অবিসংবাদিত কিংবদন্তীর নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা সম্প্রতি বিশ্ববাসীকে কাঁদিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। বলাবাহুল্য, ম্যান্ডেলাদের কখনই মৃত্যু হয় না, তাঁরা আজীবন বেঁচে থাকবেন তাদের কর্মে।
আমাদের সমাজে এখনো অনেক ব্যক্তি জীবিত আছেন, যাঁরা তাঁদের কর্মের জন্যে শ্রদ্ধাভরে স্মরণীয়। খুব সাদামাটা কষ্টকর জীবন থেকে আজ অনেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের কর্মের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছেন। এঁদেরকে লিভিং লিজেন্ড বলে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলানিউজে আমাদের এই ‘লিভিং লিজেন্ড’ বিভাগে আমরা দেশ-বিদেশের সেই সব ব্যক্তিত্বের জীবনগাঁথার কথা বলব।
নিঃসন্দেহে তাঁদের সাফল্যমণ্ডিত জীবনের গল্প আমাদেরকেও সাফল্যের পথে হেঁটে চলতে অনুপ্রাণিত করবে।
আমাদের এ পর্বে থাকছেন আমেরিকান ডাক্তার বেন কারসনের জীবনী।
পুরোনাম বেঞ্জামিন সলোমন কারসন। মা সোনিয়া এবং বাবা রবার্ট সলোমন কারসনের দ্বিতীয়পুত্র বেঞ্জামিন ১৯৫১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেট্রয়টে জন্মগ্রহণ করেন।
বেঞ্জামিনের আফ্রিকান বংশদ্ভূত মা সোনিয়া দারিদ্রক্লিষ্ট ভাগ্য বদলের আশায় মাত্র ১৩ বছর বয়সে রবার্ট কারসনকে বিয়ে করেছিলেন। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিলেন তিনি। শুরুতে সংসার ভালো চললেও রবার্ট ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে।
তখন বেনের বয়স ছিল ৮, আর তার বড় ভাই কার্টিসের বয়স ছিল ১০। সংসার জীবনে রবার্টকে সহ্য করে দুই ছেলেকে মানুষ করা অসম্ভব হবে ভেবে সোনিয়া রবার্টের সঙ্গে সংসারের ইতি টানেন। শুরু হয় শিক্ষাহীন, চাকরিহীন, ডিভোর্সি সোনিয়ার দুই ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করে তোলার যুদ্ধ।
সংসার চালাতে সোনিয়া মানুষের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন। এমনও দিন গেছে, ভোর ৫টায় যখন তিনি কাজে বেরিয়ে পড়তেন তখন তার দুই পুত্র ঘুমিয়ে থাকতো, ফিরতে ফিরতে যখন রাত ১১টা, তখন তার দুই পুত্র ফের নিদ্রাদেবীর কোলে। সারাদিন ধরে তিনি একটার পর একটা কাজ করে অমানুষিক পরিশ্রম করতে লাগলেন শুধু দুই পুত্রকে ভালোভাবে মানুষ করার আশায়।
ছেলেদের মানুষ করে তোলার জন্য মায়ের অমানুষিক পরিশ্রম আর প্রচেষ্টা, দুই ভাই বেন ও কার্টিস এর উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ছেলেবেলায় বেন ও কার্টিস স্থানীয় গৃহস্থ কৃষকের সবজি ও শস্যক্ষেতে কাজ করতেন সেখান থেকে কিছু ভাগ পাওয়ার আশায়।
প্রাথমিক স্কুলে বেন অত্যন্ত খারাপ ছাত্র বলে পরিচিত ছিল। তাঁর সর্বোচ্চ গ্রেড ছিল ডি। প্রায় সময়ই সহপাঠীরা তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করত। রেজাল্ট এত খারাপ হত যে, স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল বেনের মাকে স্কুলে ডেকে এনে দু’কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়তেন না।
