ঢাকা: ৫ মাসে ১৫ লাখ টাকা পর্যায়ক্রমে পরিশোধের শর্তে মৃত আসলামের পরিবারের স্বজনদের কাছে তার মরদেহ হস্তান্তর করেছে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
রোববার বিকেল সাড়ে ৫টায় তারা মরদেহটি হস্তান্তর করে।
হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, বিকেল সাড়ে ৫টায় মরদেহটি দেওয়া হয়।
তিনি জানান, মৃত আসলামের পরিবারে পক্ষে তার স্ত্রী ও মেয়ে লিখিত অঙ্গীকারনামা দিয়ে মরদেহ নিয়ে গেছেন। শর্ত অনুযায়ী তাদেরকে ৫ মাসে বকেয়া ১৫ লাখ টাকা পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করতে হবে।
সিরাজগঞ্জ জেলা সদরের মৃত্যুকালে মো. আসলাম (৫৪) এলাকাতেই ছোট ব্যবসা করতেন। তিনি বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালে লাইফসাপোর্টে থাকা অবস্থায় শুক্রবার বিকেল ৩টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মৃত মো. আসলামের মেয়ে সাদিয়া জানান, চিকিৎসায় মোট ৩২ লাখ টাকা বিল দেখিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মরদেহ হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। এর আগে দিয়েছি ১২ লাখ টাকা। তাই শনিবার বিকেলের মধ্যে ১৯ লাখ টাকা জোগাড় করে দিতে না পারলে মরদেহ দেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
মৃত আসলামের মেয়ে সাদিয়াকে বলা হয়েছিলো, ‘যেখান থেকে পারুন টাকা নিয়ে আসুন। ’
কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে টাকা জোগাড় করতে না পারায় মরদেও আর হস্তান্তর করা হয়নি।
এ অবস্থায় মৃতদেহ দাফন করতে বাড়িতে নিয়ে যেতে অনেক অনুরোধ জানান তার পরিবার। তবে স্বজনদের বুকফাটা কান্নায়ও মন গলে না ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
কর্তৃপক্ষের সাফ কথা, বাকির নাম ফাঁকি।
সাদিয়া বাংলানিউজকে বলেন, অনেক অনুরোধের পর সর্বশেষ মোট ২৭ লাখ টাকার কথা বলে হাসপাতাল। আমাদের আরো ১৫ লাখ টাকা জোগাড় করতে বলে। তা না হলে বাবার মরদেহ দেবে না বলে জানিয়ে দেয় তারা।
তাই ১৫ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করতে না পারায় হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয় আসলামের মৃতদেহ।
সাদিয়া অভিযোগ করে বলেন, বিলিং ম্যানেজার কাজী সেলিম জানিয়ে দেন- ওই অর্থও যদি পরিশোধ করতে না পারে পরিবার, তবে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হবে না। যেখান থেকে পারুক, যেভাবে পারুক টাকা দিয়েই হাসপাতাল ছাড়তে হবে।
বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচার-প্রকাশের পর তা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম পর্যন্ত গড়ায়। রোববার বিকেলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর রুনি মিলনায়তনে মিট দ্যা রিপোর্টার্স অনুষ্ঠানে ইউনাইটেড হাসপাতালে মরদেহ আটকে রেখে টাকা আদায়ের চেষ্টাকে অমানবিক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, শনিবার রাতেই সংবাদটি আমার কানে এসেছে। ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আমি তাদেরকে বিষয়টি মানবিক হিসেবে বিবেচনার জন্য বলেছি।
অবশেষে রোববার বিকেলে শর্ত দিয়ে মরদেহ হস্তান্তরে রাজি হয় ইউনাইটেড হাসপাতাল। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পর্যন্ত বাকি টাকা মাফ করে দেওয়ার অনুরোধ জানালেও তা রক্ষা করা হয়নি।
লাংস ইনফেকশনের কারণে মো.আসলামকে দু’মাস আগে রাজধানীর ল্যাব-এইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তাকে ভ্যান্টিলেশন দেওয়া হয়।
ল্যাব এইড থেকে ৩ জুলাই বারিধারার ইউনাইটেড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় আসলামকে। সেখানে তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি করা হয়। ডা. কায়সার নাসিরুল্লাহর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেন তিনি।
ভর্তির পর চিকিৎসক জানান, রোগীর অবস্থা ভালো নয়। তাই তাকে লাইফ সাপোর্টে ভ্যান্টিলেশনেই রাখতে হবে। তবে অবস্থার কোন উন্নতি হচ্ছিল না। মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে চিকিৎসাভার বহন দুঃসাধ্যের দিকে এগোতে থাকে। তারা রোগীকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে চান। তবে চিকিৎসক আশার বাণী শোনাতে থাকেন।
ভর্তির পর কয়েক ধাপে ২৬ জুলাইয়ের মধ্যেই ১২ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করে পরিবারটি। নিজেদের আর্থিক সামর্থ্য সহায় না হওয়ায় সেই সময়ই চিকিৎসককে আবারো রোগীকে রিলিজ করে দিতে অনুরোধ করেন তারা। তবে এবার চিকিৎসকে বলেন, আরো একটা সপ্তাহ দেখেন। এরপর থেকে বিলের ব্যাপারে আর নির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জানতে চাইলে, ‘খুব বেশি না’বলে এড়িয়ে গেছে। আশায় বুক বেধে স্বজনের সুস্থতার অপেক্ষা করতে থাকে পরিবার।
তবে ভেতরে ভেতরে হু হু করে বিল বাড়তে থাকে পাঁচ তারকা হাসপাতালটিতে। সবশেষ গত বৃহস্পতিবারও পরিবারটি চিকিৎসককে অনুরোধ করেন রোগীকে ছাড়তে। তবে এবার হাসপাতালের বিলিং সেকশন থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, রোগীকে নিতে হলে ৩২ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করে নিতে হবে। এছাড়া রোগীকে ছাড়া হবে না। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে পরিবারের। ৩২ লাখ টাকা তাদের ভিটেমাটি বিক্রি করেও শোধ করা যাবে না।
এভাবে দেহে প্রাণ থাকা অবস্থায় ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে ছাড় পাননি মো. আসলাম। মৃত্যুর পরেও বিল শোধ করতে না পারায় মৃতদেহ সৎকার করতে পারছিলেন না তার পরিবার।
মৃতের মেয়ে সাদিয়া আরও বলেন, শেষ দিকে আমাদের আর বিলের ব্যাপারে কিছু জানানো হতো না। ওষুধের খরচগুলো আমরা নগদ অর্থেই শোধ করে দিতাম। আর রক্তের বিলও দিয়েছি ৩ লাখ টাকা। শুক্রবার দুপুরে বাবা মারা যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের হাতে ৩২ লাখ টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, পুরো অর্থ পরিশোধ না করে এখান থেকে মৃতদেহ নেওয়া যাবে না। আমাদের অনেক অনুরোধের পর বাবার মৃতদেহকে গোসল করায় তারা। পরে কফিনে মুড়িয়ে মরদেহ হিমঘরে রেখে দেয়।
** লাশ জিম্মি রেখে টাকা আদায় অমানবিক
** যেদিন টাকা, সেদিন মরদেহ
** মরদেহ দিচ্ছে না ইউনাইটেড হসপিটাল
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৪