রমজানের ইফতারিতে যেখানে খাওয়া দরকার সহজপাচ্য খাবার, সেখানে আমরা খাই মুখরোচক বলে গুরুপাক সব সামগ্রী, যার মধ্যে তেলেভাজা খাবারই প্রধান। এ কারণে অধিকাংশ মানুষই বদহজমে ভোগেন।
ইফতারিতে তাই আসুন তেল-ঘি কম ব্যবহার করি।
আমাদের দেশে রান্নার ধরনের কারণে তেলের ব্যবহার বেশি। সুস্বাদু রান্নায় তেলের যে আধিক্য থাকে তা চোখে পড়ার মতো। কিন্তু অতিরিক্ত তেল শরীরে গিয়ে বিপত্তি ঘটায়। ফলে রক্তের কোলেস্টেরল বাড়ে, বিশেষ করে ক্ষতিকর এলডিএল। হৃদরোগ সৃষ্টিতে বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ এই এলডিএল। আমাদের রান্নাতে তাই তেলের, এবং সেই অর্থে ঘিয়ের ব্যবহার কমানো প্রয়োজন। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে তেল-ঘি যত পরিহার করা যায়, হৃদরোগের ভয়ও ততই কমতে থাকে।
বাড়িতে যে তেল ব্যবহৃত হয় তা সাধারণত পুরনো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু বাড়ির বাইরের রান্নায় যে তেল-ঘি ব্যবহার করা হয় তা আরো ক্ষতিকর। হোটেল-রেস্টুরেন্টে, অলিগলিতে ইফতারি উপলক্ষে ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, পুরি, চপ, জিলাপি, সিঙ্গারা, সমুচা ইত্যাদি ভাজা হয় যে তেলে তা পুরনো। অর্থাৎ দিনের পর দিন একই তেলে এগুলো ভাজা হয়, ভাজা শেষে তেলটুকু রেখে দেওয়া হয় পরের দিনের জন্য, তেল কমে গেলে তাতে কিছু নতুন তেল যোগ করা হয় এবং এভাবেই চলতে থাকে।
এই তেল দিনের পর দিন উচ্চ তাপমাত্রায় থেকে পারঅক্সাইড ও ট্রান্সফ্যাটে রূপান্তরিত হয়। খাবারের সঙ্গে এগুলো খাওয়ার কারণে শরীরে অতিরিক্ত মাত্রায় কোলেস্টেরল তৈরি হয়। অনেক লিক্লিকে স্বাস্থ্যের মানুষেরও রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি। এর বিভিন্ন কারণ আছে। তবে অন্যতম একটি কারণ এই পারঅক্সাইড ও ট্রান্সফ্যাট খাওয়া।
এছাড়াও এই তেল বদ্হজম ও পেটের অন্যান্য গোলযোগ সৃষ্টিতে অদ্বিতীয়। এই তেল লিভারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নষ্ট করে দেয়।
এছাড়া তেলে দেওয়া হয় ভেজাল। সরিষার তেলে থাকে সয়াবিন বা পাম তেলের ভেজাল। সয়াবিন তেলের সঙ্গে পাম তেলের ভেজাল একটি সাধারণ বিষয়। পাম তেল দু’রকম। খাবার উপযোগী পাম তেল আর সাবান তৈরির পাম তেল, যাকে বলে পাম স্টিয়ারিন। পাম স্টিয়ারিনের দাম কম, কিন্তু মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই পাম স্টিয়ারিন দিয়ে ভেজাল দেওয়ার কারণে বাজারে বিক্রিত অধিকাংশ সরিষা, সয়াবিন ও পাম তেল স্বাস্থ্যহানিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরিষার তেলের ভেজাল এখন তো প্রায় শিল্পের পর্যায়ে চলে এসেছে। কৃত্রিম রঙ ও কৃত্রিম সুগন্ধ মিশিয়ে নানা রকম তেলকে সরিষার তেল বানানো হয়। সরিষার ঝাঁজর জন্য ব্যবহার করা হয় ইরুসিক এসিড এবং এলাইল আইসোথায়োসায়ানেট। কখনো কখনো এগুলো পরিমাণে এতো বেশি মেশানো হয় যে, স্বাভাবিক সরিষার তেলের চাইতেও নকল সরিষার তেলের ঝাঁজ হয়ে থাকে অনেক বেশি।
