অপরাজিতা, লতানো গাছে সবুজ পাতার কোলে এক টুকরো প্রগাঢ় নীলের সম্ভাষণ। বাতাসের হালকা দুলুনিতে ভালোলাগার অনুভূতিকে নিমেষে ছুঁয়ে যাওয়া।
স্ত্রী বিশেষণের গাঢ় নীল রঙের এ ফুলটির নাম আছে আরো একটি, তা হলো নীলকণ্ঠ। নীলাম্বরী সাজে সেজে সে যেন দীর্ঘকাল অপেক্ষা করছে তার প্রিয়তমের জন্য। অন্তত তার একা থাকার রূপটি দেখে এমনটাই ভাব জাগে ফুল ভালোবাসা মানুষের মনে। কণ্ঠে নীল হার পরে থাকা অপরাজিতা বিলোয় না কোনো গন্ধ। তবুও অভাব নেই তাকে ভালোবাসার মানুষের।
শুধু কি ফুল? পুষ্প প্রেমিকদের কাছে অপরাজিতার লতা-পাতাও ভীষণ কামনীয়। এ লতায় যদি ফুল না-ও ফুটতো, তবুও লতা আর পাতার বাহারেই আদরণীয় থাকতো সে। শুধু লতাপাতায় বাগানে বাগানে নিজের আবাস স্থায়ী করে নিতে একটুও অসুবিধা হতো না তার। উপরন্তু নীল ফুলের শোভা একে সৌন্দর্যে করেছে অনন্য।
আমাদের দেশে নীল ছাড়াও সাদা ও বেগুনি রঙের অপরাজিতা দেখা যায়। গাঢ় নীল ফুলের ভেতরের দিকটা সাদা বা ঈষৎ হলদে রঙের। সাধারণত বৃষ্টির সময় অপরাজিতা গাছের ডাল স্যাঁতসেঁতে মাটিতে রোপণ করতে হয়। আবার ছোট ছোট ধূসর ও কালো রঙের বীজ রোদে শুকিয়ে নরম মাটিতে লাগালেও গাছ হয়। বাড়ির আঙিনায়, টবে বা বাগানেও লাগানো যায় এ গাছ। আশপাশের উঁচু গাছ বেয়ে এটি তরতর করে বেড়ে ওঠে, বিকশিত হয় ফুলে আর পাতায়।
অপরাজিতার হালকা সবুজ রঙের পাতার গড়ন উপবৃত্তাকার। ঝোপজাতীয় গাছে প্রায় সারা বছর ফুল ফোটে। বহুবর্ষজীবী এ লতা লম্বা হয় প্রায় ২০ ফুট পর্যন্ত। প্রায় ১২ মাস ফোটা Clitoria ternate বৈজ্ঞানিক নামের এ ফুলের বীজ নরম মাটিতে রোপণ করলে চারা গজায় ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে। একবার লতা বেড়ে উঠলে প্রতিদিন গোড়ায় একটু পানি দেওয়া ছাড়া বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয় না বলে জানালেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা খন্দকার কামরুল ইসলাম।
অপরাজিতার রয়েছে চমৎকার ভেষজগুণ। ব্রণ, আমাশয়, মূত্ররোগের চিকিৎসায় এ ফুল ব্যবহার করা হয়। সাদা অপরাজিতার শেকড় সাপের বিষনাশক এবং প্রসবব্যথা নিবারণে কার্যকর। নীল অপরাজিতার শেকড়ে বাতব্যথার উপশম হয়। এছাড়া সনাতন ধর্মানুসারীদের কাছেও অপরাজিতা পবিত্র উদ্ভিদ।
পৌরাণিক কাহিনিতে আছে, অপরাজিতা লতা বা শেকড় হাতে বাঁধলে অপরাজেয় থাকা যায়। শারদীয় দুর্গোৎসবের ষষ্ঠীর বোধনে প্রয়োজন হয় অপরাজিতার লতা। এমনকি বিজয়া দশমীর দিনে প্রতিমা বিসর্জনের পর কুলপ্রথা অনুসারে পূজামল্ডপে ভক্তদের বিজয় কামনায় প্রচলন আছে অপরাজিতা পূজার। এসময় অপরাজিতা লতাকে দেবী রূপে চিন্তা করে অভিলষিত ফল কামনায় ডান হাতে এই লতা ধারণ করা হয়।
রূপে-গুণে অনন্য নীল অপরাজিতা বারো মাস ফুটলেও কমে যায় শীতে। নীল ফুলের গাছ যতো তাড়াতাড়ি শাখা-প্রশাখা ছড়ায়, সাদাটা ততো দ্রুত নয়। অপরাজিতা ফুল গুচ্ছে ফোটে না। পাতাভর্তি লতার ফাঁকে ফাঁকে এক একটি ফুল। যেন এরা একা থাকতে ভালোবাসে। নজরুলের গানের মতো: ‘আমি বিজন বনের অপরাজিতা/ আমার কথা কহি গানে...!’ তবে বাড়ির আঙিনায় একা থাকলেও সে সর্বদা ডেকে ফেরে পথিককে। সে-গানেই পথিককে পথ আবার ফিরিয়ে আনে নীড়ের ঠিকানায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৫ ঘন্টা; ডিসেম্বর ০৪, ২০১৭
এইচএমএস/জেএম