সে গান, বাঙালির প্রাণের গান। আর সে গানের টানেই রাতে এ উৎসবে জনগণের উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মতো।
বাংলাদেশ সময়: ০১০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৭
এইচএমএস/এএ