দৈনিক ইনকিলাব-এর ৬ জুলাই ২০০৭ সংখ্যা থেকে জানতে পারি যে, বাজারে যেসব সরিষার তেল পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর শতকরা ৮৪ ভাগেই ভেজাল দেওয়া হচ্ছে। ইউনভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের (ইউডা) প্রাণিবিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর মোঃ রহমতুল্লাহর বরাত দিয়ে পত্রিকাটি এই তথ্য জানিয়েছে। তিনি সরিষার তেলে টেক্সটাইল কালার থাকার প্রমাণও পেয়েছেন।
তার মতে, প্রাকৃতিকভাবে সরিষার তেলে সামান্য পরিমাণ ইরুসিক এসিড এবং এলাইল আইসোথায়োসায়ানেট থাকে। তবে তা ক্ষতিকর নয়, কারণ রান্নার সময় এগুলো নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু ভেজাল হিসাবে দেওয়া ইরুসিক এসিড এবং এলাইল আইসোথায়োসায়ানেট মারাত্মক ক্ষতিকর। এখন তেলে ভেজালের অবস্থা কী তা জানা নেই। তবে অন্যান্য ভেজালের মতো এর ভেজালও নিশ্চয়ই বেড়েছে।
নকল সরিষার তেল তৈরিতে বা সরিষার তেলে ভেজাল হিসাবে মেশানো ইরুসিক এসিড নিয়ে গবেষণা করে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা স্বাস্থ্যহানিকর ফলাফল পেয়েছেন। চিলিতে ইঁদুরের ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, অতিরিক্ত ইরুসিক এসিডের কারণে গর্ভবতী ইঁদুরের লিভার নষ্ট হয়ে গেছে। জার্মানির একদল গবেষক অতিরিক্ত ইরুসিক এসিড প্রয়োগ করে দেখেছেন- এতে ইঁদুরের হৃদপিণ্ডে চর্বি জমা হচ্ছে ও হৃদকোষগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া হৃদপিন্ডের রক্ত সঞ্চালন ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আমেরিকায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, এই এসিড ইঁদুরের হৃদপিণ্ডে ক্ষতের সৃষ্টি করছে। এছাড়া অতিরিক্ত এলাইল আইসোথায়োসায়ানেট চোখ ও ফুসফুসেরও ক্ষতি করে।
তবে এর চেয়েও মারাত্মক হলো তেলে পোড়া মবিল ব্যবহারের ঘটনা। দৈনিক ইত্তেফাকের ১৪ নভেম্বর ২০০৮ সংখ্যায় ‘পোড়া তেল মবিলে ভাজা হচ্ছে মুখরোচক খাবার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আবুল খায়ের জানিয়েছেন, অতি মুনাফালোভী কিছু হোটেল-রেস্তোঁরার মালিক পোড়া তেলের সঙ্গে গাড়ির পোড়া মবিল ব্যবহার করে থাকে। নতুন মবিলের দাম বেশি, কিন্তু পোড়া মবিল গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয় বলে সস্তায় পাওয়া যায়। এই মবিল বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছেঁকে নিলে স্বচ্ছ হয়। এর সঙ্গে তেলের কৃত্রিম রঙ এবং কৃত্রিম সুগন্ধি মিশিয়ে ‘আসল তেল’ বলে চালানো হয় কিংবা ভালো তেলের সঙ্গে ভেজাল মেশানো হয়।
