ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

বাজারের ৭৫ ভাগ পাস্তুরিত দুধ সরাসরি পানের অযোগ্য

মাসুদ আজীম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৪ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১৮
বাজারের ৭৫ ভাগ পাস্তুরিত দুধ সরাসরি পানের অযোগ্য ছবি: প্রতীকী

ঢাকা: বাংলাদেশের দুগ্ধ খামারগুলো থেকে শুরু করে দোকান পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে দুধ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত। যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়। 

এটি বিপজ্জনক হতে পারে যদি এই দুধ   ‘কাঁচা’ (ফুটানো ছাড়া) অবস্থায় পান করা হয়। উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলাদেশে কাঁচা দুধ পানের প্রবণতা দেখা যায়।

বাজারের এই কাঁচা দুধ সরাসরি পান করা অত্যন্ত বিপজ্জজনক বলে আখ্যা দিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়েরিয়াল ডিজিস রিসার্চ, বাংলাদেশ’র (আইসিডিডিআর,বি) গবেষকরা।

সম্প্রতি শিশুদের পুষ্টির প্রাথমিক উৎস বাণিজ্যিকভাবে পাস্তুরিত দুধ সম্পর্কে গবেষণা করে তারা এই অপ্রীতিকর ফল দেখতে পেয়েছেন।

দুগ্ধশিল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে দুধের অণুজীব বিজ্ঞানসম্মতভাবে মান যাচাই করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের দুধ উৎপাদক, হিমাগার এবং স্থানীয় রেস্তোরাঁ থেকে কাঁচা দুধের ৪৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করেছিলো আইসিডিডিআর,বি। এছাড়াও, ঢাকা এবং বগুড়ার বিভিন্ন দোকান থেকে বাণিজ্যিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকৃত দুধের ৯৫টি নমুনাও সংগ্রহ করে তারা।  

বিজ্ঞানীরা দেখেন যে প্রাথমিক দুধ উৎপাদনকারী পর্যায়ে ৭২ ভাগ নমুনা  কলিফর্ম  (≥১০০ সিএফইউ/এমএল) এবং ৫৭ ভাগ নমুনা ফিক্যাল কোলিফর্ম (≥১০০ সিএফইউ/এমএল) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত।  

এছাড়া নমুনাসমূহের ১১ ভাগই উচ্চমাত্রার ই. কোলাই (≥১০০ সিএফইউ/এমএল) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত। ফিক্যাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। দুধে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির ফলে বোঝা যায় যে, এই দুধ জীবাণু বা রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস দ্বারা দূষিত। যা উষ্ণ রক্তের প্রাণীর মলে থাকতে পারে বা দুধ দোয়ানোর সময় দুধে মিশতে পারে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

উৎপাদনকারীদের থেকে দুধ সংগ্রহের স্থানে দেখা গেছে, নমুনাসমূহ উচ্চমাত্রার কলিফর্ম  ব্যাকটেরিয়া (≥১০০ সিএফইউ/এমএল) দ্বারা দূষিত। এবং মল দ্বারা দূষিত হওয়ার হার ছিলো ৯১ ভাগ ও ৪০ ভাগ নমুনায় উচ্চমাত্রার ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া ছিল।  

এদিকে পাঁচটি জেলার ১৫টি হিমাগার থেকে সংগৃহীত দুধের নমুনাসমূহে উচ্চমাত্রার কলিফর্ম  ও মলবাহিত কলিফর্ম  পাওয়া যায়। সবক’টি হিমাগার থেকে সংগৃহীত নমুনায় ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। কিন্তু দেখা যায় ৬৭ ভাগ নমুনা ই. কোলাই দ্বারা উচ্চমাত্রায় দূষিত।  

এছাড়াও, বি. সেরেয়াস এবং স্ট্যাফাইলোকক্কি-র মতো আরো কিছু ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। তবে এগুলোর মাত্রা ছিলো স্বাভাবিক। দেখা গেছে দুধ উৎপাদনকারীর থেকে শুরু করে, হিমাগার এবং সবশেষে ভোক্তা অর্থাৎ স্থানীয় রেস্তোরাঁ পর্যায় পর্যন্ত দুধে ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, পরীক্ষিত পাস্তুরিত দুধের নমুনার প্রায় ৭৭ ভাগে মোট ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা (অ্যারোবিক প্লেট কাউন্ট) উচ্চমাত্রাবিশিষ্ট। যা বিএসটিআই-এর (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) মানদন্ডকে ছাড়িয়ে যায়।  

অন্যদিকে, ৩৭ ভাগ নমুনা কলিফর্ম ও ১৫ ভাগ নমুনা মলবাহিত কলিফর্ম  ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত ছিলো। দুধকে  নিরাপদ করে তোলার জন্য একে পাস্তুরিত করা হয়। কিন্তু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় মানদণ্ডে পাস্তুরিত দুধে এধরনের মলবাহিত কোলিফর্মের উপস্থিতি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।

একজন ভোক্তার জন্য এধরনের গবেষণা ফলাফল কেমন তা বাংলানিউজের কাছে ব্যাখ্যা করেন আইসিডিডিআর,বি-র সহযোগী বিজ্ঞানী ও ফুড মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবরেটরির প্রধান এবং এই গবেষণার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ড. মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম।

এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, বাজারের পাস্তুরিত কাঁচা দুধে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে এবং এসব দুধ খুব ভালোভাবে না ফুটিয়ে খাওয়া উচিত নয়। তবে, ইউএইচটি দুধ থেকে সংগৃহীত নমুনায় জীবাণুর সংক্রমণ দেখা যায়নি, কাজেই সেগুলো পানের জন্য নিরাপদ। যা হোক, এই গবেষণায় আমরা দুধে রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা দূষণ এবং ভেজাল মিশ্রণ-সংক্রান্ত পরীক্ষা করিনি।

দুধের প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যায়সমূহ সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, “দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি দেখে এটি স্পষ্ট বোঝা যায় যে, দুধের মূল গুণ, অর্থাৎ এর পুষ্টিগত গুণাগুণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের গবেষণাসমূহ থেকে দেখা গেছে, দুধের প্রাথমিক উৎপাদক পর্যায়ে এর দূষণের সাথে গরুর প্রজনন প্রক্রিয়া, উৎপাদিত দুধের পরিমাণ, দুধ দোয়ানোর সময় এবং যিনি দুধ দোয়ান তার হাত ধোয়ার অভ্যাসের মতো বিভিন্ন বিষয় জড়িত। সকলের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর দুধ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমরা বাংলাদেশের দুগ্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্বাস্থ্যকরভাবে দুধ দোয়ানো, সংগ্রহ ও সরবরাহ, সংরক্ষণ এবং পাস্তুরিত করার বিষয়ে যত্নবান হতে পরামর্শ দিচ্ছি। এছাড়াও, পানের জন্য দুধকে নিরাপদ রাখতে দুধ উৎপাদনের স্থান থেকে ভোক্তার টেবিল পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে পাস্তুরিত দুধকে নিরবচ্ছিন্নভাবে শীতল রাখার পদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরি।

কেয়ার বাংলাদেশের আর্থিক সহায়তায়  ‘স্ট্রেংদেনিং দ্য ডেইরি ভ্যালু চেইন (এসডিভিসি)’ প্রকল্পের আওতায় বগুড়া, গাইবান্ধা, নীলফামারী, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, রংপুর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার মোট ১৮টি উপজেলায় এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এই গবেষণার ফলাফল ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ফুড মাইক্রোবায়োলজি-তে প্রকাশিত হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ২১৫৫ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১৮
এমএএম/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।