ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

বড়গল্প/পর্ব-২

কুঁড়ি থেকে ফুল | যুথিকা বড়ুয়া (পর্ব-২)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১৬
কুঁড়ি থেকে ফুল | যুথিকা বড়ুয়া (পর্ব-২)

জয়ন্ত কনভিন্স করার চেষ্টা করে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে স্বাভাবিক গলায় বললো, আদিখ্যেতা বলছো কেন? আদর করে কেউ যদি আমায় অন্তু বলে সম্বোধন করে, এতে দোষের কী আছে!

এক.
-‘চেঁচিও না। তোমার সব খবর আমি পেয়েছি।

তিনঘণ্টা আগে তুমি অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছ, বলো সত্যি কিনা?’

খানিকটা নরম হয়ে জয়ন্ত বলল, ‘আশ্চর্য্য! এতে জবাবদিহির কী আছে! হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তো!’

মাথাটা বনবন করে ঘুরে ওঠে মহুয়ার। ক্রোধে ফেটে পড়ে। গলার স্বর বিকৃতি করে বলে, ‘সেটা বুঝতে কারও বাকি থাকে? বলো কোথায় গিয়েছিলে?’

বিব্রত কণ্ঠে জয়ন্ত বললো, ‘আরে বাবা, টিকিট বুক করতে গিয়েছিলাম!’

-‘ও, তাই নাকি! তাহলে সঙ্গেও কেউ যাচ্ছে নিশ্চয়ই!’

-‘ইয়েস, অফ্ কোর্স! আই অ্যাম নট্ গোয়িং অ্যালোন! তুমি তো জানো!’

-‘হ্যাঁ, সেই জন্যই তো বলছি, তোমার বসের মেয়ে, কী যেনো নাম, মিলি না লিলি, ওই ডাইনিটাও তো যাচ্ছে সঙ্গে, তাই না?’

চটে যায় জয়ন্ত। উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘আবার ওকে ইনভলব্‌ করছো কেন? আর ইউ ক্রেজি? মিটিংয়ের সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক?’
-‘হ্যাঁ, সম্পর্ক আছে বলেই তো। ভাবছো টের পাইনি। চুপিচুপি হীরের নেকলেস গড়িয়ে দিয়েছ। নিজের হাতে পরিয়েও দিয়েছ, কিসের জন্যে? শুধুই কি চাকরির খাতিরে, না অন্যকিছু?’

-‘আহ, মৌ, এসব কী যা তা বকছো বলো তো! তোমরা মেয়েরা বড়ই বিচিত্র। অন্যের সুখ মোটেই সহ্য করতে পারো না। আরে বাবা, বসকেও তো একটু সন্তুষ্ট করতে হয়, নাকি! শোনো লক্ষ্মীটি, ছেলেমানুষী কোরো না। সময় খুবই কম। আমায় এক্ষুণিই বের হতে হবে। ’

শুনে পিত্তি জ্বলে ওঠে মহুয়ার। সর্বাঙ্গ রি রি করছে রাগে। নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে গর্জে ওঠে, ‘কী, ছেলেমানুষী আমি করছি, না তুমি করছো’।

মহুয়ার কথার জেরায় বিপাকে পড়ে যায় জয়ন্ত। আমতা আমতা করে বলে, ‘আ-আমি আবার কী করলাম!’

-‘কী করলাম মানে! বসের মেয়েকে নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি, নামের সংক্ষিপ্ত, এসব কী ফষ্টি-নষ্টি শুরু করেছ? যত্তসব আদিখ্যেতা!’

জয়ন্ত কনভিন্স করার চেষ্টা করে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে স্বাভাবিক গলায় বললো, আদিখ্যেতা বলছো কেন? আদর করে কেউ যদি আমায় অন্তু বলে সম্বোধন করে, এতে দোষের কী আছে! এটুকুই সহ্য করতে পারছো না, আমায় নিয়ে সারাজীবন সংসার করবে কীভাবে? আর তাছাড়া, সবসময় তোমায় কৈফিয়ত দিতে হবে, এমন তো প্রতিজ্ঞা আমি করিনি কখনও’!

বুকের ভিতরে যেনো একটা শূল গেঁথে গেলো মহুয়ার। কাতর কণ্ঠে অস্ফূট আর্তনাদ করে ওঠে। ‘একথা তুমি বলতে পারলে জয়! তোমার মুখে একটু আটকালো না। এটুকু জানবার অধিকারও কি আমার নেই? আমাদের এতোদিনের সম্পর্ক, ভাব-ভালোবাসা, মেলামেশা, সবই কি মিথ্যে? বলো জয়ন্ত বলো! চুপ করে থেকো না, বলো!’

