খুলনা: খুলনা জেনারেল হাসপাতালে স্বাস্থ্য সেবার নামে চলছে সরকারি অর্থের অপচয়। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসকদের পরিবর্তে চিকিৎসা দেন পিয়ন, ওয়ার্ডবয় এমনকি ঝাড়ুদাররা পর্যন্ত!
একদিকে রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অন্যদিকে ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে অবৈধ লেনদেন ও জমজমাট সার্টিফিকেট বাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
পিয়ন, ওয়ার্ডবয় ও ঝাড়ুদাররা ব্যান্ডেজ, সেলাইসহ বিভিন্ন অস্ত্রোপচারও করছেন বলে জরুরি বিভাগের রোগীরা অভিযোগ করেছেন। এমনকি মাঝে-মধ্যে তাদের অপচিকিৎসায় রোগীর অবস্থা জটিল হয়ে পড়ে। এর দায় এড়াতে উন্নত চিকিৎসার নামে তাড়াহুড়ো করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বললে তারা বাংলানিউজকে জানান, সব অনিয়মই এ হাসপাতালে নিয়মে পরিণত হয়েছে।
হাসপাতালে ভর্তি আব্দুল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, সোমবার সকালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসার পর ব্যান্ডেজসহ সব কাজ করেছেন এখানকার পিয়ন ও ওয়ার্ডবয়রা। যদিও এসবের পর ডাক্তার এসেছেন।
ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া এম রহমান নামের এক রোগী বাংলানিউজকে জানান, ওয়ার্ডের সিট পেতে ভিআইপিদের ফোন লাগে। রাতে চিকিৎসক পাওয়া যায় না। যার কারণে নার্স ও আয়ারা অনেক সময় জরুরি চিকিৎসা করে থাকেন।
তিনি আরও জানান, সময় মতো চিকিৎসকরা হাসপাতালে আসেন না।
রক্ত পরীক্ষা করতে আসা ষাটোর্ধ্ব নুরজাহান বেগম বাংলানিউজকে জানান, প্যাথলজি বিভাগের দায়িত্বে থাকা প্রকাশ কসাইয়ের মতো ব্যবহার করেন। তার কোনো দয়া-মায়া নাই।
প্রকাশের বিরুদ্ধে এ অভিযোগের সত্যতা মিলেছে খোদ হাসপাতালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আয়ার সঙ্গে কথা বলে।
তিনি বাংলানিউজকে জানান, প্রকাশের ব্যবহার খুব রুক্ষ। এছাড়া তিনি কাজ বাদ দিয়ে নার্সদের সঙ্গে অধিকাংশ সময় খোশ গল্পে মেতে থাকেন।
মহিলা বহিরাগমণ বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রুনা বেগম বাংলানিউজকে জানান, এ বিভাগের ৯নং রুমে মহিলা সার্জারি, ১০নং রুমে মহিলা মেডিসিন, ১১নং রুমে গাইনি ও ১২নং রুমে মহিলা কন্সালটেন্ট বসেন। গুরুত্বপূর্ণ এ চারটি বিভাগে মাত্র চার জন চিকিৎসকের বিপরীতে প্রতিদিন এক হাজারের অধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এ চারটি বিভাগ এক জায়গায় এবং একটি ওয়েটিং রুম হওয়ায় বসাতো দূরের কথা দাঁড়ানোর জায়গাই থাকে না।
সালমা নামের এক রোগীর আত্মীয় বাংলানিউজকে জানান, নার্সদের সঙ্গে কোনো বিষয়ে একবারের বেশি দুইবার কথা বলা যায় না। ডাকলেও তারা আসেন না। অধিকাংশ সময় মোবাইলে কথা বলায় ব্যস্ত থাকেন।
চিকিৎসা নিতে আসা বহিরাগমণ বিভাগের রোগী আশি ঊর্ধ্ব আফসার আলী বাংলানিউজকে বলেন, “বুড়া মানুষের কথা এহানে হোনার কেউ নাই। সবাই যার যার কামে ব্যস্ত। অনেক কষ্ট কইরা সিলিপ পাইছি। কিন্তু ডাক্তার দেহানোর পর ফ্রি ওষুধ পাই নাই। ’’
তিনি আক্ষেপ করে জানান, এখানকার আগের ডাক্তাররা ভালো ছিলেন, ফ্রি ওষুধ দিতেন।
প্রায় সব রোগীরই অভিযোগ, হাসপাতালে সরকারিভাবে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার যথেষ্ঠ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট কিছু ডাক্তার নিজেদের বাড়তি উপার্জনের লোভে ভর্তি রোগীসহ বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য রোগীদের প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। অজুহাত হিসেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সরঞ্জাম নষ্ট দেখাচ্ছেন।
সোমবার সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতাল সংলগ্ন সিভিল সার্জনের কক্ষ ছাড়া সর্বত্র দুর্গন্ধ আর নোংরা পরিবেশ। হাসপাতালের ভেতরে বিক্রি হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর খাবার। বসেছে ভ্রাম্যমাণ হকারও। বাথরুমের মেঝে ও টয়লেট অপরিষ্কার। হাসপাতালজুড়ে ঘোরাফেরা করছে বিড়াল আর কুকুর। বিছানা আর টেবিলের ওপর অবাধেই ঘুরে বেড়াচ্ছে তেলাপোকা। জরুরি বিভাগের মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, গজ, ব্যান্ডেজ পড়ে আছে যত্রতত্র।
