ঢাকা: সকাল ৮টা থেকে একটানা রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে আউটডোর। বন্ধ নেই শুক্র বা শনিবারও।
২০১২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি 'সবার সাধ্যের মধ্যে মানসম্মত সেবা'-এই ব্রত নিয়ে চালু হয় এ হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মধ্যেই কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের বিশাল এলাকার মানুষের কাছে চিকিৎসার ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে হাসপাতালটি। দরিদ্র মানুষের কাছে হাসপাতালটি আরো বেশি আস্থার জায়গা হিসেবে গড়ে উঠেছে নামমাত্র চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য। ১০ টাকায় রেজিস্ট্রেশন আর ২০ টাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাওয়া যায় দেশের বড় বড় হাসপাতালের মতোই।
সরেজমিনে দেখা যায়, কুয়াশার চাদরে ঢাকা সকালে দৃষ্টিনন্দন হাসপাতাল চত্বরে এসে ভিড় করেন রোগীরা। কারো কোলজুড়ে অসুস্থ ছোট্ট শিশু, আবার কেউ নিজেই রোগী। শীতের মধ্যেও কেউ খালি পায়ে, গরিবি হালের পোশাকে; আবার কারো পরনে আধুনিক শাল-শাড়িসহ অন্য সব দামি শীতবস্ত্র। হাসপাতালে ঢুকতে না ঢুকতেই তাঁদের স্বাগত জানান একদল সেবাকর্মী।
ফুটফুটে নবজাতককে কোলে নিয়ে বিছানায় বসে আছেন সনি আক্তার। কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার সনি মা হলেন দ্বিতীয়বার। সন্তানের বয়স মাত্র দুই দিন। সিজারিয়ান বেবি। নাম জানতে চাইলে মিষ্টি করে লাজুক হাসি দিয়ে বলেন, 'নাম একটা ঠিক করেছি, কিন্তু প্রকাশ করিনি, ওর নাম রাখব 'আজিবা আক্তার ইরা'।
আরো আরো হাসপাতাল থাকতে এই হাসপাতালে কেন এলেন জানতে চাইলে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সনি বলেন, 'আগের সন্তানটিও এই হাসপাতালেই জন্ম নিয়েছে। আমি এখানকার নিয়মিত রোগী। কোনো সমস্যা হলেই ছুটে আসি। এত কম খরচে এত সুন্দর একটি হাসপাতালে এত ভালো মানের চিকিৎসা পাওয়া তো খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। '
একটু থেমে আবার বলেন, 'আমার তো মনে হয় এটি টেলিভিশন বা সিনেমায় দেখা ইউরোপ-আমেরিকার কোনো হাসপাতাল। এত সুন্দর পরিবেশ! চিকিৎসক-নার্সরা আপন মা-বাবা, ভাইবোনের মতো দরদ নিয়ে সার্বক্ষণিক সেবা দিচ্ছেন। '
অন্যদিকে দরিগাঁও গ্রামের নাসরিন আক্তার এসেছেন মা হওয়ার জন্য; যেকোনো সময় তিনি সন্তান প্রসব করবেন। পেটে হাত রেখে আস্তে আস্তে কেবলই ঘুরেফিরে দেখছেন হাসপাতালের ভেতরের পরিবেশ। বলেন, 'এইডা যে একটা হাসপাতাল, তা-ই তো মনে অয় না। অন্য সব হাসপাতালে যেমন নোংরা গন্ধ, তেমনি মানুষের ঠেলাঠেলি-চিল্লাপাল্লা; কিন্তু এইহানে খুব নিরিবিলি, কেনো গ্যাঞ্জাম নাই। একটু গন্ধও নাই। '
রোকসানা আক্তার কোলের সন্তানকে দেখিয়ে বলেন, 'চার দিন ধইর্যা জ্বর, সর্দি-কাশি। প্যারাসিটামল খাওয়াইছি, কিন্তু কমতাছে না। এই হাসপাতালে লইয়া আইলাম, সবাই কইতাছে এই হাসপাতালে অনেক ভালো চিকিৎসা দিতাছে। তাই আর ঢাকা যাইতাম না। '
বসুন্ধরা আদ্-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইনচার্জ ডা. ওয়াহিদা হাসিন বলেন, 'হাসপাতালই যেন আমাদের বাসাবাড়ি, আর রোগীরা সব আপনজন। সেভাবেই আমরা রোগীদের সেবায় সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকি। আগে অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি; এমন পরিবেশে রোগীসেবার সুযোগ-সুবিধা আগে ভাবতেও পারতাম না। রোগীদের জন্য যা যা প্রয়োজন, সবটাই আমরা দেওয়ার চেষ্টা করি। '