মেয়েদের ব্যাপারে জয়ন্ত বরাবরই দুর্বল। অল্পতেই মোমের মতো গলে নরম হয়ে যায়। বিশেষ করে অচেনা নারীর সামনে ওভার অ্যাক্ট একটু বেশিই করে। কিন্তু আজ পড়ে গেছে মহুয়ার ফাঁদে। সহজে রেহাই পাওয়ার নয়। তাই যথাসম্ভব নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বললো, ‘এসব তোমার মনের ভ্রম মৌ! আমি অ্যাবসেন্ট থাকলেই যতোসব আজে-বাজে চিন্তা তোমার মাথায় আসে। অযথা নিজেই কষ্ট পাচ্ছো। একটু ধৈর্য্য ধরো, আর কয়েকটা দিন আমায় সময় দাও! তারপর......’!

-‘তারপর কী?  পাল্টা প্রশ্ন মহুয়ার। -বিয়েটা এবার সেরে ফেলবে, এই তো!’
 
-‘আচ্ছা, তোমার আজ কী হয়েছে বলো তো? সেই তখন থেকে শুধু আবোল-তাবোল বকে যাচ্ছো। বললাম তো, কয়েকটা দিন সময় দাও! রাইট নাউ আই ডোন্ট হ্যাভ টাইম টু ডিসকাশন্ অ্যাবাউট ইওর ডিজগাস্টিং ম্যাটার। ওকে? বাই!’

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে লাইনটা কেটে দিলো জয়ন্ত। ক্রোধে চোখমুখের শিরাগুলো ফুলে ওঠে মহুয়ার। রিসিভারটা জোরে আঘাত করে রেখে দিয়ে ওর পরিধানের কাপড়টা একটানে খুলে ছুড়ে ফেলে দেয় মাটিতে। রেকর্ড প্লেয়ারটা হাইভলিওমে অন্ করে স্বগতোক্তি করতে করতে বসে পড়ে সোফায়, ‘কার জন্যে এই দীর্ঘ প্রতীক্ষা? কার জন্যে এতো সাজ-সরঞ্জাম, এতোসব আয়োজন? কিসের জন্য? মিটিং না ছাই। মিটিং মানেই হুইস্কির বোতল। আর কচি কচি সুন্দরী যুবতী রমণীর পিছে পিছে ঘোরা, ওদের মনোরঞ্জন করা। ওর সব মিথ্যে। আনন্দ-হাসি-কলোতান, প্রেম-ভালোবাসা সব মিথ্যে। তুমি একজন চরিত্রহীন, ধোঁকাবাজ, ধান্দাবাজ জয়ন্ত। কিন্তু পালাবে কোথায়? ফিরে তোমায় আসতেই হবে। মেয়েদের মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, এ আমি কখনও হতে দেবো না। কিছুতেই না। বারুজ্জ্যে বংশের মেয়ে আমি। কতদূর উড়তে পারো তুমি, আমিও দেখে নেবো’।  


উত্তপ্ত মেজাজে গজগজ করতে করতে গিয়ে ঢোকে রান্নাঘরে। একটু মুখে দিয়েও দেখল না। দুপুরে বসে বসে তৈরি করে রাখা ক্ষীর-মিঠাইগুলো সব ফেলে দেয় ডাস্টবিনে। ইতোমধ্যে হঠাৎ ঝট করে নিভে গেলো বিজলিবাতি। চমকে ওঠে মহুয়া। চারদিক ঘন অন্ধকারে ছেয়ে যায়। নির্জন ঘরে মহুয়া দিশা হারিয়ে ফেলে। চোখে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। জানালার কপাটগুলো খুলে দিতেই বাইরের শীতল হাওয়া হু হু করে ঢুকতে থাকে ঘরের ভিতর। তখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বাইরে চারিদিকে জোনাকিরা উড়ছে। জন-মানবশূন্য। একটি প্রাণীও কোথাও নেই। রাস্তার কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে। মাঝে মধ্যে দু-একখানা গাড়ি দ্রুতবেগে পাস করে যাচ্ছে।  

বিব্রতকণ্ঠে বকতে থাকে মহুয়া, ‘ধুর ছাতা, মোমবাতিটা গেলো কোথায়’! 

অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে মোমবাতিটা নিয়ে জ্বালিয়ে দিতেই ড্রইং রুমটা ঈষৎ আলোয় ভরে ওঠে কিন্তু মনের ঘরটা অন্ধকারই রয়ে যায়। যে ঘরের কোণে মহুয়া আজ অত্যন্ত একা, নিঃসঙ্গ। আর সেই একাকীত্বের নিঃসঙ্গতায় ওকে ক্রমশ তলিয়ে নিয়ে যায় এক দুঃস্বপ্নের সাগরে। ইদানিং ওর দৃষ্টিগোচর হয়, জয়ন্তর আমূল পরিবর্তন। অনেক বদলে গেছে। কাজের বাহানায় সারাদিন প্রায় বাইরেই কাটায়। আজকাল নাগালই পাওয়া যায় না ওর। তবু সন্দেহের বীজ কখনও চাড়া দিয়ে ওঠেনি। কিন্তু আজ ওর বিষাদাচ্ছন্ন হৃদয় আকাশের বুক চিরে বারবার অনুতাপ, অনুশোচনার ঝিলিক দিতে লাগল, ভালোলাগার উন্মাদনায় অন্ধের মতো জয়ন্তর প্রেম-আহ্বানে কেন সাড়া দিয়েছিল? কেনই বা ওকে ভালোবেসেছিল! একবারও মনে হলো না, জয়ন্ত আদৌ ওকে ভালোবেসেছিল কিনা। পবিত্র বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ওকে স্ত্রী-রূপে কখনও নেবে কিনা! কখনও স্ত্রীর পূর্ণ মর্যাদা দেবে কিনা! আজ জেনারেল মিটিং, কাল বসের মেয়ের জন্মদিন, পার্টি, পরশু অফিস ষ্টাফদের গেট টুগেদার। এটসেটেরা, এটসেটেরা। একদণ্ডও ফুরসৎ নেই জয়ন্তর। কিন্তু ও যে এভাবে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, তা এতোদিন ঘূণাক্ষরেও টের পায়নি মহুয়া। আজ বিনা নোটিশে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে হঠাৎ রহস্যজনকভাবে জয়ন্তর উধাও হয়ে যাওয়া, মহুয়াকে অ্যাভয়েড করা, বুঝতে কিছুই আর বাকি থাকে না। সবই জয়ন্তর পূর্ব পরিকল্পিত, ষড়যন্ত্র।
 
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ যেনো একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেলো। মহুয়া চিৎকার করে ওঠে, ‘তুমি প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক জয়ন্ত, সবই তোমার ছলনা, ভন্ডামি। মিটিংয়ের দোহাই দিয়ে আমাকে অ্যাভেয়েড করে তোমার পালাবার চেষ্টা। এ আমি কখনও হতে দেবো না। ভুলে যেও না, তুমি বাগদত্তা। কোনোমতেই তা প্রত্যাহার করতে পারো না। কিছুতেই না’!

আবার পরক্ষণেই ভাবে, কিন্তু ওর ভালোবাসা। ভালোবাসার চরম মুহূর্তগুলো। আবেগে আপ্লুত হয়ে মহুয়াকে সজোরে প্রেমালিঙ্গনে বেঁধে নিয়ে ওর চিবুক, শুভ্র ললাটে চুম্বন করা, সবই কি মিথ্যে? সবই কি ওর অভিনয়? এতোদিন শুধু ভালোবাসার নাটক করে এসেছিল জয়ন্ত?

হাজার প্রশ্নের ভিড়ে জর্জরিত হয়ে ওঠে মহুয়া। বড় নিঃসঙ্গ মনে হয় নিজেকে। ক্লান্তি আর অবসন্নতায় ছেয়ে যায় শরীর আর মন। সোজা হয়ে দাঁড়াবারও যেনো শক্তি নেই। হঠাৎ মাথাটা বন্ বন্ করে ঘুরে উঠতেই হাত-পা ছড়িয়ে ধপ্ করে বসে পড়ে সোফায়। উঠে জানালার কপাটগুলো বন্ধ করে দেবে, সেই শক্তিও নেই। ততোক্ষণে বাইরের হিমেল হাওয়ায় শীততাপ নিয়ন্ত্রণে ভরে গিয়েছে সারাঘর। কোনোরকমে কাপড়টা টেনে গায়ে জড়িয়ে সোফাতেই শুয়ে পড়ে মহুয়া।
চলবে...

বাংলাদেশ সময়: ১১০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১৬
এসএনএস

** কুঁড়ি থেকে ফুল | যুথিকা বড়ুয়া (পর্ব-১)


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