ডিপার্টমেন্ট স্টোরে থাকাকালীন তার মাথায় আসেনি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটবে। অথবা হয়তো সে ভয় পাচ্ছিল যে, ক্যাশিয়ার বুঝে ফেলবে সে নিজেকে খুন করতে যাচ্ছে।
সে কোনো উইল বা বিদায়ী সম্ভাষণ রেখে যায়নি। রান্নাঘরের টেবিলের উপর শুধু একটা গ্লাস, হুইস্কির খালি বোতল আর বরফের বাটিটা ছিলো, আর ছিলো শেভিং ক্রিমের ক্যান দু’টো। সে যতোক্ষণ গোসলের পানি ভরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল, গ্লাসের পর গ্লাস বরফ-ভাসা হেগ পান করছিল, সে নিশ্চয়ই ওই ক্যান দু’টোর দিকে চেয়ে এরকম কিছু ভাবছিল যে, আমাকে আর কোনোদিন শেভ করতে হবে না।
আটাশ বছর বয়সে একজন লোকের মৃত্যু শীতকালীন বৃষ্টির মতোই দুঃখজনক।
**
পরবর্তী বারো মাসের সময়কালে আরও চারজন মারা গেলেন।
একজন মারা গেলো মার্চে সৌদি আরব কী কুয়েতের কোনো এক তেলখনির একটি ঘটনায়, বাকি দু’জন মারা গেলো জুনে- একজনের হলো হার্ট অ্যাটাক আরেকজন সড়ক দুর্ঘটনায়। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত শান্তি বজায়, কিন্তু তারপর ডিসেম্বরে আরেক বন্ধু মারা গেলো, সেও এক গাড়ি অ্যাকসিডেন্টের ঘটনায়।
আমার প্রথম যে বন্ধু নিজেকে খুন করল, এরা তার মতো নয়, এই বন্ধুরা কখনও বোঝার সময়ই পায়নি যে, তারা মারা যাচ্ছে। তাদের জন্য ব্যাপারটা ছিলো অনেকটা কোনো সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মতো যেটা বেয়ে তারা আগেও অজস্রবার উঠেছে এবং হঠাৎ করেই আবিষ্কার করা যে, সিঁড়ির একটি ধাপ নেই।
“আমার জন্য একটু বিছানা ঠিক করে দেবে?” যে বন্ধুটি হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেলো সে তার বউকে জিজ্ঞেস করেছিল। সে ছিলো একজন আসবাবপত্রের নকশাকারী। তখন সকাল এগারটা বাজছিল। সে ঘুম থেকে উঠেছিল সকাল ন’টায়, কিছুক্ষণ নিজের ঘরে কাজ করেছে আর তারপর বলেছিল তার ঘুম ঘুম লাগছে। সে রান্নাঘরে গিয়ে কফি বানিয়ে খেলো। কিন্তু কফিতে কোনো লাভ হলো না। “আমি মনে হচ্ছে একটু ঘুমিয়ে নিই”, সে বলল। “আমার মাথার পিছনে কেমন বিজ বিজ করে একটা শব্দ শুনছি। ”ওগুলোই ছিলো তার শেষ শব্দমালা। সে শরীর কুকড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, ঘুমাতে গেলো, আর কখনও জেগে উঠল না।
ডিসেম্বরে যে বন্ধুটি মারা গেলো সে ছিলো সবচেয়ে কম বয়সী আর একমাত্র নারী। তার বয়স ছিলো চব্বিশ, অনেকটা বিপ্লবী বা রকতারকার মতো। ক্রিসমাসের ঠিক আগে আগে একটি শীতল বর্ষণমুখর রাতে, একটি বিয়ার-ডেলিভারি- ট্রাক আর কংক্রিটের টেলিফোন খাম্বার মধ্যকার বেদনাদায়ক অথচ বেশ সাধারণ স্থানটিতে তাকে পিষে ফেলা হয়েছিল।
**
শেষ শোকসভার কয়েকদিন পর, আমি আমার বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম স্যুটটা ফেরত দিতে, যেটা আমি ড্রাইক্লিনারের দোকান থেকে তুলে নিয়েছিলাম, এবং তাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য এক বোতল হুইস্কি দিতে।
“খুব উপকার হলো। আমি আসলেই কৃতজ্ঞ”, আমি বললাম।
অন্যদিনের মতোই, তার ফ্রিজ ভর্তি ছিলো ঠাণ্ডা বিয়ার আর তার আরামদায়ক সোফাটা থেকে একটা ক্ষীণ সূর্যালোক প্রতিফলিত হচ্ছিল। কফি টেবিলের উপর ছিলো একটা পরিষ্কার ছাইদানী আর এক পট ক্রিসমাস পনসেত্তিয়া (বড়বড় লাল পাতা আর হলুদ ফুল সমৃদ্ধ উষ্ণদেশীয় এক প্রকার গাছ)।
সে আমার কাছ থেকে স্যুটটা নিলো, প্লাস্টিকের কভারসহ, তার চলাফেরার ভেতর আলসেমী – অনেকটা শীতনিদ্রা থেকে উঠে আসা ভাল্লুকের মতো। আর ওটা নীরবে রেখে দিলো।
“আশা করি স্যুটটায় শোকসভার মতো গন্ধ হয়নি”, আমি বললাম
“কাপড়গুলো গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল সমস্যা হচ্ছে ওগুলোর ভিতর কি আছে। ”
“হুম”, আমি বিড়বিড় করলাম।
“তোমার জন্য এই বছর একটার পর একটা শোকসভা”, সে বলল সোফায় আধশোয়া হয়ে গ্লাসে বিয়ার ঢালতে ঢালতে, “সব মিলিয়ে কয়টা?”
