ঢাকা: ঢাকার সড়কে পড়ে কাতরাচ্ছিলেন এক নারী। মানবিক তাড়না থেকে তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে আসেন সুফিয়া আক্তার।
মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) হাসপাতালেই বাংলানিউজের কাছে আক্ষেপ প্রকাশ করছিলেন সুফিয়া। তিনি জানান, গত রোববার (১ ডিসেম্বর) উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর এলাকায় কুমিল্লা স্টোর নামে একটি দোকানের পাশের সড়কে আনুমানিক ৩৫ বছরের ওই ভবঘুরে নারী পড়েছিলেন। তার শরীরে ছিল প্রচণ্ড ময়লাযুক্ত জামা-কাপড়। শরীর থেকে বের হচ্ছিল অস্বাভাবিক দুর্গন্ধ। এছাড়া তার ডান পায়ের গোড়ালি থেকে পাতা পর্যন্ত মাংসে এতটাই পচন ছিল যে হাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল, পাশাপাশি সেই ক্ষত জায়গায় পোকা কিলবিল করছিল। জীবন্ত মানুষ, হাত পা নাড়াচাড়া করে উঠে বসেছেন, কিন্তু হাঁটাচলা করতে পারছেন না।
“মনে হচ্ছিল বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘আমি মরি নাই। আমাকে তোমরা বাঁচাও, আমার চিকিৎসা করাও। ’ ভবঘুরের ওই নারীর করুণ অবস্থা দেখে এক পর্যায়ে তার চিকিৎসার উদ্যোগ নেই, সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় বাসিন্দা জাফর আহমেদ। ”
সুফিয়া বলেন, ওই নারীর চিকিৎসার জন্য স্থানীয় দোকানদাররা ৯৯৯-এ কল দেন। সংবাদ পেয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই মো. মনির হাসান ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তখন পুলিশের অনুমতি নিয়ে সুফিয়াকে উদ্ধার করে বাসার সামনে নিয়ে যাই। সেখানে গিয়ে তাকে গোসল করানোর পাশাপাশি পা কিছুটা পরিষ্কার করা হয়। পরে তাকে কাপড় পরিয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেই হাসপাতালে নারীর এই অবস্থা দেখে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক হাসপাতালে নিতে বলেন চিকিৎসক। পরে জাফর আহমেদের তত্ত্বাবধানে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসি।
তিনি জানান, ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে টিকিট ক্রয় করতে গেলে কাউন্টার থেকে নাম জানতে চাওয়া হয়। নাম জানেন না বললে সুফিয়াকে টিকিট মাস্টার বলেন, ‘আপনার পরিচিত কেউ না, রোগীর নামও জানেন না। তাহলে কেন তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসলেন। ’ উত্তরে সুফিয়া বলেন, ‘ভবঘুরে ওই নারী বিড়বিড় করে অনেক কথাই বলেন, কিন্তু কিছুই বোঝা যায় না, তাই নামটা জানতে পারেনি। এছাড়া অসহায় নারী দেখে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসছি। ’ এতে টিকিট কাউন্টার থেকে ক্ষেপে গিয়ে বলা হয়, ‘তাহলে এই রোগীকে কেন নিয়ে আসছেন। যে কথা বলতে পারে না, নাম বলতে পারে না। ’
এক পর্যায়ে টিকিট কাউন্টার থেকে ওই নারীর নাম ‘সুমি’ উল্লেখ করে চিকিৎসাপত্র দেওয়া হয়। তারপর মেডিকেল অফিসারের নির্দেশক্রমে তাকে ট্রলির চালকরা সার্জারি ওয়ার্ডে নিয়ে যান। সেখানে নেওয়ার পর ওয়ার্ডের লোকজনের জেরার মুখেও পড়তে হয় সুফিয়াকে। তারা বলতে থাকেন, ‘কী হয় আপনাদের রোগী, এই রোগীকে তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়ে আসার কথা, আপনারা কেন নিয়ে আসছেন। দায়ভার তো আপনাকেই নিতে হবে। যদি রোগী মারা যায় আপনি তো ফেঁসে যাবেন। ’
