আমার সামনে যিনি বসে আছেন তার নাম নীলা রাশেদ। রাশেদ তার বাবার নাম।
নীলা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাদের আন-এক্সপেক্টেড বেবি ছিল সে। নীলার বাবা মি. রাশেদ এবং মায়ের বিয়ের কিছু দিন পর তাদের সংসার ভেঙে যাচ্ছিল। বনিবনা হচ্ছিল না। দু’পরিবারই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল তাদের বিচ্ছেদের জন্য। এ সময় নীলা তার মায়ের পেটে আসে। অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণে মুষঢ়ে পড়েন নীলার মা। নাটকীয়ভাবে নীলা রাশেদ নামের ভ্রুণটিই তাদের সংসার টিকিয়ে দেয়। তার এই অপ্রত্যাশিত জন্ম তার মা কোনদিন মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। তাকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মারধোর করেছেন। বালতির পানিতে মুখ চেপে ধরেছেন। নীলার ধারণা তাকে মেরে ফেলতেই বালতির পানিতে মুখ চেপে ধরেছিলেন। যদিও নীলার মা তা স্বীকার করেননি। নীলার অপ্রত্যাশিত জন্মের ক্ষোভ নীলার ওপর তিনি তুলেছেন। একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত নীলার ধারণা ছিল ইনি নীলার আপন মা নন, সৎ মা।
সংসারের অশান্তি আর দৈনিক চলমান ক্লান্তিকর ঝগড়া এড়াতে নীলার বাবা বিদেশ চলে যায়। বছর দুয়েক পর পর আসে। মাস খানেক থাকেন বাংলাদেশে। এই সময় নীলার মা খুবই ভালো ব্যবহার করে নীলার সাথে। নীল সবচেয়ে বেশি ভালো থাকে এই সময়টায়। সে তার মাকে যতটা অপছন্দ করে, তার বাবাকে ঠিক ততটাই পছন্দ করে। সে তার বাবা ছাড়া আর কাউকে এতোটা ভালোবাসে না।
আমি বললাম, কেন তোমার বরকে ভালোবাসো না? যতটুকু জানি তুমি পালিয়ে বিয়ে করেছিলে।
নীলা হাসল।
নীলার বরকে সে বিয়ে করেছিল ভালোবেসেই। তার নাম শহীদ। শহীদ নীলার ফুফুর ভাসুর পুত্র। এটা ঠিক প্রেম ছিল না। তার মায়ের হাত থেকে বাঁচতে একটা অবলম্বন খুঁজছিল। একটা অবলম্বন দরকার ছিল খুব। সে শহীদকে বেছে নিয়েছে। বিয়ে করতে বাধ্য করেছে। বিয়ের পর শহীদ এবং তার মাঝে ব্যাবধান বুঝতে পারে। শহীদের পড়া লেখা নেই প্রায়। চিন্তা ও চেতনায় সে গোঁয়ার। গেঁয়ো। শরীরটাই চেনে শুধু। সেটাও জানোয়ারের মতো করে। তার নিজের মতো করে। ইতালি গিয়েছে কয়েক বছর আগে। ইতালি থেকে দু’বছর পর আসে একবার। অল্প ক’ দিন থাকে। তার আগেই নীলাকে বলে রাখে- এই কয় দিন শরীর খারাপের অজুহাত দেওয়া যাবে না।
নীলা জানে অজুহাত দিয়েও লাভ নেই। একদিন শরীর খারাপ বলায় শহীদ গালি দিয়েছিল। গায়ে হাত তোলে। 'আমি থাকি না, মাগী তুই অন্য ব্যাটার কাছে যাস? আমারে ভাল্লাগে না?' যে দিন শহীদ তার গায়ে হাত তুলেছিল সে দিন থেকে সে তার বরকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে। মেয়েরা গায়ে হাত তোলার দিন থেকে তার স্বামীকে ঘৃণা করতে শুরু করে। হয়তো সংসার টিকে থাকে, হয়তো সামাজিক কারণে আবার হাসতে হয়, চলতে হয়, কিন্তু ঘৃণা কমে না। এটা ছেলেরা জানে না।
আমি বললাম, বিষ খেয়েছিলে কেন?
