জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে মঙ্গলবার (৮ মে) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ এই রোগ বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনগুলোর উদ্যোগে সারাদেশে পালিত হয়েছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। এ দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘বিয়ের আগে পরীক্ষা করলে রক্ত, সন্তান থাকবে থ্যালাসেমিয়া মুক্ত’।
চিকিৎসকদের মতে, সাধারণত শিশুরা এই রোগে আক্রান্ত হয়। এর ফলে শিশুরা মারাত্মক রক্তশূন্যতায় ভুগে এবং প্রতি মাসে এক থেকে দুই ব্যাগ রক্ত গ্রহণ করতে হয়।
কিন্তু নিয়মিত রক্ত নেওয়ার ফলে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের শরীরে আয়রনের আধিক্য ঘটে ও এই আয়রন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে বিষক্রিয়া ঘটায়। ফলে পরবর্তীতে এই রোগীর হৃদযন্ত্র অচল, ডায়াবেটিস ও ডিলেইড পিউবার্টির (দেরিতে বয়ঃসন্ধি) মতো জটিল রোগসহ আরও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তাই আয়রনের বিষক্রিয়া কমানোর জন্য রোগীদের নিয়মিত ব্যয়বহুল ওষুধ খেতে হয়। আর বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবার এর ব্যয়ভার বহন করতে পারে না।
দেখা গেছে, এই রোগের চিকিৎসায় প্রতি বছর প্রায় এক লাখ ২০ হাজার থেকে তিন লাখ ৩৬ হাজার টাকার মতো ব্যয় হয়। আর রোগীর সম্পূর্ণ জীবদ্দশায় যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, সরকার তার কিয়দংশ ব্যয় করলেই দেশে থ্যালাসেমিয়ার প্রতিরোধ ও নির্মূল করা সম্ভব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশের ৭ শতাংশ অর্থাৎ ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের থ্যালাসেমিয়ার বাহক রয়েছে। প্রতি বছর ৭ হাজার শিশু এই রোগ নিয়ে জন্ম নিচ্ছে।
থ্যালাসেমিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশনের পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমানে দেশে প্রায় ৬০ হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০০৯ সালের হেলথ বুলেটিন অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী রোগীদের মধ্যে এই রোগের অবস্থান দশম।
থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সম্পর্কে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ডা. মো. আবদুর রহিম বাংলানিউজকে জানান, থ্যালাসেমিয়া রোগের একমাত্র স্থায়ী চিকিৎসা হচ্ছে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন।
কিন্তু কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে সব রোগীর জন্য এই চিকিৎসা প্রযোজ্য না। যেমন বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের জন্য ভাই বোনের ম্যারো ম্যাচ করা আবশ্যক। কিন্তু তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিলে না। এটি ব্যয়বহুল ও বাংলাদেশের কোথাও থ্যালাসেমিয়ার জন্য সফল বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন চালু হয় নি।
তাই প্রতিরোধই এক্ষেত্রে মুখ্য। কারণ, এর মাধ্যমে সাইপ্রাস, ইতালি, গ্রিস, ইরান, প্যালেস্টাইনসহ বিভিন্ন দেশ থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সক্ষম হয়েছে। এ রোগ প্রতিরোধের উপায় হলো, বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সন্তানের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি রয়েছে কিনা জেনে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
রোগটির প্রতিরোধ সম্পর্কে ডা. মো. আবদুর রহিম বলেন, যেহেতু বাহক বাবা-মা হলে এ রোগ সন্তানের হবে, তাই বিয়ের আগে স্ক্রিনিং করাটা জরুরি। যে কোনো একজন বাহক না হলেই সন্তানের আর এই রোগ হবে না। আর বাবা-মা বাহক হলেও তাদের গর্ভস্থ ভ্রূণ পরীক্ষা করে সন্তান গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া দেশে প্রতি বছর প্রায় ১৭ লাখ বিয়ে হয়, যার ৯০ শতাংশই রেজিস্টার্ড। জাতীয়ভাবে বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের আগে বাধ্যতামূলক রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেই আমরা ঝুঁকিপূর্ণ দম্পতি নির্ণয় করতে পারবো।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, আমরা ইতোমধ্যে কিছু কর্মসূচী গ্রহণ করেছি। এর মাধ্যমে ২০২৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে থ্যালাসেমিয়া রোগ সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা সম্ভব হবে। তবে যে ৬০ হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগী আছেন তাদের সুস্থ করা সম্ভব না। তাই তাদেরকে সুলভে চিকিৎসা দেওয়ার পরিকল্পনা আমরা করেছি।
তিনি বলেন, আমরা একটি ট্র্যাকার উদ্বোধন করেছি। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিবন্ধিত করে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার নির্দেশনা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিবো। যেহেতু জনসচেতনতাই এই রোগ প্রতিরোধের মূল বিষয় তাই আমরা ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করবো। এছাড়া গ্রামেগঞ্জে এর প্রচারণা আমরা বেশি করে চালাচ্ছি, কারণ গ্রামেই এর প্রাদুর্ভাব বেশি।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪০ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৮
এমএএম/এনএইচটি