ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা: তানজিনা লতিফ যুথি দু’তলার একটি কক্ষে রোগীদের পরামর্শ দিচ্ছেন।
তার কক্ষের সামনে রোগীদের ভিড়।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের অন্যান্য চিকিৎসকও তার মতো বেশি মনোযোগী প্রাইভেট প্র্যাকটিসে। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন ময়মনসিংহের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরাও। তাদের এমন রমরমা ‘চেম্বার’ বাণিজ্যে সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঠিকমতো চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। তাদের কৌশলী ভূমিকার কারণেই হাসপাতাল ছেড়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে ব্যস্ত সময় কাটানো চিকিৎসকদের দুয়ারে পরামর্শ ফি দিয়ে ধর্ণা দিতে হচ্ছে রোগীদের।
রোগী দেখার ফি’র পাশাপাশি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কমিশন, পছন্দের ওষুধ কোম্পানির ওষুধ লিখে কমিশনসহ নানা উপায়ে রোগীদের ‘পকেট’ কেটে নিজেদের পকেট ভারী করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা: যুথির কাছে চিকিৎসা সেবা নিতে এসেছেন নগরীর সেনবাড়ি এলাকার জাকিয়া হাসান দীপা। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, চেম্বারে সিরিয়াল পেতে কষ্ট হলেও বাড়তি মনোযোগ দিয়ে রোগী দেখেন। আর হাসপাতালে ঝক্কি-ঝামেলারও শেষ নেই।
তবে এখানে এসে টাকা দিয়েও সিরিয়াল পেতে বিলম্ব হওয়ায় বিরক্তি প্রকাশ করে গৌরীপুর উপজেলার বাসিন্দা পপি আক্তার বলেন, আড়াই ঘণ্টা বসে থেকেও চিকিৎসকের দোরগোড়া পর্যন্ত যেতে পারিনি। এটা অনেক বড় রকমের ভোগান্তি।
এ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিসিপশনিস্ট শাহীন জানান, ম্যাডাম (যুথি) রোগী দেখে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। একদিনেই তিনি রোগী দেখেছেন শতাধিক। ফলে রোগীর ফি থেকেই তার আয় হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।
তবে চিকিৎসক যুথির চেম্বার বাণিজ্যের কাছে রীতিমতো ধরাশায়ী হয়েছেন এখানকার হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আর সি দেবনাথ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আনিসুর রহমান ও ডা. গৌতম সাহা।
রোগীতে ভরপুর চিকিৎসক যুথির কক্ষের সামনের চিত্রের বিপরীতে তাদের কক্ষে ভিড় নেহায়েতই কম।
এ অবস্থার কারণ জানিয়ে রিসিপশনিস্ট শাহীন জানান, রোগীদের কাছে সরকারি হাসপাতালের রানিং চিকিৎসকদের কদর বেশি। চাকরিতে থাকা অবস্থাতেই বিকেল থেকে রাত অবধি একেকজন চিকিৎসক গড়ে ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী দেখেন। খানিক অদূরের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও একই সময়ে চলছিল চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের মহোৎসব। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সাইফুল বারী, নিউরো মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা: জালাল উদ্দিন, গাইনি বিভাগের অধ্যাপক ডা: তানজিন মির্জা, সিনিয়র কনসালট্যান্ট নিবেদিতা রায় দোলাসহ বেশিরভাগ চিকিৎসকই এ সেন্টারেই দিন-রাত রোগী দেখেন।
এখানকার চিকিৎসকদের বেশিরভাগের ভিজিটিং কার্ডে চেম্বারের ঠিকানাও রয়েছে। সরকারি হাসপাতালের রোগীদের মধুর প্রলোভনে ভাগিয়ে আনছেন তারা বা তাদের দালালরা।
এ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়াসহ গলাকাটা বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে। বেশ কয়েকবার ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে তাদের জরিমানা গুণতে হয়। তবুও চরিত্র বদলায়নি এ ডায়াগনস্টিক সেন্টারটির।
প্রায় একই রকম চিত্র নগরীর নেক্সাস কার্ডিয়াক হাসপাতাল, প্রান্ত স্পেশালাইজড হাসপাতাল, স্বদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ল্যাব এইড হাসপাতালসহ নামিদামি বেসরকারি হাসপাতালগুলোর।
এর মধ্যে নেক্সাস হাসপাতালের চিকিৎসকরা নিয়ম জুড়েছেন, যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাদের হাসপাতালেই করতে হবে।
চিকিৎসকদের চেম্বার বাণিজ্যের বিষয়ে ময়মনসিংহের নাগরিকদের সংগঠন জনউদ্যোগের সভাপতি অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু বাংলানিউজকে বলেন, যারা সরকারি হাসপাতালে চাকরি করেন তারাই প্রাইভেট চেম্বারে রোগী বেশি দেখেন।
এতে স্বাভাবিকভাবেই ধরা যায়, তারা হাসপাতালে সার্ভিস কম দেন, ক্লিনিকে বেশি দেন। রোগীদের ভেড়ানোর জন্য তারা মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের নিয়োগ দেন। কিন্তু সেবা দেয়ার একান্ত মানসিকতা দিয়েই তাদের কাজ করা উচিত।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সহকারী পরিচালক লক্ষ্মী নারায়ণ বাংলানিউজকে বলেন, আমিও শুনেছি চিকিৎসকরা হাসপাতালের বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসেই বেশি মনোযোগী। কেন তারা এমনটি করেন এটা তারাই ভাল বলতে পারবেন। তবে হাসপাতালের টাইমে যদি কেউ বাইরে প্র্যাকটিস করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৪ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০১৭
এমএএএম/জেডএম