“পাঁচটা”, বামহাতের আঙুলগুলো মেলে ধরে আমি বললাম, “তবে আমার ধারণা এর বেশি আর হবে না। ”
“তুমি কি নিশ্চিত?”
“যথেষ্ট লোকজন মারা গেছে। ”
“এটা মনে হয় পিরামিডের অভিশাপ বা ওইরকম কিছু”, সে বলল, “কোথায় জানি এরকম কিছু একটা পড়েছিলাম। অভিশাপটা চলতে থাকে যতোক্ষণ না যথেষ্ট পরিমাণে লোকজন মারা যায়। অথবা একটা লাল তারা আকাশে ওঠে আর চাঁদের ছায়া সূর্যকে ঢেকে ফেলে। ”
ছয়টি বিয়ার শেষ করার পর আমরা হুইস্কিটা শুরু করলাম। শীতের রোদের একটি তির্যক রেখা শান্তভাবে ঘরে পড়ে রইল।
“এই কদিন ধরে তোমাকে বিষণ্ন দেখাচ্ছে”, সে বলল
“তোমার সেরকম মনে হয়?”, আমি বললাম
“তুমি মনে হয় মধ্যরাত পর্যন্ত নানান কিছু নিয়ে অনেক বেশি চিন্তা করো”, সে বলল। “আমি মধ্যরাত পর্যন্ত নানান কিছু নিয়ে চিন্তা করা বাদ দিয়েছি। ”
“এটা তুমি পার কী করে?”
“যখন বিষণ্নবোধ হয়, আমি ঘর পরিষ্কার করতে শুরু করি। রাত তখন দু’টা-তিনটা বাজলেও। আমি বাসন ধুই, চুলা মুছি, মেঝে ঝাড়ু দেই, ডিশ-টাওয়েলগুলো সাবানে ভিজাই, আমার ডেস্কের ড্রয়ারগুলো গোছাই, চোখের সামনের সবকটা শার্ট ইস্ত্রি করি”, আঙুল দিয়ে তার পানীয়টা নাড়তে নাড়তে সে বলল। “আমি এমনটা করি যতোক্ষণ না খুব ক্লান্ত হই, তারপর একটা ড্রিংক খেয়ে শুয়ে পড়ি। আমি সকালে উঠে যতোক্ষণ না মোজা পরছি ততোক্ষণ মনেও করতে পারি না যে কী নিয়ে চিন্তা করছিলাম। ”
আমি চারদিকে তাকালাম। বরাবরের মতো ঘরটা পরিষ্কার এবং গোছানো।
“লোকজন রাত তিনটার সময় নানান বিষয় নিয়ে চিন্তা করে। আমরা সবাই করি। এ কারণে আমাদের প্রত্যেকের এটা মোকাবেলা করার কোনো নিজস্ব পদ্ধতি বের করতে হবে। ”
“মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ”, আমি বললাম।
“এমনকি পশুপাখিরাও রাত তিনটার সময় নানান কিছু নিয়ে চিন্তা করে”, সে বলল, যেনো কিছু একটা তার মনে পড়েছে। “তুমি কি কখনও রাত তিনটার সময় চিড়িয়াখানায় গিয়েছ?”
“না”, আমি অস্পষ্টভাবে উত্তর দিলাম। “নিশ্চয়ই না”।
“আমি এটা একবার করেছি। আমার এক বন্ধু চিড়িয়াখানায় কাজ করে, তাকে বললাম যে যখন তার রাতের শিফ্ট তখন আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিতে। এমনটা করার নিয়ম নেই অবশ্য। ” সে তার গ্লাস ঝাঁকায়। “অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা ছিলো সেটা। আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যে পায়ের নীচের মাটিটা নিঃশব্দে ভেঙে দু’ভাগ হয়ে গেছে আর সেটা বেয়ে কিছু একটা উপরে উঠে আসছে। আর তারপর অদৃশ্য একটা কিছু সমস্ত অন্ধকারজুড়ে ছোটাছুটি করতে শুরু করল। মনে হচ্ছিল শীতল রাতটা জমাট বেঁধে গেছে। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু অনুভব করছিলাম, আর পশুপাখিগুলোও অনুভব করছিল। এর থেকে আমার একটা জিনিষ মনে হলো, যে মাটির উপর আমরা হাঁটি সেটা পৃথিবীর গভীর কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত চলে গেছে আর এই গভীর কেন্দ্রস্থলটা একটা অসামান্য পরিমাণ সময়কে শুষে ফেলেছে। ”
আমি কিছু বললাম না।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, জুলাই ০২, ২০১৭
এসএনএস