ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

বেতন নিতেও টাকা দিতে হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে!

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০২১
বেতন নিতেও টাকা দিতে হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে!

সিরাজগঞ্জ: বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে। কর্মচারীদের ভাতার টাকা আত্মসাৎ, করোনায় বরাদ্দ দেওয়া সুরক্ষা সামগ্রী লোপাট, কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচিতে আপ্যায়নের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা আত্মসাৎ এবং ভুয়া করোনা রোগী হাসপাতালে ভর্তি দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ ছাড়াও কর্মচারীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগও রয়েছে এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

  

এসব অনিয়মের ফিরিস্তি তুলে ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৭৩ জন স্বাস্থ্য সহকারী ও ৬২ জন সিএইচসিপি।  

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আনোয়ার হোসেন করোনাকালীন সিএইচসিপি ও স্বাস্থ্য সহকারীদের জন্য বরাদ্দ হওয়া সব সুরক্ষা সামগ্রী লোপাট ও হাসপাতালে ভুয়া করোনা রোগী ভর্তি দেখিয়ে বরাদ্দকৃত টাকা আত্মসাৎ করেছেন। জাতীয় কৃমি নিয়ন্ত্রণ সপ্তাহ উপলক্ষে প্রায় ৬০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে অ্যাডভোকেসি মিটিং না করেই মিটিংয়ের নামে সম্মানী ভাতা ও আপ্যায়নের টাকা তুলে নিয়েছেন। অপরদিকে কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচিতে আপ্যায়নের জন্য বরাদ্দকৃত প্রায় ১৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ এবং ভ্যাট, অডিটসহ নানা অজুহাতে সব ধরনের প্রশিক্ষণের সম্মানী ভাতা কেটে নিয়েছেন তিনি।  

এদিকে চলতি বছরের শুরুতে ৪র্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) আওতায় উপজেলার ৬৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকে মাল্টি পারপাস হেলথ ভলেন্টিয়ার (এমএইচভি) পদে ৪৫৭ জন নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব পদে নিয়োগের নামেও প্রায় তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। এমএইচভি পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৬ জন বিভিন্ন কারণে চাকরি ছেড়ে দেন। কিন্তু প্রকল্প থেকে তাদের এখনও ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এ ৩৬ জনের ছয় মাসের সম্মানী ভাতা সাত লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ টাকা এরই মধ্যে তুলে নিয়েছেন এ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।  

আবার এ ভাতার টাকা উত্তোলন করতেও প্রতিজনের কাছ থেকে মাসিক ২০০ টাকা হারে কেটে নেন তিনি। গত ছয় মাসের ভাতার মোট পাঁচ লাখ পাঁচ হাজার ২০০ টাকা কাটা হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। এমএইচভি পদে দ্বিতীয় ধাপে চার মাসের সম্মানী ভাতার টাকার মধ্যে তিন মাসের টাকা দেন। বাকি এক মাসের সম্মানী ভাতার টাকাও আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগে জানা যায়।  

এছাড়াও উপজেলা হাসপাতালে ট্রমা সেন্টার ভেঙ্গে বিশাল হলরুমের সমান নিজের বিলাস বহুল অফিস রুম তৈরি করেছেন। হাসপাতাল চত্বরের বেশ কয়েকটি গাছ কেটেও বিক্রি করা হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।  

লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন টাকা ছাড়া এমটি (ইপিআই), এএইচআই, সিএইচসিপি, এইচএসহ কোনো পদে পদায়ন ও বদলির ফরোয়ার্ডিংয়ে স্বাক্ষর করেন না। এছাড়াও সর্বস্তরের স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অসদাচারণ এবং বেতন বন্ধের হুমকি দিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগে নৈরাজ্য ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন এ কর্মকর্তা।   

উল্লাপাড়া পূর্ণিমাগাঁতী ইউনিয়নের ব্রহ্মখোলা কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএচসিপি সাইফুল ইসলাম, মাল্টি পারপাস হেলথ ভলেন্টিয়ার (এমএইচভি) রুহুল আমিন, স্বাস্থ্য সহকারী হোসনে আরা বেগমসহ অনেকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে উপজেলার স্বাস্থ্যসেবায় মহা বিপর্যয় ঘটার শঙ্কা রয়েছে। প্রতিটা খাত থেকেই তিনি অর্থ আত্মসাৎ করেন। পরিবহন বিলের টাকা থেকে ২৫ থেকে ৩০% কাটেন। যেখানে আগের কর্মকর্তারা সর্বোচ্চ ৫% কাটতেন।  

শহীদুল ইসলাম নাদু নামে এক কর্মচারী বলেন, কেউ প্রমোশনের ফরোয়ার্ডিং নেওয়ার জন্য স্যারের কাছে গেলে, তার সহযোগী কয়েকজন নারী কর্মী আছেন, তাদের মাধ্যমে ১০/২০ হাজার করে টাকা নেন। স্যার যখন কোনো স্থানে পরিদর্শনে যান, সেখানে ইনচার্জ বা সহকারী ইন্সপেক্টরকে না নিয়ে সিএইচসিপি নাজমা এবং আলিফাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যান।  

উল্লাপাড়া স্বাস্থ্য সহকারী অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কে এম রাশিদুল হাসান, আমার স্বাস্থ্য সহকারীদের বিনা কারণেই শোকজ করা হয়। সিএইচসিপি নাজমার সঙ্গে পরামর্শ করে টার্গেট করে শোকজ করা হয়। শোকজের জবাব সন্তোষজনক হলেও তাদের বেতন কাটাসহ সার্ভিস বুকে লালকালি দেন তিনি।  

সিএইচসিপি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, এ অফিসে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়। কর্মচারীদের কথায় কথায় বেতন বন্ধ করা, খারাপ ভাষা ও খারাপ আচরণ করা হয়। যে কোনো প্রমোশনের ফরোয়ার্ডিংয়ের ব্যাপারেও টাকা লাগে। ডা. আনোয়ার হোসেন টাকা ছাড়া কারও বেতন ছাড় দেন না। সিএইচসিপি আলিফা ও নাজমার মাধ্যমে টাকা লেনদেন হয়।    

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেনের মোবাইল ফোনে কলা দেওয়া হলে তিনি বলেন, কর্মচারীদের সঙ্গে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। এ কারণে তারা অভিযোগ দিয়েছেন। সেগুলো মীমাংসা হয়ে গেছে।  

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কর্মচারী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. জাহিদুল ইসলাম হীরা বলেন, উল্লাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কর্মচারীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি জেনে আমরা বৃহস্পতিবার (১৮ নভেম্বর) মীমাংসার জন্য ইউএইচএফপিও ফোরামের পক্ষ থেকে চার/পাঁচজন গিয়েছিলাম। ওইদিন বিষয়টি প্রাথমিকভাবে মীমাংসাও হয়েছে।  

সিভিল সার্জন ডা. রামপদ রায় বাংলানিউজকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। যার অনুলিপি আমার দপ্তরে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০২১
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।