ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

হাসপাতালে কেবলই বুকফাটা আর্তনাদ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৯ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০২১
হাসপাতালে কেবলই বুকফাটা আর্তনাদ রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে উদ্বেগজনক হারে রোগী বেড়েছে। ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ও আইসিইউ ওয়ার্ডের বাইরে বিরাজ করছে থমথমে নীরবতা। প্রায়শই শোনা যাচ্ছে বুকফাটা কান্না আর স্বজন হারানোর আর্তনাদ।

কারও চোখ দিয়ে অঝরে পানি ঝরলেও বের হচ্ছে না শব্দ। কোথাও থেকে আবার ভেসে আসছে গোঙানির আওয়াজ! কেউ চোখের পানি মুছতে মুছতে আবার কেউ বুকফাটা কান্নার রোল তুলে সদ্য পরলোকে পাড়ি জমানো স্বজনের নিথর মরদেহ নিয়ে আহাজারি করতে করতে হাসপাতাল এলাকা ত্যাগ করছেন।

করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায়, বিশেষ করে ঈদের পর উদ্বেগজনক হারে রোগী বেড়েছে। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। গেল কয়েকদিনে মৃত্যুও রেকর্ড ভেঙেছে প্রতিদিনই। কেবল গত ১ জুন ১০ জুন পর্যন্ত ৯২ জন মারা গেছেন।

এদিকে, হাসপাতালে করোনা রোগী বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম অবস্থা। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাতে অনেকটাই বিপর্যস্ত এই হাসপাতাল। চিকিৎসকরা বলছেন, এভাবে রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

রামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গেল ২৪ ঘণ্টায় করোনা এবং করোনা উপসর্গ নিয়ে আরও ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগের ৪৮ ঘণ্টায়ও আট জন করে মৃত্যু হয়।

জানতে চাইলে রামেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস বাংলানিউজকে জানান, গেল ২৪ ঘণ্টায় মৃত ১২ জনের মধ্যে সাতজন করোনা পজিটিভ ছিলেন। অন্য পাঁচ জন মারা গেছেন উপসর্গ নিয়ে। করোনা পজিটিভ হয়ে মারা যাওয়া সাত জনের মধ্যে তিন জনের বাড়িই চাঁপাইনবাবগঞ্জে আর নয় জনের বাড়ি রাজশাহীতে। করোনা পজিটিভ হয়ে মারা যাওয়া সাত জন রোগীর মধ্যে পাঁচ জনই রাজশাহীর আর দুই জন চাঁপাইনবাবগঞ্জের।

এক প্রশ্নের জবাবে ডা. সাইফুল ফেরদৌস আরও জানান, গত নয় দিনে (১ জুন সকাল ৬টা থেকে ১০ জুন সকাল ৬টা পর্যন্ত) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মারা গেছেন ৯২ জন। এর মধ্যে ৫৬ জনই মারা গেছেন করোনা শনাক্ত হওয়ার পর। বাকিরা উপসর্গ নিয়ে মারা যান। এর মধ্যে ১ জুন সাত জন, ২ জুন সাত জন, ৩ জুন নয় জন, ৪ জুন ১৬ জন, ৫ জুন আট জন, ৬ জুন ছয় জন, ৭ জুন ১১ জন, ৮ জুন আট জন, ৯ জুন আট জন এবং সবশেষ ১০ জুন ১২ জন মারা যান।

এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন ৪২ জন। এর মধ্যে রাজশাহীর ১৮, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১৬, নওগাঁর সাত জন, নাটোরের একজন। একই সময় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৫ জন। বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন ২৯০ জন। অথচ শয্যা সংখ্যা ২৭১টি। ধারণ ক্ষমতার বেশি সংখ্যাক রোগী বর্তমানে ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে রাজশাহীর ১৪২, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১১১, নওগাঁর ১৫, নাটোরের ১৫, পাবনার তিন জন, কুষ্টিয়ার তিন জন ও চুয়াডাঙ্গার একজন। আইসিইউতে ভর্তি রয়েছেন ১৮ জন।

অপরদিকে, করোনার ‘নতুন হটস্পট’ রাজশাহীতে একদিনের ব্যবধানে ফের বেড়েছে সংক্রমণের হার। বৃহস্পতিবার দুইটি ল্যাবে রাজশাহীর ৫৬২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে ২৩৭ জনের করোনা পজেটিভ এসেছে। রাতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল দুইটি পিসিআর ল্যাবর নমুনা পরীক্ষায় এই ফল প্রকাশ করা হয়।