পত্রিকাটি বলেছে, পোড়া তেল ও মবিলের সংমিশ্রণে তৈরি খাদ্য পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, এসব খাদ্যসামগ্রী মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিজ্ঞানীরা খাদ্যগুলো পরীক্ষাকালে পোড়া তেলের সঙ্গে পোড়া মবিল ব্যবহারের প্রমাণ পান। ’ গাইনি, শিশু, কিডনি, মেডিসিন, লিভার ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা পত্রিকাটিতে বলেছেন- পোড়া তেল ও মবিলের এসব খাদ্য খেলে ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের সমস্যা দেখা দেবেই। তাছাড়া গর্ভবতী মায়ের পেটের বাচ্চা বিকলাঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এসব খাবার শিশু থেকে তরুণ বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য বড় বিপজ্জনক।
তখন এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের প্রয়াত প্রফেসর হারুন কে এম ইউসুফ পারঅক্সাইড ও ট্রান্সফ্যাটজনিত ক্ষতির বিষয়ে মানুষকে সাবধান করে জানিয়েছিলেন, এসব তেল নানা ধরনের মরণব্যাধি দ্রুত সৃষ্টিতে সহায়তা করে।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রফেসর শাহ মোঃ কেরামত আলীও একই মত পোষণ করেছিলেন।
স্বাস্থ্যক্ষতি যাই হোক না কেন, ব্যবসায়ীদের বক্তব্য বাতিল বা পোড়া মবিলে জিলাপি-পেঁয়াজু ভাজা হলে এগুলো মচ্মচে ও চক্চকে হয়। তাদের কাছে পোড়া মবিলের কদর সেজন্যই অনেক বেশি। পুরনো ঢাকার ছোট কাটরাসহ অন্যান্য জায়গায় পোড়া মবিল প্লাস্টিক ক্যানে ভরে বহুদিন ধরে বিক্রি হচ্ছে। রমজান মাস এলে এগুলোর বিক্রি অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়।
গত রমজানে নিলক্ষেতের এক জিলাপিওয়ালাকে কেন ক্ষতিকর পোড়া মবিলে জিলাপি ভাজছেন জিজ্ঞেস করাতে তিনি জানিয়েছিলেন, সব পোড়া মবিল খারাপ নয়, একরকম পোড়া মবিল আছে যেগুলো খাওয়া যায়।
তিনি নাকি সেই খাওয়ার মবিলগুলোই পুরনো ঢাকা থেকে কিনে আনেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক আর কোনো কোনো মিডিয়া পোড়া মবিল নিয়ে যেগুলো কিছুদিন পরপর বলেন সেগুলো আজগুবি।
সেই দোকানে মচ্মচে ও চক্চকে জিলাপি কেনার জন্য সমবেত মানুষের ভিড় দেখে আর কথা বাড়াতে সাহস হয়নি। কিন্তু জানার খুব ইচ্ছে ছিল তিনি কীভাবে জানলেন যে, সব পোড়া মবিল খারাপ নয় এবং কী ভাবেইবা তিনি ‘ভালো’ পোড়া মবিল বাছাই করেন।
ভারতের নাগপুরের এগমার্ক ল্যাবরেটরির পরিচালক ডঃ জয় সোয়াল সম্প্রতি সরিষার তেলে ভেজাল হিসেবে আরেকটি সামগ্রীর সন্ধান পেয়েছেন। সেটি হলো আরজিনন তেল। এটি খাওয়ার পর স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ভোক্তা ঝিঁমুতে শুরু করে। তাছাড়া এটি চোখের সমস্যা সৃষ্টি করতে ও হৃদস্পন্দন বন্ধ করে দিতে পারে। অবশ্য এখনো বাংলাদেশের সরিষার তেলে আরজিনন তেল পাওয়া যায়নি।