বেনের মা নিজেকে অপরাধী ভাবতেন এই ভেবে যে, আজ যদি সে সামান্য পড়াশুনাও জানত, তবে দুই ছেলেকে পড়াশুনায় সাহায্য করতে পারত। হোম ওয়ার্কগুলো ঠিকমত হলো কিনা দেখিয়ে দিতে পারত। বেন ও তার ভাই কার্টিসও জানত না যে তাদের মা পড়তে, লিখতে জানে না। অনেক সময়ই তারা দুই ভাই মায়ের কাছে বইয়ের এটা কি সেটা কি জিগ্যেস করত। চোখে চশমা না থাকায় দেখতে পাচ্ছেন না বলে এড়িয়ে যেতেন সোনিয়া।
ছোটবেলাতেই সোনিয়া আবিষ্কার করেন যে, বেন আসলে দূরের জিনিস ভালো দেখতে পায় না। তখন তিনি ভাবলেন, ক্লাসে বোর্ডের লেখা ভালোভাবে দেখতে পায় না বলেই বোধহয় বেন ভালো রেজাল্ট করতে পারছে না। একটু বেশি পরিশ্রম করে দু-পয়সা জমিয়ে সোনিয়া বেনকে চশমা কিনে দেন।
ক্লাসে শিক্ষক ও সহপাঠীদের কাছে অনবরত পরিহাসের শিকার বেন ও কার্টিস দুই ভাইয়ের মধ্যেই এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল যে, তাদের পক্ষে আর যাই হোক, পড়াশুনা করা সম্ভব নয়। লেখাপড়া হলো দুর্বোধ্য এক জিনিস। বাসায় ফিরেই দুই ভাই দিনরাত টিভি দেখত।
সোনিয়া নিজে পড়াশুনা করতে পারেন নি, তাই তার ইচ্ছে তার দুই ছেলে অন্তত পড়াশুনা করুক। ছেলেদের রেজাল্ট ভালো করানোর জন্য সোনিয়া, তার দুই পুত্রের টিভি দেখার সময় বেঁধে দেন। যতক্ষণ পর্যন্ত বেন ও কার্টিস তাদের হোমওয়ার্ক শেষ না করত, ততক্ষণ তারা বাইরে খেলাধুলার জন্য যেতে পারত না।
তিনি বেন ও কার্টিসের জন্য অদ্ভূত একটি নিয়ম বেঁধে দেন। প্রতিদিন স্কুল শেষ করে বিকেলে দুই ভাই পাবলিক লাইব্রেরিতে যাবে। সপ্তাহে দু’টা করে তারা বই পড়বে এবং সেই বই পড়ে তারা কি বুঝলো সেটির উপর লিখিত রিপোর্ট করে সোনিয়াকে পড়ে শুনাবে।
প্রথমদিকে বেন ও কার্টিস দুই ভাই মায়ের সিদ্ধান্তে মারাত্মক বিরক্ত হয়। বন্ধুরা যেখানে বাইরে খেলছে, সেখানে তাদের যেতে হয় লাইব্রেরিতে। কিন্তু বিরক্ত হলেও তারা মায়ের আদেশ মেনে ঠিক ঠিক লাইব্রেরিতে যাওয়া শুরু করে। এ বই সে বই ঘেঁটে নিজেদের পছন্দ মত বই পড়তে শুরু করে। কয়েক সপ্তাহ পরেই বই পড়ার নির্মল আনন্দ পেতে থাকে তারা।
নিজের ব্রেইন খুব ভোঁতা, কল্পনা শক্তি বলতে কিচ্ছু নেই- এই বদ্ধমূল ধারণা থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে শুরু করে বেন। লাইব্রেরিতে বই পড়ে বেন কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করা শুরু করে। কঠিন কঠিন শব্দ, বানান সবকিছুই সে আয়ত্ত করতে শুরু করে। টেলিভিশন দেখার চেয়ে বই পড়া অনেক বেশি আনন্দের হয়ে ওঠে বেনের কাছে।
মাত্র এক বছরের মধ্যেই বিভিন্ন বিষয়ের উপর বই পড়ে বেন তার সমবয়সীদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে যায়। সায়েন্স, ম্যাথ, স্পেলিং থেকে শুরু করে সব বিষয়েই বেন পারে না এমন কিছু নেই। তার এই আকস্মিক পরিবর্তনে শিক্ষক-সহপাঠী সবাই অবাক।
