ঢাকা: শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন রোগের প্রকোপ। সর্দি-কাশি, জ্বর, হাঁপানি ও নিউমোনিয়ার মতো ঠাণ্ডাজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
মঙ্গলবার সকালে ঢাকা শিশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যহারে রয়েছে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু। এছাড়া রাজধানীর অন্য হাসপাতালগুলোতেও রয়েছে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্তদের ভিড়। বড়দের মধ্যে সর্দি, কাশি, জ্বর, হাপাঁনির প্রকোপ বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌসুমী এসব রোগের সঙ্গে অ্যালার্জির প্রকোপ বাড়ছে। এরই সঙ্গে বাড়ছে চামড়ার রোগও।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীতের আগমনের সঙ্গে ঠাণ্ডা জনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, মায়ের দুধ শিশুর পুষ্টি বাড়ায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফলে সর্দি কাশি শিশুকে সহজে আক্রান্ত করতে পারে না এবং নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা সহজ হয়। তাই শিশুকে মায়ের দুধ পান করাতে হবে। এছাড়া শিশুকে সময়মত সব টিকা দিতে হবে। টিকা দেওয়া হলে শ্বাসতন্ত্রের রোগ থেকে শিশুকে অনেকটাই নিরাপদ রাখা সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাতাসের আর্দ্রতা কমে যাওয়ার কারণে পরিবেশ দূষণ, রাস্তার ধুলা-বালিসহ বাতাসে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বেড়েছে। তাতেই শ্বাসকষ্ট জনিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে। তবে এসব রোগ নিয়ে আতঙ্কিত না হবার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
ঠাণ্ডাজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক মহামুদুর রহমান বলেন, তাপমাত্রার পরিবর্তন শরীরের রোগ প্রতিরোধক শক্তিকে আক্রান্ত করে এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
শীতকালে বাতাস অত্যন্ত শুষ্ক থাকে, ফলে প্রশ্বাসের বায়ু প্রয়োজনীয় পরিমাণে আর্দ্র হতে পারে না। এর ফলে জীবাণু শ্বাসতন্ত্রের ভেতরে ঢোকে ও বিস্তার লাভ করে।
এছাড়া এ সময় পানি খাওয়া কম হয় বলে শরীরে পানিশূন্যতা থাকে এবং শ্বসনতন্ত্র থেকে যে প্রতিরোধক ব্রংকিয়াল নিঃসরণ হয়, যা শ্বাসনালির ভেতরের জীবাণুকে বের করে দেয়, তা শুকিয়ে যায়। ফলে জীবাণু বের হতে পারে না এবং সহজেই বিস্তার লাভ করে।
শুষ্ক আবহাওয়া বাতাসে ভাইরাস ছড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া শীতকালে ধুলাবালির পরিমাণ বেড়ে যায়। ঠাণ্ডা, শুষ্ক বাতাস হাঁপানি রোগীর শ্বাসনালিকে সরু করে দেয়, ফলে হাঁপানির টান বাড়ে।
শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি শীতের শুষ্কতায় অনেকের ত্বক ফেটে যায় এবং চর্মরোগ দেখা দেয়। বিশেষ করে শিশুদের ত্বকে চুলকানি, খোসপাঁচড়া, একজিমাসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয় বলেও জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ও নবজাতক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. সহিদুল্লাহ আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে ৩টি বিষয়ে খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, শীতের অসুখের মূল অংশটা জুড়ে থাকে শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যা থেকে শ্বাসকষ্টের উৎপত্তি হয়। শীতে শ্বাসতন্ত্রজনিত ফুসফুসের প্রদাহ সংক্রান্ত অসুখ নিউমোনিয়া শিশুদের জন্য একটি প্রাণঘাতী রোগ। দ্রুত চিকিৎসা এবং সচেতনতার অভাবে প্রতি বছর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অনেক শিশু মারা যায়।
অধ্যাপক সহিদুল্লাহ বলেন, শীত বাড়ার সাথে সাথে হাঁপানিসহ নানা ধরনের চর্মরোগও দেখা দিতে পারে। একটু সচেতন হলে এই রোগগুলো থেকে বাঁচা সম্ভব। আর শিশুদের ক্ষেত্রে মায়েদের বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
শীতজনিত বিভিন্ন রোগ থেকে শিশুদের মুক্ত রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, যদি কোনো শিশুর সর্দি, জ্বরের সঙ্গে কাশি, বুকে ঘ্যাঁড় ঘ্যাঁড় শব্দ হয় এবং সেই সঙ্গে শিশুর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হলে অবশ্যই তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কারণ ঠাণ্ডা জ্বরের সঙ্গে বুকে ঘ্যাঁড় ঘ্যাঁড় শব্দ ও শ্বাসকষ্ট হওয়াটা নিউমোনিয়ার লক্ষণ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের মেডিসিন অনুষদের ডিন মেডিসিন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, শীতের অসুখের কথা বলতে গেলে প্রথমেই চলে আসে ঠাণ্ডাজনিত সর্দি-কাশির সমস্যা। এই সর্দি-কাশির শুরুতেই গলা ব্যথা, গলায় খুশখুশ ভাব, নাক বন্ধ, নাক দিয়ে পানি ঝরা এবং ঘন ঘন হাঁচি।
এইসব উপসর্গের সঙ্গে হালকা জ্বর, মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, মাথা ভার ভার লাগা, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা, দুর্বল লাগা ও ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়। এটা মূলত শীতকালের শরীরের সাধারণ সমস্যা যা কিনা ৭-১০ দিনের মধ্যে নিজ থেকেই ভালো হয়ে যায় বলে তিনি জানান।
অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, শীতকালে সাইনাস, কান ও টনসিলের ব্যাথাও বাড়ে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, বিশেষ করে নবজাতক, শিশু, বৃদ্ধ ও ধূমপায়ীরা শীতকালে এইসব রোগে খুব বেশি আক্রান্ত হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৩