করোনা রোগীদের পাশে থাকা স্বজনরা বলছেন, হঠাৎ করে রোগীর শরীরে কমে যায় অক্সিজেন লেভেল ও রক্তচাপ। অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় হৃদস্পন্দন। ঘনঘন শ্বাস নেওয়ার চেষ্টায় রোগী আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে অক্সিজেনের অভাবে রোগীর মৃত্যু হয়।

হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ডে অন্তত ২০ জন রোগীকে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার রানা-উল-ইসলাম। তিনি করোনা আক্রান্ত নানা ও মামার দেখাশোনা করতে করোনা ওয়ার্ডে থাকছিলেন।

রানা বলেন, অক্সিজেনের অভাবে মানুষের মৃত্যু কতটা নির্মম তা অবর্ণনীয়। অনেক রোগীকে দেখেছেন অক্সিজেনের লেভেল আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। অক্সিজেনের অভাবে পুরো শরীর লাফাচ্ছে। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে অনেকেই মারা যাচ্ছে।

দুপুরে রামেক হাসপাতালে দেখা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে রহমত উল্লাহ তার বাবা শফিউল্লাহকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছেন। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট তার বাবার। ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলেন না। এদিকে জরুরি বিভাগের সামনে দীর্ঘলাইন। সিরিয়াল অনুযায়ী চলছে ভর্তির কাজ। অনেক কষ্টে তার বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করালেন। ভর্তির সময়ই অক্সিজেন লেভেল ৮০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।

রহমত উল্লাহ বলেন, সকাল থেকে তার বাবার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। চার দিন আগে করোনা ধরা পড়লেও তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। আজ হঠাৎ করে অক্সিজেন লেভেল আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে।

রামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন করোনা পজিটিভ বা উপসর্গ নিয়ে রোগী ভর্তি হচ্ছেন। তাদের অধিকাংশই অক্সিজেন সমস্যা প্রকট বলেই হাসপাতালে আসছেন। দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মৃত্যুর বেড়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ।

রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগীরা অনেক দেরিতে হাসপাতালে আসছেন। দেরি করে ফেলায় মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে। ঈদের পর থেকে করোনা রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে চিকিৎসা দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে। তখন সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

তিনি আরও বলেন, মূলত যাদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাচ্ছে তারাই হাসপাতালে ভর্তি হতে আসছেন। ফলে শতভাগ রোগীকেই অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। সেন্ট্রাল লাইনে অক্সিজেন সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। পর্যাপ্ত সিলিন্ডার মজুদ রাখা হয়েছে। আরও একটি ওয়ার্ডে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালুর কাজ চলছে। অক্সিজেনের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশের অক্সিজেন ভর্তি রিজার্ভ রাখা হয়েছে। তবে রোগী বাড়তে থাকলে অক্সিজেন নিয়েও সংকটে পড়তে হতে পারে।

এদিকে, রোগীর চাপ সামাল দিতে রাজশাহী সদর হাসপাতালের পরিত্যক্ত ভবন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বুধবার থেকে করোনা রোগীদের জন্য আরও একটি ওয়ার্ড বাড়ানো হয়েছে।

রামেক হাসপাতাল পরিচালক বলেন, সদর হাসপাতালের পরিত্যক্ত ভবন সংস্কার শেষ হলে রামেক হাসপাতালের সাধারণ রোগীদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। বর্তমানে হাসপাতালে ১৮টি আইসিইউতেই করোনা রোগীদের অগ্রাধিকার দিয়ে ভর্তি করা হচ্ছে। তবে যেভাবে রোগীর চাপ বেড়েছে তাতে আগামীতে পরিস্থিতি কী হবে তা বলা কঠিন।

এদিকে, গত ৩ জুন থেকে রাজশাহীতে চলছে রাত্রিকালীন বিধিনিষেধ। প্রথমে সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত করো হলেও গত ৩ জুন থেকে সেটি দুই ঘণ্টা বাড়িয়ে বিকেল ৫টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৯ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০২১
এসএস/কেএআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।