সুফিয়া বলেন, আমি চিকিৎসার হাল ছাড়িনি। আজ (মঙ্গলবার) তিন দিন হতে চললো, ভবঘুরে রোগাক্রান্ত ওই নারীর চিকিৎসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
“চিকিৎসক ও অন্যরা বলতে থাকেন, ‘এই নারীর পা পোচে গেছে, তার দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা করাতে হবে। যদি অস্ত্রোপাচরের সময় তার পা কেটে ফেলতে হয়, পরে তার পরিবার যদি হাসপাতালে হাজির হয়ে প্রশ্ন করে—তার পা কেন কেটে ফেলা হয়েছে? তখন এর জবাব কে দেবে?’ এক পর্যায়ে ওয়ার্ড থেকে সুফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, ‘রোগীর দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। হাসপাতালের কাগজে আপনাকেই সই দিতে হবে’। ”
এত দৌড়ঝাপ আর শঙ্কার কথা সত্ত্বেও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পারায় আজ মঙ্গলবার আবারও জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসারের শরণাপন্ন হন সুফিয়া। সেখানকার পরামর্শে আবার নতুন করে রোগীর জন্য টিকিট কেটে হাসপাতালে পুরাতন ভবনের দ্বিতীয় তলায় ২২০ নাম্বার ওয়ার্ডের সার্জারিতে নেন। সেই ওয়ার্ড থেকে বলা হয়, সুফিয়ার জাতীয় পরিচয়পত্র না দিলে রোগীকে ভর্তি করা হবে না। পরিচালকের নির্দেশ লাগবে।
সুফিয়াবলেন, এর আগে বলেছিল থানায় গিয়ে জিডি করতে হবে। সেই অনুযায়ী জাফর সাহেব থানায় গিয়ে জিডি করেছেন, জিডির কপিও জমা দিয়েছি। এখন বলে আমার জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে।
হতাশ হয়ে তিনি বলেন, একজন নারীকে এভাবে সড়কে পড়ে থাকতে দেখে আমি আর থাকতে পারিনি। তখন সেখানে অনেক লোক জড়ো হয়েছিল। সেই লোকের মধ্যে জাফর নামে একজন আমাকে সহযোগিতা করেছে। রোগীকে হাসপাতালে আনার পরে টানা এই তিন দিন হাসপাতালে লোকজনের কাছ থেকে কোনো ভালো ব্যবহার পাইনি। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে দুর্ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি।
“এখন মনে হচ্ছে, পরিচয়বিহীন রোগীকে কেন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসলাম। এই কারণে তারা ইচ্ছে করেই আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে। সরাসরি না বললেও তাদের ব্যবহারে এটাই বুঝানো হচ্ছে আপনি ভবঘুরে রোগীকে নিয়ে এসেছেন মানে নিজের গলায় নিজেই ফাঁসির দড়ি পড়েছেন। ’
সুফিয়া জানান, তিনি হাসপাতালে পুলিশের কাছেও গেছেন। তারা তাকে বলেছে, এটা হাসপাতালে চিকিৎসক আর সুফিয়ার ব্যাপার। রোগী বর্তমানে হাসপাতালের দ্বিতীয়তলার বারান্দায় আছেন।
হাসপাতালের এক কর্মকর্তা ঘটনার বিবরণ শুনে বাংলানিউজকে বলেন, এটি একটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ও দুঃখজনক ঘটনা। এ ধরনের আচরণ শুধু অসহায় রোগীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধেরও চরম অভাবের চিত্র তুলে ধরে।
উত্তরা পশ্চিম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মনির হাসান বলেন, হাসপাতাল থেকে এই রোগীর বিষয়ে একটি জিডির কথা বলা হয়। ভবঘুরে নারীর চিকিৎসার সুবিধার্থে জাফর আহমেদ নামে সেই ব্যক্তি থানায় একটি জিডিও করেছেন। ওই রোগী বর্তমানে ঢামেক হাসপাতালে আছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২২১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০২৪
এজেডএস/এইচএ/