বাকৃবি (ময়মনসিংহ): জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১১ হাজার নারী মারা যায়। আর এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন প্রায় পাঁচ কোটি নারী।
সম্প্রতি পরিচালিত একটি গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। দেশের চারটি জেলায় সহস্রাধিক নারী ও যৌনকর্মীর ওপর জরিপ চালিয়ে গবেষণার এ ফলাফল প্রকাশ করেছে একদল জরায়ু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ।
গবেষণার ফলাফলে প্রকাশ- অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক, বাল্যবিবাহ, ধুমপান বা তামাক সেবন, অধিক সন্তান প্রসবসহ সাতটি কারণে জরায়ু ক্যান্সার হয়ে থাকে। তবে, সঠিক সময়ে জরায়ু ক্যান্সারের উপস্থিতি নির্ণয় করতে পারলে তা নিরাময়যোগ্য।
গবেষক দলের প্রধান ছিলেন স্কয়ার হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সুলতানা রাজিয়া বেগম। তার সহযোগীরা হলেন- ডা. নাসিমা শাহীন, ডা. সামছুন্নাহার, ডা. সোনিয়া পারভীন এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ কে এম আনিসুর রহমান ও ড. তৌহিদুল ইসলাম।
সম্প্রতি চীনের বেইজিংয়ে এশিয়া-ওশেনিয়া রিসার্চ অর্গানাইজেশন আয়োজিত ‘জেনিটাল ইনফেকশেন অ্যান্ড নিওপ্লাশিয়া’ বিষয়ের ওপর ৬ষ্ঠ দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশের জরায়ু ক্যান্সারের ওপর এ গবেষণাটি পোস্টার আকারে প্রদর্শন করা হয়। সম্মেলনে প্রদর্শিত এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ২৫টি অংশগ্রহণকারী দলের ৩৫টি পোস্টারের মধ্যে বাংলাদেশি গবেষকদের এই পোস্টারটি প্রথম স্থান লাভ করে।
প্রজনন শিক্ষা এবং প্রজনন স্বাস্থ্য খাতে সঠিক নীতিমালার অভাবে দিনদিন জরায়ু ক্যান্সার মারাত্মক আকার ধারণ করছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে এটি মহামারী আকার ধারণ করতে পারে বলে জানিয়েছেন গবেষক দলের সদস্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) অধ্যাপক ড. মোজাহিদ উদ্দিন আহমেদ।
ড. মোজাহিদ বলেন- খাগড়াছড়ি, জালামপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর জেলার প্রায় সহস্রাধিক নারী ও যৌনকর্মীদের ওপর গবেষণাটি চালানো হয়েছে। এতে দেখা যায়, প্রায় ১১ শতাংশ গ্রামীণ নারী এবং ৩১ শতাংশ যৌনকর্মী জরায়ু ক্যান্সার সৃষ্টিকারী প্যাপিলোমা ভাইরাস বহন করে।
ভাইরাস বহনকারী এসব নারীদের আপাত দৃষ্টিতে দেখতে সুস্থ মনে হলেও যেকোন সময় তারা জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন। অনিয়মিত ও অধিক সময় ধরে রক্তস্রাব, কারণ ছাড়াই জরায়ু থেকে রক্তপাত, সঙ্গমের সময় রক্তপাত, তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ। এর যেকোনো একটি লক্ষণ দেখা দিলে বুঝতে হবে জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
তিনি জানান, জরায়ু ক্যান্সারের মূল সাতটি কারণ হলো- অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক, বাল্যবিবাহ, অধিক সন্তান প্রসব, ধুমপান বা তামাক সেবন, ঘনঘন সন্তান প্রসব, স্বেচ্ছায় গর্ভপাত এবং প্রজনন শিক্ষার অভাব। তবে, যেসব পুরুষ একাধিক নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন, তিনি বাহক হিসেবে প্যাপিলোমা ভাইরাস অন্য নারীর দেহে ছড়াতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে ওই পুরুষও লিঙ্গ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন।
ড. মোজাহিদ আরো জানান, জরায়ু ক্যান্সার এমন একটি ক্যান্সার যা নিরাময়যোগ্য। যখন সংক্রমণ প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে তখনই এর উপস্থিতি নির্ণয় ও নিরাময় করা সম্ভব। এছাড়া, প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। বছরে একবার জরায়ু পরীক্ষার মাধ্যমে সতর্কতা অবলম্বন করে এ রোগের হাত থেকে মুক্ত থাকা যেতে পারে।
গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা রাজিয়া বেগম বলেন, বাংলাদেশের নারীদের আক্রমণকারী ১০ ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে জরায়ুর ক্যান্সার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে, যা শতকরা ১৯.২ ভাগ। অনেক নারী জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। অথচ তার পরিবার জানেন না তিনি কি কারণে মারা যাচ্ছেন।
লজ্জাবশত অনেক নারীই জরায়ু ক্যান্সারের প্রাথমিক উপসর্গগুলো লুকিয়ে রাখেন, পরীক্ষা করতে চান না। ফলে তারা ধীরে ধীরে জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। যৌন ও প্রজনন শিক্ষা এবং সচেতনতাই পারে জরায়ু ক্যান্সার থেকে মুক্তি দিতে। সেক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা, গ্রামে এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্যাম্পেইন করা গেলে এ রোগ থেকে দেশের নারী সমাজকে পরিত্রাণ দেওয়া সম্ভব বলে জানান ডা. সুলতানা রাজিয়া।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৫ ঘণ্টা, জুন ০৩, ২০১৪