ভেজাল তেল বাংলাদেশের গ্রাম শহরগুলোতে ব্যাপকভাবেই বিক্রি হচ্ছে। প্রচলিত ব্যবস্থায় গ্রাম এলাকায় তেলের বিশুদ্ধতা মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও শহর এলাকায় আছে। শহর এলাকায় সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা রয়েছে। এদের অধীনে রয়েছে স্যানিটারি ইনসপেকটর। উপজেলার স্থানীয় প্রশাসনও বিষয়টি দেখার এখতিয়ার রাখে। কিন্তু তারপরও ভেজাল বন্ধ হচ্ছে না। প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট সংখ্যক স্যানিটারি ইনসপেকটর না থাকাকে এজন্য দায়ী বলে সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ মনে করেন।
তবে মিডিয়া বলে অন্য কথা। তারা বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যে, এক শ্রেণির স্যানিটারি ইনসপেকটর ভেজালকারীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে থাকেন বলেই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। পক্ষে বিপক্ষে মতামত যাই থাকুক, ভোক্তাদের কাছে পরিষ্কার যে, তেলে ভেজাল দেওয়া চলছেই।
বাংলাদেশের বাজারে ঘি বলে যা বিক্রি হচ্ছে তার ৯৫ শতাংশই ভেজাল। ঘিতে ভেজাল দেওয়ার জন্য সস্তা দামের বিভিন্ন তেল, বনস্পতি ও চর্বি ব্যবহার করা হয়। মূলত পাম অয়েল এবং সাবান তৈরির পাম স্টিয়ারিন ভেজাল ঘিয়ের মূল উপাদান। এগুলোকে ভেজাল না বলে বরং নকল বলা ভাল।
ইদানিং ঢাকার কোনো কোনো ভেজাল ঘিয়ের কারখানাতে সেদ্ধ আলু বেটে মেশানোর ঘটনা দেখা গেছে। এর উদ্দেশ্য ভেজাল বা নকল ঘিকে দানাদার দেখানো। মিহি করে নারিকেলের খৈল বেটে মেশানোর উদ্দেশ্যও একই।
তবে নকল বা ভেজাল ঘিয়ের গন্ধ কিন্তু দারুন, আসলের চেয়েও ভালো। ঘিয়ের কৃত্রিম সুগন্ধ মেশানোর কারণে এমনটি হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্রেতা ঘ্রাণ দেখে ঘি কেনেন। কিন্তু ঘ্রাণ দেখে ঘি কিনলে আপনার ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক। সরকারের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং বিএসটিআই ঘি বিষয়ে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেগুলোতেও একই মতের প্রতিফলন পাওয়া যায়।
তাদের প্রতিবেদনে নকল বা ভেজাল ঘিতে তারা বনস্পতি বা ডালডা, গোলআলু, গমের মিহি সুজি, নারিকেলের খৈল, পাম তেল ইত্যাদি সামগ্রী পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তারাও বলেছেন, এসব দ্রব্যের সঙ্গে ঘিয়ের কৃত্রিম সুগন্ধ মিশিয়ে তা আসল ঘি বলে বাজারজাত করা হচ্ছে।
গরুর খাঁটি দুধ থেকে তৈরি ঘিতে কিছু কেরোটিনয়েড থাকার কারণে এর রঙ হয় হালকা সোনালি। আর মহিষের দুধ থেকে তৈরি ঘিয়ের রঙ হবে সাদা। গরুর দুধের চাইতে মহিষের দুধে চর্বিদার উপাদান বা ফ্যাট কনটেন্ট বেশি থাকে বলে বাংলাদেশের মতো ভারতেও ঘি তৈরিতে মহিষের দুধ বেশি ব্যবহৃত হয়। সাদা ঘিকে ঘিয়ের মতো রঙ করার জন্য এতে মেশানো হয় কিছু কৃত্রিম রঙ অর্থাৎ টেক্সটাইল কালার। বিক্রি করা হয় ‘খাঁটি গব্য ঘৃত’ বা ‘খাঁটি গাওয়া ঘি’ বলে। রঙ-এর পরীক্ষা ছাড়া ঘি গরুর না মহিষের দুধ থেকে তৈরি তা বুঝার উপায় নেই। বাংলাদেশে বিএসটিআই-এর কাছেও রঙ পরীক্ষার কোনো যন্ত্র নেই। তাই বিএসটিআই অন্যান্য নির্দেশক মান ব্যবহার করে ঘিয়ের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করে থাকে।