একবার সায়েন্স ক্লাসের শিক্ষক ছাত্রদের একটি পাথর দেখিয়ে বললেন, কেউ কি বলতে পারবে এই পাথরটির নাম কি? কেউ বলতে না পারলেও বেন অনায়াসে সেই পাথরটির নাম বলতে পেরেছিল। কারণ তার কিছুদিন আগে বিভিন্ন ধরনের পাথর কি কি উপাদানে দিয়ে তৈরি, কোন কোন দেশে পাওয়া যায় সে বিষয়ে ছবিসহ একটি বিশাল বই লাইব্রেরিতে পড়েছিল বেন। কিন্তু সে কথা তো আর জানার কথা নয় সায়েন্স শিক্ষকের। তাই সেই শিক্ষক এত বেশি অবাক হয়েছিলেন যে, বেনকে সেদিন থেকেই তিনি আরো বেশি শেখানোর জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এভাবে সব ক্লাসেই বেনের পারফরম্যান্সে শিক্ষকরা মুগ্ধ হতে থাকেন। এতো দিন যে ছেলে ক্লাসে ডি পেত, সে-ই সব বিষয়ে এ প্লাস পেয়ে ক্লাসের টপ হতে লাগলো।
সেসময় সাদাদের মাঝে কালো বর্ণের বেনের এই সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে স্কুলের সার্টিফিকেট প্রদান অনুষ্ঠানে ক্লাসের এক শিক্ষিকা সাদা স্টুডেন্টদের ভর্ত্সনা করে বলেছিলেন, একজন কালো, দরিদ্র, অশিক্ষিত মায়ের ছেলে হয়ে যদি বেন ক্লাসের সেরা ছাত্র হতে পারে, তবে সব সুবিধা পেয়েও সাদারা কেন তা পারছে না?
বর্ণবাদী এই মন্তব্যে, উপস্থিত অভিভাবকদের মাঝে বেনের মা যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। ছেলের একাডেমিক সাফল্যের চেয়েও তার গাত্র বর্ণ, পারিবারিক অবস্থান শিক্ষকদের কাছে বেশি গুরুত্ব পাওয়ায় তিনি বেনকে ভিন্ন স্কুলে ভর্তি করে দেন।
নতুন স্কুলে বেন কিছুটা খারাপ সংসর্গে পড়ে অনেকটা বখে যাবার উপক্রম হয়। বন্ধুদের মত দামী কাপড়, নিত্য নতুন পোশাকের জন্য মায়ের কাছে বায়না ধরতে শুরু করে। টিনএজ বেনকে মায়ের অসামর্থের কথা যেন বোঝানোই যাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় বন্ধুদের সঙ্গে একদিন এক কথা দু’কথায় মারামারি লাগলে বেন টেবিলের উপর রাখা একটি ধারালো চাকু তার এক বন্ধুর পেটে ঢুকিয়ে দেয়। সৌভাগ্যক্রমে চাকুর বাঁট লাগানো থাকায় বন্ধুর কিছু হয় না, কিন্তু এই ঘটনা বেনের জীবনকে রাতারাতি বদলে দেয়। বেন তার রাগ বশে আনার জন্য নিয়মিত বাইবেল পড়া শুরু করে। ধর্মের মাঝেই প্রশান্তির সন্ধান শুরু করে।
এরপরের কাহিনী অনেক সরল। পড়াশুনায় তুখোড় বেন কার্সন সাফল্যের সঙ্গে হাই স্কুল শেষ করে। ১৯৭৩ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে গ্রাজুয়েশন শেষ করে নিওরোসার্জন হবার লক্ষ্যে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়া শুরু করেন বেন। ১৯৭৫ সালে তিনি তার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী লাকরেনা রাস্টিনকে বিয়ে করেন। ১৯৭৭ সালে মেডিক্যাল ডিগ্রি অর্জন করে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে মেরিল্যান্ডে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। অতি অল্প দিনেই তিনি নিওরোসার্জন হিসেবে খ্যাতি ছড়াতে থাকেন।
