ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

৬০ শয্যার ওয়ার্ডে ভর্তি ৩৪০, ১৩০ জনই ডেঙ্গু রোগী

মাসুদ আজীম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৯
৬০ শয্যার ওয়ার্ডে ভর্তি ৩৪০, ১৩০ জনই ডেঙ্গু রোগী

ঢাকা: ঢাকায় এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর চাপে হাসপাতালগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। রাজধানীর ডেঙ্গু পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে যে হাসপাতালে শয্যা খালি না পাওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। এদিকে, ডেঙ্গু জ্বরে মারা যাওয়ার রোগীর তথ্য সরবরাহেও দেখা যাচ্ছে সমন্বয়হীনতা। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আট জনের মৃত্যুর কথা বললেও বিভিন্ন হাসপাতাল ও রোগীর স্বজনদের দাবি অনুযায়ী, এ জ্বরে মৃতের সংখ্যা ২৮।

খোঁজ নিয়ে জানা  গেছে, যেসব অখ্যাত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সাধারণত কোনো রোগী যায় না, সেসব হাসপাতালও এখন রোগীতে পরিপূর্ণ। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অনেক রোগী প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তির জন্য এসে ফিরে যাচ্ছে।

তবে সরকারি হাসপাতালে গিয়ে রোগীরা ফিরে না এলেও সেখানে থাকতে হচ্ছে ওয়ার্ডের বাইরে, বারান্দায় বা নামাজের স্থানে। অন্যদিকে শয্যা খালি না থাকায় অনেক রোগীকে ফিরিয়েও দিচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো।

গত প্রায় ১ সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগছে ৩ বছর বয়সী শিশু মিশু তাসিন। চলতি মাসের ১৭ জুলাই রাজধানীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে রক্তের পরীক্ষা করানো হয় তার। তখন স্বাভাবিক রিপোর্ট এলেও ছয়দিন পর ২৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল থেকে মিশুর রক্তের পরীক্ষা করালে প্লাটিলেটের পরিমাণ অনেক কম দেখা যায়। এরপর স্বজনদের শুরু হয় হাসপাতালে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি। কিন্তু মিশুকে ভর্তি না করে ফিরিয়ে দেওয়া হয় সব জায়গা থেকেই।  ঢাকা শিশু হাসপাতাল, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, সেন্ট্রাল হাসপাতাল, গ্রিন লাইফ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটে গেলেও সবখান থেকেই ‘কোনো শয্যা ফাঁকা’ নেই বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।  

মিশুর মা নাজমা খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, জ্বরের ঘোরে দুর্বল হয়ে পড়া কোলের শিশুকে নিয়ে শহরের এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়িয়েছি। কিন্তু বেড খালি না থাকায় কোথাও আমার বাবুটাকে ভর্তি করতে পারিনি। একপর্যায়ে রাত ১১টার দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রাস্তায় বসে পড়ি। পরে রাত ১২টার দিকে পরিচিত একজনের সহযোগিতায় মিরপুরের ডেল্টা হাসপাতালে একটি শয্যা ফাঁকা পেয়ে সেখানে মিশুকে ভর্তি করানো হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম বড়ুয়া বাংলানিউজকে বলেন, ডেঙ্গু রোগী অস্বাভাবিকহারে বাড়ছে। ফলে হাসপাতালে রোগীদের স্থান সংকুলান হয় না। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পুরুষ ওয়ার্ডে (মেডিসিন) শয্যা আছে মাত্র ৬০টি। কিন্তু সেখানে রোগী ভর্তি আছে ৩৪০ জন। যার মধ্যে ১৩০ জনই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত।

একই ধরনের তথ্য জানানো হয়েছে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে। সেখান থেকে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে মেডিসিন ওয়ার্ডের পাশাপাশি অন্য বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড খালি করে সেখানেও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অবস্থা আরও খারাপ। এখান থেকে রোগী ফেরত দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। তাই কোনো রোগী না ফিরিয়ে সবাইকেই ভর্তি করা হয়। বর্তমানে ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৪০৬ জন রোগী। এত রোগীকে কীভাবে সেবা দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে ঢামেকের মেডিসন বিভাগের অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা কিছু অতিরিক্ত শয্যার ব্যবস্থা করেছি। এছাড়া মেঝেতে রেখেও রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই শয্যার বিষয়টি অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পুরুষ ওয়ার্ডে (মেডিসিন) ৬০ শয্যা থাকলেও ভর্তি রয়েছে ৩৪০ জন, এদের মধ্যে ১৩০ জনই ডেঙ্গু রোগী।  ছবি: বাংলানিউজএ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি হাসপাতালে সব ধরনের নির্দেশনা দেওয়া আছে। চিকিৎসকদের চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে কোনো রোগী ফিরিয়ে দেওয়ার কথা নয়। তবে বেসরকারি হাসপাতালের বিষয়টি জেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

এদিকে ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সম্পূর্ণ তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমে সরবরাহ করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর সূত্র। সেখানে কিছু কিছু বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য জানা গেলেও সব হাসপাতালের তথ্য নেই।

সর্বশেষ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে চলতি মাসের ২৪ দিনে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৬ হাজার ৪২১ জন। শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছে ৫৬০ জন। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ২৩ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মোট ৮ হাজার ৫৬৫ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। যাদের মধ্যে ৬ হাজার ৪৯৯ জন রোগী ছাড়পত্র পেয়েছে। বর্তমানে ভর্তি আছে ২ হাজার ৫৮ জন। এ পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে মৃত্যু ঘটেছে ৮ জনের।

অন্যদিকে রাজধানীর পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের অন্যান্য এলাকায়ও। হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বাংলানিউজকে জানান, এ পর্যন্ত গাজীপুরে ৪২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৪ জন, চট্টগ্রামের অন্যান্য হাসপাতালে ৫৭ জন, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ১৬ জন, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৪ জন, যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ৫ জন, বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২ জন এবং বরিশালের অন্যান্য হাসপাতালে ৯ জন চিকিৎসাধীন রয়েছে। সব মিলিয়ে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় মোট ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন।

সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আট জনের মৃত্যু হয়েছে। যেখানে বিভিন্ন হাসপাতাল ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ২৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে জানায়, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সব তথ্য রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) থেকে পেয়ে থাকে তারা। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের তথ্য উপাত্ত বিচার বিশ্লে¬ষণে আইইডিসিআরকে আরও বেগবান হতে হবে। তাছাড়া রোগের প্রাদুর্র্ভাব নিয়ে বছরব্যাপী গবেষণা চললে ঝেঁকে বসার আগেই এ ধরনের রোগ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব।  

এ প্রসঙ্গে কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আখতার বলেন, এটা আইইডিসিআর থেকে আমাদের জানানো হয়। তাদের একটি পৃথক ‘ডেথ রিভিউ কমিটি’ রয়েছে, যারা এসব মৃত্যু তদন্ত করে প্রকাশ করে।  

তবে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও মশা নিধনে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। সরকারের উচিত এখন মানুষকে সঠিক তথ্য জানানো।  

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৪ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৯
এমএএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।