বাংলাদেশে গরু-মহিষের সংখ্যা কম বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বনস্পতির সঙ্গে ঘিয়ের কৃত্রিম রঙ ও কৃত্রিম সুগন্ধ মিশিয়ে নকল ঘি তৈরি করে বিক্রি করা হয়। ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ ও অন্যান্য জায়গায় মোবাইল কোর্ট এমন বেশ কয়েকটি নকল ঘি তৈরির কারখানাতে অভিযান চালিয়ে নকল ঘি উদ্ধার ও বেশ কয়েকজনকে আটক করে, যাদের মধ্যে অত্যন্ত নামকরা কমিউনিটি সেন্টার ও বাবুর্চিও রয়েছে (সূত্র: দি ডেইলি স্টার, ১৮ জুলাই ২০০৭)। ঈদ এলে বাজারে ভেজাল ঘিয়ের সরবরাহ বেড়ে যায়। তখন মোবাইল কোর্টগুলোও অভিযান চালিয়ে কিছু ঘি আটক করে। কিন্তু ভেজালের ব্যাপকতার তুলনায় তা অত্যন্ত নগণ্য।
কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ২০০৮ সালের শেষ দিকে ঈদুল আজহার আগে বাজারের ১২টি কোম্পানির ঘি পরীক্ষা করেছিল। বিএসটিআইর ল্যাবরেটরিতে করা এসব পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, ১০টি কোম্পানির ঘি মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
আসল ঘিয়ের গলনাংক হবে ২৮ক্কসেন্টিগ্রেড। এর নিচে কোন ধাতব বা কাঁচের পাত্রে রাখলে খাঁটি ঘি দানাদার হয়ে জমে যাবে। ২৮ক্কসেন্টিগ্রেডের বেশি কিন্তু ৩০ক্কসেন্টিগ্রেডের কম তাপমাত্রায় রাখলে আসল ঘি দুটি স্তরে বিভক্ত হয়ে জমে যাবে। নিচে থাকবে দানাদার স্তর, উপরে তরল স্তর। ৩০ক্কসেন্টিগ্রেডের বেশি তাপমাত্রায় খাঁটি ঘি জমে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাজারের অনেক বিখ্যাত কোম্পানির ঘি প্রচণ্ড গরমের দিনেও দানাদার হয়ে বা জমে থাকে। অর্থাৎ এগুলো ভেজাল বা নকল ঘি।
ঘি অতি মাত্রায় অসম্পৃক্ত নয় বলে এর আয়োডিন নম্বর হবে ২৬ থেকে ৩৮। এর কম বা বেশি হলে এতে ভেজাল রয়েছে বুঝতে হবে। ক্যাবের পরীক্ষিত ১২টি ঘিয়ের মধ্যে ৭টিতে আয়োডিন ভ্যালু বেশি পাওয়া গিয়েছিল।
খাঁটি ঘিয়ের রেইচার্ট-মিশেল নম্বর বা আরএম নম্বর হবে ২৬ থেকে ২৯। এর কম বা বেশি হলে বুঝতে হবে এতে ভেজাল রয়েছে। বাংলাদেশে এই মান আরো নিচে ধরা হয়েছে (২৩), তবুও কোনো কোনো কোম্পানির ঘি পরীক্ষা করে রেইচার্ট-মিশেল নম্বর এর চেয়েও নিচে পাওয়া যাচ্ছে। ক্যাবের পরীক্ষিত ১২টি ব্র্যান্ডের ঘিয়ের মধ্যে ৫টির রেইচার্ট-মিশেল নম্বর ছিল হতাশাজনক।
অনেকে বাটার অয়েলকে ঘি বলে ভুল করেন। বাটার অয়েলের গন্ধ হবে ভোঁতা, কিন্তু ঘিয়ের গন্ধ হবে চমৎকার।
আসল ঘিয়ে পানি থাকবে অতি সামান্য, ০.১% এর বেশি নয়, কারণ ঘি তৈরি করতে ১০০ক্ক থেকে ১৪০ক্কসেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাটার অয়েলে পানি থাকে প্রায় ০.৫%। কোথাও এর চেয়ে বেশি পানি থাকলে তা আসল ঘি নয়, এমনকি আসল বাটার অয়েলও নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে বাজারের অধিকাংশ তথাকথিত ঘিয়ের মধ্যেই পানির পরিমাণ বেশি, কোনো কোনোটিতে ২৩ গুণ পর্যন্ত বেশি। এগুলো নকল ঘি।