সকাল ১১টা পর্যন্ত অনেক বিভাগের দরজায় তালা ঝুলছে। অফিস রুম খোলা থাকলেও কর্মকর্তার উপস্থিতি কম।
খোদ সিভিল সার্জন অফিসের অফিস সহকারী মনিরুল ওরফে মনির বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের অভিযোগ। জানা গেছে, কর্মরত ডাক্তারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতি মাসে তিনি ও কিছু অসাধু ডাক্তার হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। একেকটি মিথ্যা সার্টিফিকেট দিয়ে ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
আর এক শ্রেণীর লোক এখান থেকে মিথ্যা সার্টিফিকেট নিয়ে নিরীহ লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা করে হয়রানি করে থাকেন। ভুয়া ও মিথ্যা সার্টিফিকেট ব্যবসার কারণে মিথ্যা মামলার সংখ্যাও জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। যদিও মনিরুল ওরফে মনির সঙ্গে সরাসরি দেখা করলে তিনি বাংলানিউজের কথা শুনে অভিযোগ অস্বীকার করে আপ্যায়ন ও ম্যানেজের চেষ্টা করেন।
খুলনা জর্জকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট ড. মো. জাকির হোসেন বাংলানিউজকে জানান, এ হাসপাতালে অনিয়মই নিয়ম হয়ে গেছে। রোগীদের সেবা পাওয়া যেন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কঠোর নজরদারি কামনা করেন।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান বাংলানিউজকে বলেন, “খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের চিকিৎসা সেবায় খুলনা জেনারেল হাসপাতাল কাঙ্খিত সেবা দিতে পারছে না। নানা সঙ্কট ও অব্যবস্থাপনার কারণে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন চিকিৎসা সেবা থেকে। ”
তিনি দ্রুত যেন এ হাসপাতালটির আধুনিকায়নসহ সকল অব্যবস্থাপনা দূর করে রোগীদের কাঙ্খিত সেবা পেতে পারে সে ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
একটি বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসকসহ নানা সংকটে ধুঁকছে খুলনা জেনারেল হাসপাতাল। ফলে দিন দিন এ হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কমছে। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। কাঙ্খিত চিকিৎসা সেবা না পেয়ে রোগীরা জেনারেল হাসপাতাল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
হাসপাতাল সূত্র বাংলানিউজকে জানায়, ১৫০ শয্যার খুলনা জেনারেল হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ প্রথম শ্রেণীর পদ রয়েছে মাত্র ৩৪টি। এর মধ্যে ৪টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য।
হাসপাতালে চিকিৎসকের মতো চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকটও প্রকট। ইএনটি, ডেন্টাল, সার্জারি ও গাইনি বিভাগে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতালটিতে জীবন রক্ষাকারী মূল্যবান ওষুধ রাখার জন্য নেই কোনো নির্দিষ্ট স্টোর রুম। সে কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ওষুধ সংরক্ষণ করতে হচ্ছে একটি পরিত্যক্ত ও জরাজীর্ণ ভবনে। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ওষুধের গুণগতমান মেয়াদোত্তীর্ণের আগেই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
খুলনা সিভিল সার্জন ডা. গোলাম মোর্তুজা শিকদার এসব সমস্যার কথা স্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেন, “আল্টাসোনোগ্রাম ও ইসিজি মেশিনসহ পর্যাপ্ত জনবল ও যন্ত্রপাতি সংকট রয়েছে এ হাসপাতালে। যার কারণে ইচ্ছা থাকলেও আমরা সব সময় রোগীদের কাঙ্খিত প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছি না। ”
জনবল ও যন্ত্রপাতির ব্যবস্থার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট দফতরে বিষয়টি জানিয়েছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ সময় : ১২২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৩
সম্পাদনা: আবু হাসান শাহীন, নিউজরুম এডিটর ও অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর-
eic@banglanews24.com