ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

লাগামহীন ভিজিটে অসহায় রোগী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৬ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৭
লাগামহীন ভিজিটে অসহায় রোগী চিকিৎসকের চেম্বারের দরজায় রোগীর ভিজিট ও পরীক্ষার ঘোষণা। ছবি:অনিক খান

ময়মনসিংহ: হৃদরোগ, বক্ষব্যাধি ও রক্তনালী রোগের চিকিৎসা করেন অধ্যাপক ডা. মো. সাইফুল হক তালুকদার। রোগী দেখেন ময়মনসিংহ নগরীর ধোপাখোলা মোড় এলাকার নেক্সাস কার্ডিয়াক হাসপাতালে।

প্রথমবার তার পরামর্শ ফি (ভিজিট) ১ হাজার টাকা। একই রোগী আবার এলে প্রতিবার দিতে হয় ৭শ’ টাকা করে।

কিন্তু তাতেও রয়েছে বিশেষ শর্ত।

তার দরজায় সাঁটানো কাগজে লেখা রয়েছে, ৩ মাস পর পর পুরাতন রোগী নতুন বলে গণ্য হবে। একই বেসরকারি হাসপাতালে হাড় ও জোড়া রোগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মো. আনোয়ারুল হকের পরামর্শ ফিও ১ হাজার টাকা। পুরাতন রোগীর বেলায় তিনি অধ্যাপক সাইফুলের মতোই ভিজিট নিচ্ছেন।

শুধু এ দু’চিকিৎসকই নন, এ বেসরকারি হাসপাতালের বেশিরভাগ চিকিৎসক তো বটেই, নগরীর অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরাও নিজেদের ইচ্ছামতো পরামর্শ ফি হাতিয়ে নিচ্ছেন।

চিকিৎসা পরামর্শ দেয়ার বিপরীতে এমন মাত্রাতিরিক্ত ফি’তে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অসহায় রোগীরা।   বছর কয় আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অধ্যাপকদের পরামর্শ ফি ৬শ’ টাকা এবং সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকদের পরামর্শ ফি ৫শ’ টাকা নির্ধারণে সুপারিশ করলেও চিকিৎসা ব্যবসায়ীরা কি আর সে কথায় কান দেয়!

হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন স্থানীয় ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম। তিনি দ্বারস্থ হন নগরীর বেসরকারি নেক্সাস হাসপাতালের চিকিৎসক সাইফুল হক তালুকদারের কাছে। ক’দিন আগেও তিনি জানতেন এ চিকিৎসকের পরামর্শ ফি ৭শ’ টাকা।

কিন্তু পরামর্শ নিয়ে কক্ষ থেকে বের হতেই ভিজিটের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি তার কাছে ১ হাজার টাকা চাইলেন। আর এতেই চটে গেলেন তিনি।

ক্ষোভ ঝেড়ে বললেন, চিকিৎসকরা নিজেদের মর্জি মাফিক পরামর্শ ফি আদায় করছেন। আমাদের মতো রোগীদের এখন প্রথমেই ভাবতে হয় চিকিৎসকদের ফি নিয়ে। রোগীদের কৌশলে জিম্মি করেই তারা এভাবে অর্থ আদায় করছেন।

আরেকটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে আসা আবুল বাসেত নামে এক রোগী বলেন, চিকিৎসকরা এখন বড় লোকদের জন্য। গরিবের জন্য নয়। সরকার তাদের পরামর্শ ফি নির্ধারণ করে না দেয়ায় এরা সুযোগ নিচ্ছে।

ময়মনসিংহের প্রান্ত স্পেশালাইজড হাসপাতাল, স্বদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ল্যাব এইড হাসপাতাল, ডেল্টা কেয়ারসহ নামিদামী বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশিরভাগ চিকিৎসকের পরামর্শ ফি ৫শ’ টাকার ওপরে।

বছর বছর তারা এ ফি বাড়িয়ে দেন। তাদের ওপর কারো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তারা খেয়াল খুশিমতোই ফি বাড়াচ্ছেন। চিকিৎসকের চেম্বারের দরজায় সাঁটা ভিজিটের রেট।  ছবি: অনিক খন

জানা যায়, প্রতিটি ক্লিনিক বা প্রাইভেট হাসপাতালে একেজন চিকিৎসক বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী দেখেন।

এতে একেকজন চিকিৎসক প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করেন। এ টাকার ওপর তারা কোন রকম ভ্যাট দেন এমনও নজির নেই।

পরামর্শ ফি’র বাইরেও এসব চিকিৎসকরা তাদের ব্যবস্থাপত্রে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীদের নিজেদের পছন্দমতো ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক বা বেসরকারি হাসপাতালে পাঠান।

এসব থেকেও তারা কমিশন বাবদ শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

সূত্রমতে, আবার অনেক চিকিৎসক ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগী নানা কৌশল-অযুহাতে নিজের মালিকানাধীন ক্লিনিক বা সেন্টারে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে বেশ দাপট দেখাচ্ছেন জামায়াত-শিবির ঘরানার চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত ডা. মতিউর রহমান।

তার মালিকানাধীন বেসরকারি ট্রমা সেন্টারে বসেই রোগী দেখতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আর এর মাধ্যমে তিনি নিত্যদিন রোগীদের পকেট কেটে কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেলো, স্থানীয় নেক্সাস কার্ডিয়াক হাসপাতালে হাড় ও জোড়া রোগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা: মো: আনোয়ারুল হকের চেম্বারের দরজায় লেখা রয়েছে, নেক্সাস হাসপাতালের রিপোর্ট নেক্সাস হাসপাতালেই দেখা হয়।

অর্থাৎ, এখানকার চিকিৎসকদের রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখানেই করতে হয়। আর এর নেপথ্য কারণ তুলে ধরে একজন রোগী বাংলানিউজকে বলেন, আমার মেয়ের আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে হয়েছে এখান থেকেই। অন্যান্য জায়গায় ১ হাজার ৫শ’ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত লাগলেও এখানে খরচ হচ্ছে ৩ হাজার টাকা।

সূত্রমতে, চিকিৎসকদের পরামর্শ ফি’র লাগাম টেনে ধরতে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইন প্রণয়ণের কথা শোনা গেলেও এর বাস্তবায়ন নেই। ফলে চিকিৎসকদের পরামর্শ ফি’র পাগলা ঘোড়ার রাশ টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না।

এসব বিষয়ে নাগরিকদের সংগঠন জনউদ্যোগের সভাপতি অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু বাংলানিউজকে বলেন, রোগীদের স্বাস্থ্য শব্দটির সঙ্গে সেবা যুক্ত হয়ে স্বাস্থ্যসেবা নামটি প্রচলিত।

সেই সেবা থেকে যদি কেউ একান্তই ব্যবসায়ী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখেন তবে সেটি অন্যায় এবং মানবতা সম্পর্কিত নয়।

তবে মানুষ মাত্রই যেহেতু আরো চাই প্রবণতা কাজ করে এটিকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের। কোন পর্যায়ের চিকিৎসক কত ফি নেবেন এটি সরকারের নীতিমালা করে নির্ধারণ করে দিতে হবে, যোগ করেন তিনি।

তবে চিকিৎসকদের পরামর্শ ফি’র বিষয়ে তাদের পক্ষে সাফাই গান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সহকারী পরিচালক লক্ষী নারায়ণ।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, চিকিৎসকরা নিজেদের মতোই চিকিৎসা ফি নেবেন এটাই স্বাভাবিক। আইনজীবীরাও এই কাজটি করেন। আসলে তাদের উপর নিয়ন্ত্রণের কোন সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৭
এমএএএম/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।