ডা. ওয়াহিদা বলেন, 'আমাদের এখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় দরিদ্র মা ও শিশুদের চিকিৎসাসেবার প্রতি। পয়সার অভাবে বিনা চিকিৎসায় যাতে একজন মানুষও মারা না যায়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা কোনো রোগীকেই কখনো ফিরিয়ে দিই না। প্রয়োজনে এখান থেকে আমাদের ব্যবস্থাপনায় ঢাকার আদ্-দ্বীন হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই অথবা ওই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক নিয়ে আসি। এ ছাড়া নবজাতকদের জন্য আমরা বিশেষ ধরনের স্কাবু-স্পেশাল কেয়ার বেবি ইউনিট চালু করেছি। এখানে অত্যাধুনিক ইনকিউবিটর, ফটোথেরাপিসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যদিকে হার্টের চিকিৎসায় নতুন ইউনিটেও সংযোজিত হয়েছে নানা প্রযুক্তি। '
চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. রুহুল আমীনের তত্ত্বাবধানে এই হাসপাতালে চলছে সব ধরনের চক্ষু চিকিৎসা। প্রতিদিনই বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে চলে অপারেশন।
ডা. রুহুল আমীন বলেন, 'এর আগে আমি অনেক হাসপাতালে কাজ করেছি, কিন্তু এত সুন্দর চিকিৎসাব্যবস্থা চোখে পড়েনি। বিশেষ করে গরিব মানুষদের জন্য এই প্রতিষ্ঠান এত বেশি মনোযোগী, যা সাধারণত অন্য কোথাও পাওয়া মুশকিল। '
হাসপাতালের চক্ষু ইউনিটের বেডে এক চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় শরীয়তপুরের ৭৬ বছর বয়সী আব্দুল হামিদ বলেন, 'কিছুদিন আগে এইহানে এক চোখ অপারেশন করাইছি, এহন আরেকটা করাইলাম। এইহানকার মতো এত ভালো হাসপাতাল আমি আর দেহি নাই। '
বসুন্ধরা আদ্-দ্বীন হাসপাতালের ব্যবস্থাপক মো. তৈয়বুর রহমান বলেন, 'এখন পর্যন্ত দৈনন্দিন গর্ভকালীন সেবা, নিরাপদ ডেলিভারি, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, স্ত্রীরোগ সেবা, শিশুসেবা, টিকাদান, চক্ষুসেবা, হৃদরোগ, জেনারেল সার্জারি, মেডিসিন, চর্মসহ আরো কয়েকটি চিকিৎসাসেবা চালু আছে। বেশ কয়েকটি বিভাগ খোলার প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থাও আছে। '
ডা. ওয়াহিদা হাসিন বলেন, '৩০০ বেডের এই হাসপাতালে আউটডোরে ১০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে ২০ টাকা ফি দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানো যায়। এ ছাড়া ভর্তি ফি দিনের বেলায় ৩০০ ও রাতে ৪০০ টাকা, পেয়িং বেড ফি ২৫০ টাকা, কেবিন ভাড়া সাধারণ ৮০০ ও ভিআইপি দেড় হাজার টাকা করে। দুই ধরনের মোট ৪০টি কেবিন আছে হাসপাতালে। এ ছাড়া এখানে মাত্র ৮০০ টাকায় স্বাভাবিক ডেলিভারি ও চার হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে সিজার করা হয়। পাশাপাশি ২৬০ টাকায় কেরানীগঞ্জের মধ্যে সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুল্যান্স সার্ভিস আছে। শিগগিরই আরো কিছু চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় যন্ত্রপাতি সংযুক্ত করা হবে। এখন গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ রোগী আসেন হাসপাতালের আউটডোরের চিকিৎসা নিতে। এ ছাড়া ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বেশির ভাগই শিশু ও গাইনির রোগী। '
দেশের শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপ গরিব মানুষের জন্য উন্নত ও আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছে আরেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান আকিজ প্রুপ প্রতিষ্ঠিত আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশনকে সঙ্গে নিয়ে। হাসপাতালে এখন বেডের সংখ্যা ৩০০ হলেও তা ৫০০-তে উন্নীত করার পরিকল্পনা ও অবকাঠামোগত সুবিধা রয়েছে। এর সঙ্গে এবার থেকেই চালু করা হয়েছে বসুন্ধরা আদ্-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ। হাসপাতালের পাশেই একই ধরনের দৃষ্টিনন্দন ও সুরম্য অবকাঠামো নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে কলেজ ক্যাম্পাসটি। সৌজন্যে: দৈনিক কালের কণ্ঠ।
স্বপ্নের পথে
দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত বসুন্ধরা
বাংলাদেশ সময় ১৩২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৫