ঢাকা: নতুন এক সূর্যের উদয় হয়েছে বাংলাদেশের ফুটবলের আকাশে। দেশের ঘরোয়া ফুটবলে আধিপত্য বিস্তারকারী ঐতিহ্যবাহী ফুটবল ক্লাব আবাহনী, মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধা ও শেখ জামাল ধানমন্ডির মতো জায়ান্ট ক্লাবগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে স্বাধীনতা কাপ ফুটবলের শিরোপা চলে গেছে চট্টগামে! শুধু স্বাধীনতা কাপই নয়, এখন থেকে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলের সব টুর্নামেন্টের ট্রফি চট্টগ্রাম আবাহনীই ঘরে তুলবে বলে এক রকম হুশিয়ারি দিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল ও চট্টগ্রাম আবাহনীর দলপতি মামুনুল ইসলাম।
শনিবার (০৭ মে) বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে স্বাধীনতা কাপ ফুটবলের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে অদম্য ঢাকা আবাহনীকে ২-০ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ঘরোয়া ফুটবলের কোনো শিরোপা জিতেছে ২০০৬ এর পেশাদার ফুটবলে যাত্রা শুরু করা এই দলটি। পেশাদার ফুটবলে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম আবাহনীর এই জয়কে ফুটবলের জন্য শুভ দিক উল্লেখ করে মামুনুল ইসলাম জানান, ‘এটা খুবই ভাল লক্ষন। কারণ বাংলাদেশের ফুটবলে একটা সময় সব শিরোপাই আবাহনী (ঢাকা আবাহনী) ও মোহামেডান ক্লাবের মধ্যেই থাকতো। ২০০৫ এর আগে তারাই চ্যাম্পিয়ন হতো। তবে ২০০৫ সালে ব্রাদার্স চ্যাম্পিয়ন হলে বাংলাদেশের ফুটবলে চ্যাম্পিয়নশিপের এই পুরোনো সংস্কৃতি ভাঙে। এরপর আবার ২০০৭, ২০০৮ ও ২০০৯ এ চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা আবাহনী। তারপর ২০১০-এ এসে নতুন চ্যাম্পিয়ন শেখ জামালকে পেলো ঘরোয়া ফুটবল। শেখ জামাল ছাড়াও শেখ রাসেল, মুক্তিযোদ্ধার শিরোপা জয়ের মিশন চললো। এবার জিতলো চট্টগ্রাম। বিষয়টি খুবই ভালো। ’
তবে যে বিষয়টি চট্টগ্রাম অধিনায়ক মামুনুলকে অভিভূত করেছে সেটি হলো, গেল বছর রেলিগেশনে থাকা এই চট্টগ্রাম আবাহনী এক বছরেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে! অদম্য পারফরমেন্স দিয়ে এক রকম ছিনিয়ে নিয়েছে স্বাধীনতা কাপের শিরোপা। আর এই বিষয়টি শুধু নিজ ক্লাব চট্টগ্রামের জন্যই নয় বরং দেশের ফুটবলের জন্য ইতিবাচক বলেও বিশ্বাস করেন এই চট্টলা অধিনায়ক। তিনি জানান, ‘চট্টগ্রাম আবাহনী গত বছরের রেলিগেশন কাটিয়ে এবার চ্যাম্পিয়ন হলো। এটা ফুটবলের জন্য খুবই ভালো। কারও উপর নির্ভর না করে তারাই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। দলটির জন্য গর্বের বিষয় যে ঢাকার ফেভারিট দলগুলো থাকতেও তারাই প্রথমবারের মত চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে। ’
তবে, স্বাধীনতা কাপ ফুটবলের এবারের আসরের মাঠের পারফরমেন্সে দেশি ফুটবলারদের চেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন বিদেশিরা। ঢাকা আবাহনীর সানডে সিজোবা, চট্টগ্রাম আবাহনীর লিওনেল প্রুইক্স, শেখ জামালের এমেকা ডার্লিংটন ও শেখ রাসেলের ফিকরু তেফেরা’র পারফরমেন্স এদেশের দর্শকদের পাশাপাশি রীতিমতো মুগ্ধ করেছে লাল-সবুজের অধিনায়ককেও। তাইতো বিদেশি খেলোয়াড়দের প্রশংসা করে মামুনুল বললেন, ‘বিদেশি খেলোয়াড়দের সংগ্রহ ভাল হওয়া উচিত যা দেখে আমরা শিখতে পারি। এদের পারফরমেন্স সবাইকেই মুগ্ধ করেছে। সত্যি কথা বলতে আমরা তাদের থেকে অনেক কিছুই শিখতে পেরেছি। ’
চট্টগ্রাম আবাহনী মাঠের পারফরমেন্স দিয়েই শিরোপা জিতেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো স্বাধীনতা কাপ ফুটবলের এবারের টুর্নামেন্টে মাঠের পারফরমেন্সেই চট্টগ্রামের চেয়ে অনেক বেশি দ্যুতি ছড়ায ঢাকা আবাহনী। জয়ের মানদণ্ডে বিচার করলে চট্টগ্রাম আবাহনী ৫ ম্যাচের তিনটিতে জয় পায়। আর ঢাকা আবাহনী দুটিতে জয় পেলেও সেমি-ফাইনালের ম্যাচে শেখ জামালকে ৬-০ গোলে গুঁড়িয়ে দেয়। যেখানে চট্টগ্রাম আবাহনী শেখ রাসেলের বিপক্ষে জিতেছে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলের ব্যবধানে।