ঘিতে মিল্ক ফ্যাট থাকবে কমপক্ষে ৯৯.৮%। অর্থাৎ এর প্রায় সবটাই মিল্ক ফ্যাট। বাটার অয়েলে মিল্ক ফ্যাট থাকে কমপক্ষে ৯৯.৩%। বাজারের অধিকাংশ কোম্পানির তথাকথিত খাঁটি ঘিতে মিল্ক ফ্যাট নিদারুনভাবে কম। কোনো কোনো কোম্পানির ঘিতে কোনো মিল্ক ফ্যাটই নেই। অর্থাৎ এগুলো তেল চর্বি বা এ ধরনের অন্য কোনো দ্রব্য দিয়ে তৈরি নকল ঘি। ক্যাবের ১২টি কোম্পানির পরীক্ষিত ঘিয়ের মধ্যে ৮টিতে একেবারেই কোনো মিল্ক ফ্যাট পাওয়া যায়নি।
ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলা ২০০৭ সালে অভিযান চালিয়ে বাজার থেকে ২১টি ঘিয়ের নমুনা পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছিলেন। তাতে ২০টিতেই ভেজাল পাওয়া গিয়েছিল। তিনি ভেজাল দেওয়ার সামগ্রী হাতেনাতে আটকও করেছিলেন (সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব, ৫ জুলাই ২০০৭)।
ভোক্তাদের প্রতি পরামর্শ, আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থায় আসল ঘি পাওয়া সহজ কথা নয়। যদি কোনো কারণে পেয়েই যান তাহলে এই মহার্ঘ জিনিসটি যাতে দ্রুত নষ্ট না হয়ে যায় সেজন্য ঘি সব সময় কম তাপমাত্রায় রাখুন। সবচেয়ে ভাল হয় ২০ক্কসেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি রাখলে। যাদের বাড়িতে রেফ্রিজারেটর আছে তারা সেখানে রাখুন, তবে ফ্রিজারে নয়। ৩০ক্কসেন্টিগ্রেডের বেশি তাপমাত্রায় অর্থাৎ আমাদের দেশের গরমের দিনের স্বাভাবিক আবহাওয়ায় খাঁটি ঘি বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে, এর সুঘ্রাণও কমে যায়। যদি লক্ষ্য করেন যে আপনার রেখে দেওয়া ঘিয়ের সুঘ্রাণ কমে যাচ্ছে তাহলে তা দ্রুত ব্যবহার করে ফেলুন। ঘি বেশি পুরনো না হওয়াই ভাল। নতুন ঘিয়ের পুষ্টিগুণ ও স্বাদ বেশি। আর ঘি প্লাস্টিক, মাটির বা অন্য কোনো পাত্রের চেয়ে কাঁচের বৈয়মে রাখাই সবচেয়ে ভাল। এতে ঘিয়ের গুণ দীর্ঘদিন বজায় থাকে।
স্বাস্থ্য-সুখকর নয় জেনেও খাবারে তেল-ঘি ব্যবহারে আমাদের কার্পণ্য নেই। এটাই যেন আমাদের সংস্কৃতি। তবে এর ফলে আমাদের হৃদজটিলতা যে বেড়ে যাচ্ছে সেদিকে আমাদের সবারই খেয়াল রাখা প্রয়োজন। কিন্তু সর্বনিম্ন যতটুক্ ব্যবহার না করলেই নয় তাও যদি নকল-ভেজাল হয় তাহলে মানুষ দাঁড়াবে কোথায়? অত্যন্ত দাম দিয়ে যে তেল-ঘি কেনা হয় তা অবশ্যই বিশুদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। অর্থের অপচয় রোধ করতে এবং স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে, বিশেষ করে আমাদের সন্তানদের বাঁচাতে এটা প্রয়োজন।
আ ব ম ফারুক: অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- abmfaroque@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৩
জেডএম/