নীলা হাসল। বিষ খাইনি। ঘুমের বড়ি খেয়েছিলাম।
একটা ছেলের সাথে তার পরিচয় হয়। মোবাইলে। প্রায় রাতে কথা হতো। শহীদ তখন ইতালি। ছেলেটার সাথে রাত বিরাতে কথা হয়। প্রেম হয়। গাজীপুর থেকে একসময় ছেলেটা কুমিল্লা আসে দেখা করতে। দু জন ঘোরাঘুরি করে। হোটেলে একদিন ছিল। সে খুব করে চেয়েছে যেন নীলা হোটেলে যায়। নীলা যায়নি বলে ছেলেটা হতাশ হয়। গাজীপুর ফিরে মোবাইল সিম চেঞ্জ করে। যোগাযোগ বন্ধ। নীলা প্রচন্ড একা আর মিস করতে থাকে ছেলেটিকে। সে ফোন করে শুধু বলতে চায়- আমি হোটেলে যাব। তবু তুমি আমাকে ফিরিয়ো না। সে কথা আর বলা হয় না। ছেলেটিকে আর পাওয়া যায়নি।
আমি বলি- তাই কি ঘুমের বড়ি খেলে?
নীলা বলল- হুম। হুম বলে বাইরে তাকাল। আমি নীলার মুখের একপাশ দেখতে পাচ্ছি। হাসি ছাড়া নীলার গালে টোল পড়ে আছে।
নীলা ঘুমের ট্যাবলেট খেলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। নীলার পরিবার জানে শহীদের সাথে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ঝগড়া করেই সে বড়ি খেয়েছে। ঘটনার দুদিন পরেই শহীদ দেশে ফিরে আসে। সেও জানে তার সাথে ঝগড়া করেই নীলা আত্মহত্যা করতে চেয়েছে। শুধু নীলার মা জানে সব। নীলার মা তার এই দূর্যোগের দিনেও তার পাশে দাঁড়ায়নি। উল্টো কথা শুনিয়েছে- তোকে পাপে ধরেছে।
আমি বললাম, বাচ্চাদের আনোনি কেন?
নীলা রাশেদ বলল- বাচ্চারা তাকে পছন্দ করে না। তারা নানীর কাছে থাকে সারাদিন।
আমি বললাম আমার এখানে কেন এলে?
নীলা বলল, আমি একেবারে চলে এসেছি।
আমি তার কথা বুঝতে পারিনি। বোঝার চেষ্টা করছি। সে কিছুটা এগিয়ে বলল, আমাকে তুমি অনেক বোঝ। আমি তোমার কাছেই থাকব ভেবেছি।
আমি বললাম- মানে?
মানে বলার সময় যতটা সম্ভব চোখ কপালে তুললাম।
নীলা বলল- আমি তোমাকে ধরে বেঁচে থাকতে চাই! তুমি যা চাও আমি দিব। আমি আর আগের ভুল করতে চাই না।
নীলার হাস্যকর কথায় মজা পাচ্ছি। হাসতে হাসতে বললাম আর ইউ সিরিয়াস?
নীলার চিবুক হঠাৎ শক্ত হতে দেখা গেল। টিনেজ বালিকার মতো একটি ব্লেড বের করে হাতের মাঝে ব্লেড চালাল। রক্ত পড়ছে। সে গলায় ব্লেড ধরে আছে আমি তার প্রস্তাবে ‘না’ বললে সে গলায় ব্লেড চালাবে।
আমি বললাম- আর ইউ ম্যাড?
সে সম্ভবত আমাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাচ্ছে। আমি যেন ‘না’ বলার শক্তি হারিয়ে ফেলি। একথা ঠিক যে যতটা ভয় পাওয়ার দরকার আমি পেয়েছি।
সে বলল- তুমি মাসের পর মাস আমার কথা শুনেছ। আমার খুব দুঃসময়ে তোমার সাপোর্ট না পেলে টিকে থাকতে পারতাম না। তুমি আমাকে ভালো বোঝ। আমি কিসে ভালো, থাকি না থাকি তুমি জান। তুমি আমাকে আশ্রয় দিয়েছ, প্রশ্রয় দিয়েছ। আমি তোমাকে প্রতিটা মুহূর্ত মিস করি। আমি তোমাকে চাই। তোমাকে ছাড়া থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। প্লিজ আমাকে ফিরিয়ো না।
আমি দাঁড়িয়ে আছি। কী করব বুঝতে পারছি না।
প্রেসক্লাবের ডান পাশে আমগাছটার নিচে প্লাস্টিকের দুটো চেয়ার পেতে এই গল্পটাই এক যুবক শোনাচ্ছিল প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজকে। হেলাল ভাই বললেন, এরপর তুমি কী করেছিলে?
আপনিই বলেন। তখন একটা ছেলের কী করা উচিত।
হেলাল ভাই বললেন, আমি নিউট্রন বোমা বুঝি না, কিন্তু প্রেম বুঝি। এতোটা ভয়ংকর প্রেম টেনে নেওয়ার সাহসও কোন পুরুষ মানুষের নেই। এতোটা প্রেম দূরে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কোন পুরুষকে ঈশ্বর দেননি।
লেখক: মনোয়ার রুবেল
ব্লগার ও অনলাইন। অ্যাক্টিভিস্ট। ইমেইল- monowarrubel@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ০১৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৫