শেষ চারে এমন বিষ্ফোরক পারফরমেন্সের পর ফাইনালে ঢাকা আবাহনীর একটি গোলেরও দেখা না পাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়েছিল মামুনুলকে। উত্তরে তিনি জানান, ‘যখন ঢাকা ও চট্টগাম আবাহনী ফাইনালে উঠেছে তখনই বলেছি ঢাকা আবাহনী সবদিক দিয়ে এগিয়ে। আসলে চ্যাম্পিয়নশিপটা ছিল ফিফটি-ফিফটি ম্যাচ। ফাইনালের মঞ্চে যে দল সেরা পারফর্ম করতে পারবে তারাই এগিয়ে যাবে। খেলায় দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। কিন্তু চট্টগাম আবাহনী যে কাজটা করছে সেটা হলো তারা গোল করতে পেরেছে। ঢাকা আবাহনী খুবই ব্যালেন্সড টিম। তাদের দেশি থেকে শুরু করে বিদেশি প্লেয়ার সবাই খুবই ভালো। তবে, ফাইনালে তারা গোল করতে পারেনি, যেটা আমরা করেছি। ’
এদিন কী এমন ঘটনা ঘটেছিল যে চট্টগ্রাম শিবির ঢাকা’কে জালেই বল জড়াতে দেয় নি? সেই রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে মামুনুল বললেন, ‘আমাদের টিমের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান মাঠের থেকে মাঠের বাইরে। ম্যানেজমেন্টের সাথে বন্ধুপ্রতীম সম্পর্ক, টিম স্পিরিট ও ম্যানেজমেন্টের সমর্থন। মনে রাখবেন ম্যানেজমেন্টের ভালো সমর্থন থাকলেই কেবল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। আর সেই মানসিকতা নিয়ে খেলতে পারলে একটি দল চ্যাম্পিয়ন হবেই। ’
স্বাধীনতা কাপের এবারের আসরে চট্টগ্রাম আবাহনীর যে বিষয়টি উল্লেখ করার মতো সেটি হলো, নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকায় পুরো টুর্নামেন্টে খেলতে পারেননি অধিনায়ক মামুনুল, জাহিদ, সোহেল রানা, গোলরক্ষক সোহেল ও মো: ইয়াসিন। পুরো টুর্নামেন্টেই তারা ছিলেন দর্শক হয়ে। দলের এমন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়রা নেই তারপরেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে অদম্য এই দলটি। যা একরকম অভিভূত করেছে মামুনুলকে, ‘আমাদের পাঁচজনকে ছাড়াই দল মাঠে নেমেছে, এটা ফুটবলের জন্য সব চেয়ে বেশি ইতিবাচক। টিম স্পিরিটই এদিন আমাদের এগিয়ে রেখেছে। আমাদের বিশ্বাস ছিল যে ভাল পারফর্ম করতে পারলে আমরা জিতবো। ’
দলের এই পাঁচ গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ার ছাড়া শিরোপা জেতায় দলটির প্রতি দর্শকের প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেছে। ফলে দর্শকদের প্রত্যাশার দিকটি মাথায় রেখে হলেও আগামী দিনগুলোতে আরও ভাল পারফর্ম করতে হবে বলে মত দিলেন মামুনুল, ‘স্বাধীনতা কাপ শিরোপা জয় দিয়ে সব কিছু বিচার করা যাবে না। সামনে আমাদের এর থেকেও ভাল পারফর্ম করতে হবে। মাসসিক ভাবে আমাদের আরও শক্ত হতে হবে। এই ট্রফি জেতাটা আমাদের জন্য একরকম চাপই হয়ে রইলো। কেননা ভক্ত-সমর্থকদের প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়ায় পরবর্তী টুর্নামেন্টে জেতা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো। ’
নিষেধাজ্ঞা থাকায় টুর্নামেন্টে খেলতে পারেননি মামুনুল। তবে তাতে তার কোন আফসোস নেই। দলের জয়ই তাকে নিষেধাজ্ঞায় থাকার যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছে, ‘গত ৪ বছর যাবৎ আমি শেখ জামাল, শেখ রাসেল, মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের হয়ে টানা ফাইনালে খেলেছি। আমি দলে থেকেছি, না থেকেছি সেটা বড় কোনো বিষয় না। বিষয় হলো আমার দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আমি না খেলেও চ্যাম্পিয়ন টিমের সদস্য। আমরা বাইরে থেকে সমর্থন যুগিয়েছি। এটা সত্যের ও ফুটবলের জয়। আমি খুবই খুশি। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, ০৮ মে ২০১৬
এইচএল/এমআর