ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

দালাল চক্রের কাছে জিম্মি রোগীরা

সাজিদুর রহমান রাসেল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২১
দালাল চক্রের কাছে জিম্মি রোগীরা মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল

মানিকগঞ্জ: চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাইতে দিছে? আসেন আমাগো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সব মেশিন (যন্ত্র) নতুন, এখানে সব রিপোর্ট ভালো হয়। আর খরচও অন্য সব জায়গা থেকে কম।

 

এভাবেই মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের বহিঃবিভাগ থেকে রোগীরা টিকিট কেটে চিকিৎসক দেখানোর পর ভবন থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর নির্দিষ্ট দালাল চক্রের খপ্পরে পড়েন অসহায় সাধারণ রোগীরা। পরে পরীক্ষার খরচ বাবদ অতিরিক্ত অর্থ গুণতে হচ্ছে বলে অভিযোগ একাধিক ভুক্তভোগী রোগীর।

মানিকগঞ্জ হাসপাতালের বহিঃবিভাগে প্রতিদিন গড়ে ১২ শতাধিক রোগী চিকিৎসা সেবা নেন। এর মধ্যে কিছু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। আর কিছু রোগীর অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

কয়েক বছর আগে ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও হাসপাতালে এখনো ১০০ শয্যায় যে চিকিৎসক থাকার কথা রয়েছে তার থেকেও কম। যার কারণে কোনো মতে দায়সারাভাবে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন জেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রোগীদের সেবায় হাসপাতালের ভেতরেই রয়েছে পরমাণু কেন্দ্র, প্যাথলজি, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, রেডিওলোজিসহ কয়েকটি বিভাগ। এসব বিভাগে কম টাকায় বিভিন্ন ধরনের এক্স-রে, ইসিজি, এন্ডোসকপি, ব্লাড টেস্ট, এমআরআই, সিটিস্ক্যানসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করা যায়।

দেখা গেছে, হাসপাতালে চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় জনবল সংকট থাকায় চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষের। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অসহায় ও দারিদ্রসীমার নিচের জনগোষ্ঠীকে জিম্মি করে হাসপাতালের কতিপয় জরুরি বিভাগ, ওয়ার্ড বয় ও নার্সদের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে রোগী পাঠিয়ে সুবিধা নিচ্ছেন তারা।

চিকিৎসক রোগী দেখার সময় রোগ নির্নয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের টেস্ট করতে বলেন। এই টেস্টগুলো কম খরচে সরকারিভাবে করার ব্যবস্থা থাকলেও রোগীরা তা করতে পারছেন না। হাসপাতালের ল্যাব খোলা হয় সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর তা বন্ধ হয়ে যায় আর এ কারণে অনেকে বাহির থেকে টেস্ট করিয়ে আনেন। আবার কোন স্থানে সরকারিভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয় তা অনেকেরই জানা নেই। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর অসাধু নার্স, ওয়ার্ড বয়রা দালালদের মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং টেস্টের লাভের একটি অংশ বিকাশের মাধ্যমে তাদের মোবাইলফোন নিয়ে নেন।  

যেখানে দারিদ্রসীমার জনগোষ্ঠী বিনামূল্যে সেবা নিতে আসেন এই সরকারি হাসপাতালগুলোতে। কিন্তু জেলা হাসপাতালের আশেপাশে অবস্থিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিহ্নিত ২০ থেকে ৩০ জন সক্রিয় দালালদের খপ্পরে পড়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অসহায় রোগীরা। একাধিক বার প্রশাসনিকভাবে অভিযান চালালেও এক-দু’দিন দালালমুক্ত থাকে হাসপাতাল কমপ্লেক্স, কোনো না কোনো উপায়ে বের হয়ে আবার সক্রিয় হয়ে পড়ে এই দালালচক্র।

জেলার হরিরামপুর উপজেলা থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রফিক বাংলানিউজকে বলেন, আমার স্ত্রী গত তিনদিন যাবত অসুস্থ হওয়ায় হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে ভর্তি করি। সকালে চিকিৎসক রাউন্ডে এসে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন। পরে হাসপাতালের একজন নার্সের কাছে জিজ্ঞাসা করি, পরীক্ষাগুলো কোন জায়গায় করাবো? নার্স জানালেন সরকারিভাবে পরীক্ষা করালে আজ রিপোর্ট পাবেন না, সেজন্য বাইরে থেকে পরীক্ষাগুলো করিয়ে নিয়ে আসেন এবং তারই দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে পরীক্ষা করাই। কিছু সময় পর এসে টেস্টের রিপোর্টগুলো সেই নার্সের হাতে দেই। কিন্তু নার্স আমাকে বলেন- দেরি করে ফেলছেন। আজ তো আর ডাক্তার এই রিপোর্টগুলো দেখবেন না। কাল সকালে দেখাইয়েন।  

তিনি অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালের নার্স ও আয়ারা আমাদের মতো সাধারণ রোগীদের অসহায়েত্বের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দালালদের মাধ্যমে অবৈধভাবে অতিরিক্ত টাকা আয় করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর দালাল বাংলানিউজকে বলেন, আমরা তো গ্রামের অসহায় রোগীদের ভুল বুঝিয়ে নিয়ে পরীক্ষা করে কয়টা টাকা আয় করি, কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে অধিকাংশ কর্মচারীরা প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী পাঠিয়ে যে কমিশন নেন, সেটা কোনো অপরাধ না! কারণ তারা তো বড় মানুষ তাই না? আমরা চোর হলে উনারা তো ডাকাত।

দালাল চক্রের সক্রিয়তার সত্যতা নিশ্চিত করে মানিকগঞ্জ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. আরশাদ উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, দালাল চক্রের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপার (এসপি) বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছি। তারা দুই-একবার ব্যবস্থাও নিয়েছে। কিন্তু দাললরা কীভাবে যেন বের হয়ে এসে পুনরায় আবার সক্রিয় হয়ে অসহায় গরীব মানুষদের জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে পরীক্ষার করার নাম বলে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

হাসপাতালের কিছু নার্স ও ওয়ার্ড বয়য়ের বিরুদ্ধে প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী পাঠিয়ে কমিশন খাওয়া অভিযোগ বিষয়ে পরিচালক ডা. মো. আরশাদ উল্লাহ বলেন, লিখিত বা মৌখিকভাবে অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০২১
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।