১৯৮২ সলের মধ্যে জন হপকিন্সের নিওরোসার্জন বিভাগের প্রধান হন কারসন। ১৯৮৩ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার পার্থে স্যার চার্লস গার্ডনার হাসপাতালে নিওরোসার্জন হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণ পান। সেসময় অস্ট্রেলিয়াতে ভালো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভাব ছিল। কারসনের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায় অস্ট্রেলিয়াতে নিওরোসার্জারিতে আশাতীত সাফল্য অর্জিত হয়।
১৯৮৭ সালে, জার্মান বংশোদ্ভূত সাত মাস বয়সী মাথায় জোড়া লাগানো জমজ শিশুদের কারসন অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে আলাদা করেন। কারসনের নেতৃত্বে ৭০ জন ডাক্তার মিলে ২২ ঘণ্টা ধরে এই জটিল অপারেশন সম্পন্ন করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে মাথায় জোড়া লাগানো শিশুদের বিশেষ পদ্ধতিতে কারসনই প্রথম আলাদা করেন। এরপর তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে জোড়া লাগানো জমজ শিশুদের সাফল্যের সঙ্গে আলাদা করে সুস্থ করে তুলেন। ব্রেইনের উপর কোনো ধরনের আঘাত ছাড়াই এই সব শিশু সুস্থ জীবনযাপন করছে।
কারসনের দেখিয়ে দেয়া পথে এখন অনেক দেশেই জোড়া লাগানো শিশুদের আলাদা করা সম্ভবপর হয়েছে। নিওরোসার্জারিতে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তাকে লিভিং লিজেন্ড বলে আখ্যায়িত করা হয়।
১৯৯৪ সালে কারসন তাঁর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কার্সন স্কলার ফান্ড গঠন করেন। এই স্কলারশিপ মূলত তরুণদের বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে দেয়া হয়। ব্যক্তি জীবনে তিনি তিন পুত্রের জনক।
কার্সন ৩টি বই লিখেছেন। নিজের আত্মজীবনী নিয়ে লেখা গিফটেড হ্যান্ড (এই কাহিনী নিয়ে হলিউডে একটি চমত্কার মুভি তৈরি হয়েছে), বিগ পিকচার ও থিঙ্ক বিগ। বইগুলোতে মূলত সফল হবার জন্য তার ফিলোসফি, কঠোর পরিশ্রম ও সৃষ্টিকর্তার উপর অগাধ বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে।
পাঠক আপনাদের নিশ্চয় তার মা সোনিয়া ও ভাই কার্টিসের কথাও জানতে ইচ্ছে করছে। বেনের ভাই কার্টিস একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার হতে পেরেছিলেন। বেনের মা সোনিয়া কষ্ট করে তার এক ছেলেকে ডাক্তার ও এক ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাতে পেরেছেন। বেন তার মায়ের সকল অপূর্ণতাকে দু’হাত ভরে পূর্ণ করে দিয়েছেন।
দারিদ্রক্লিষ্ট পরিবারে পিতৃহীন একটি শিশু পরিশ্রম ও মায়ের সঠিক দিক নির্দেশনায় কিভাবে সাফল্যের শিখরে পৌছে যায়, বেন কার্সন তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৩