কুড়িগ্রাম: হাসপাতালে পাওয়া যায় না প্রয়োজনীয় ঔষধ, কেনুলাও পর্যন্ত কিনতে হয় বাইরে থেকে। মেকানিক পোস্টে কর্মরত দিয়েও চলে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের কাজ! ১০ বছর আগে অপারেশন থিয়েটার তৈরি হলেও লোকবলের অভাবে ব্যবহার হয়নি একদিনও।
এভাবেই মাত্র ২ জন চিকিৎসক নিয়ে ধুঁকছে কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে এসে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে রোগী ও স্বজনেরা।
সেবাখাতে এমন করুণ দশা হলেও সরকারি এই হাসপাতালটি গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয়রা ছাড়াও স্থলপথে যোগাযোগ থাকায় এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসেন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ডাঙ্গধরা, চর আমখাওয়া,রামরামপুর ইউনিয়ন, গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার মোল্লারচর ইউনিয়ন, চিলমারীর উপজেলার অষ্টমমীরচর, রৌমারীর উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের রোগীরা।
হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার পরিস্থিতি জানতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টায় সরেজমিনে দেখা গেল, মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্ট করা ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন বাবা। ডাক্তার নেই হাসপাতালে, স্যাকমো কিংবা সংশ্লিষ্ট কেউ-ই নেই। রোগীর স্বজন খোঁজাখুঁজি করছেন একজন মেকানিককে, তিনিও নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বেশিরভাগ সময় মেকানিকই ইমার্জেন্সিতে দায়িত্ব পালন করেন। চিকিৎসক, স্যাকমোর অনুপস্থিতিতে হাসপাতালের জেনারেটরের দেখভালের দায়িত্বে থাকা লোকটিই ডাক্তারির দায়িত্ব পালন করেন।
আরও জানা গেছে, ১০ বছর আগে এই হাসপাতালের নতুন ভবনে অপারেশন থিয়েটার তৈরি হলেও লোকবলের অভাবে অপারেশনের কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। প্রসূতি অর্ডারের আধুনিক মেশিনপত্র থাকলেও তা ব্যবহার হচ্ছে না। ফটোথেরাপি মেশিন, ইনফিউশন পাম্প, ইনফ্যান্ট রেডিয়েন্ট ওয়ার্মার, বেবি ওয়ার্মার, অক্সিজেন সিলিন্ডার, কেনুলা মেশিনগুলো পরে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এখানে ভর্তি হয়ে সেবা নিতে আসা রোগী মুক্তা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, তিনদিন হলো চিকিৎসা নিতে এখানে এসেছি। আমার বাড়ি বড়ইডাঙ্গি। আমি অন্তঃসত্ত্বা, প্রস্রাবের ইনফেকশন আছে। এটা একটা সরকারি হাসপাতাল কিন্তু স্যালাইন পর্যন্ত টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এখানে এতো দুর্গন্ধ যে, আরও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই, বাথরুমে যাওয়াই যায় না।
মোমেনা বেগম তার সন্তানকে ৭ দিন ধরে এখানে চিকিৎসা করাচ্ছেন। নিউমোনিয়া হয়েছে তার সন্তানের, শরীরে রক্ত কম। এখানে সন্তানকে চিকিৎসা করাতে এসে অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমার বাচ্চাকে ওনারা বলেছেন ময়মনসিংহ পপুলারে ভর্তি করাতে। সেখানে গিয়েছিলাম ১২ হাজার টাকা খরচ করে টেস্ট করিয়েছি। আবার এই হাসপাতালে ৭ দিন ধরে আছি, চিকিৎসাসেবা পাচ্ছি না বললেই চলে।
নাতনিকে নিয়ে একদিন আগে মো. আমিনুল ইসলাম এসেছেন চিকিৎসা নিতে। অন্তঃসত্ত্বা নাতনির বাচ্চা পেটেই নষ্ট হয়েছে। তিনি বাংলানিউজকে জানান, এখানে ভবন আছে, মেশিন আছে, কিন্তু লোকজন নেই। অপারেশন থিয়েটার আছে কিন্তু অপারেশন হয় না, একটা ছোট টেস্ট করতে গেলে বাইরে গিয়ে করাতে হয়। এখানে ডাক্তার দরকার এবং প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে।
চিকিৎসক ও জনবলের অভাবে হাসপাতালের সেবাখাতের এমন করুণ দশা বলে জানালেন রাজিবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডা. মোহা. সারোয়ার জাহান।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের এখানে ২৪ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও মাত্র দুইজন দিয়ে সেবা চালিয়ে যাচ্ছি। এখানে আমাদের পরিচ্ছন্নতাকর্মী সিনিয়র স্টাফ নার্সসহ অন্যান্য কর্মচারীর যথেষ্ট অভাব। আমরা এত সংকটের মধ্যেও সেবা চালিয়ে যাচ্ছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবার চাহিদা দিয়েছি, যাতে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারি।
মাসের বেশিরভাগ সময় কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মোহা. সারোয়ার জাহান বলেন, যখন আমার ট্রেনিং থাকে কুড়িগ্রাম বা ঢাকায় তখন আমাকে সেখানে যেতেই হয়। আমি স্টেশন লিভ নিলে অন্তত কর্তৃপক্ষ সিভিল সার্জনকে বলে ছুটি নিই।
ইমার্জেন্সিতে মেকানিক দিয়ে চিকিৎসা চলে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে ডাক্তার এবং স্যাকমো দিয়ে ইমার্জেন্সি চলে। তবে যদি অথরাইজড পারসোনের বাইরে কেউ এ ধরনের কাজ করে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৪ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০২৫
এসএএইচ