ঢাকা: সরকারের যুগোপযোগী টেলিযোগাযোগ নীতিমালার অভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা দামের তরঙ্গ (স্পেকট্রাম) পানির দরে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ওয়াইম্যাক্স অপারেটর ‘ওলো’ এরই মধ্যে অত্যন্ত সস্তায় ২০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কিনেছে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বরে কোনো ধরনের নিলাম ছাড়াই ওলোকে ওয়াইম্যাক্স ও এলটিই (লং টার্ম ইভলিউশন) সেবার লাইসেন্স দেওয়া হয়।
রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান ওলো কার্যত বাংলাদেশ ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ লিমিটেড (বিআইইএল) কিনে নিয়ে ওলো নামে কাজ করছে। চলতি বছরের শেষের দিকে তারা বাণিজ্যিকভাবে এলটিই সেবা চালু করবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ ২৬০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে সরকারের হাতে তরঙ্গ রয়েছে ৬০ মেগাহার্টজ। ওলোকে ২০ মেগাহার্টজ বরাদ্দের পর ২৬০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে তরঙ্গ আছে আর মাত্র ৪০ মেগাহার্টজ।
মোবাইল অপারেটরেরা থ্রিজি নিলামের মাধ্যমে ২১০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে তরঙ্গ পেয়েছিল। এজন্য প্রতি ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গে অপারেটরদের পরিশোধ করতে হয়েছিল ৮১৬ কোটি টাকা। সেই হিসেবে ২০ মেগাহার্টজের দাম আসে তিন হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে মেগাহার্টজের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ২৬০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড। আর ওয়াইম্যাক্স অপারেটর ওলো এই মেগাহার্টজে ২০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ পেয়েছে মাত্র ২৪৬ কোটি টাকায়।
সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী, আগামীতে বাংলালায়ন ও কিউবিও ২৬০০ মেগাহার্টজে তরঙ্গ কিনে এলটিই চালু করতে পারবে। এরপর বাকি দুই অপারেটর যদি ২০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কিনে নেয় তখন মোবাইল অপারেটররা ফোরজি চালু করতে কোনো তরঙ্গ বরাদ্দ পাবে না।
সর্বশেষ করা নীতিমালা অনুযায়ী থ্রিজি নিলাম হলেও ওয়াইম্যাক্স অপারেটরদের তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কয়েক বছরের পুরনো নীতিমালা দিয়ে।
এখন মোবাইল অপারেটররা যদি এলটিই কিংবা ফোরজি চালু করতে চায় তাহলে তাদেরও ২৬০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে তরঙ্গ কিনতে হবে।
দেশে বর্তমানে ৬টি মোবাইল অপারেটর রয়েছে। এসব কোম্পানি এরই মধ্যে এই খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। সম্প্রতি থ্রিজি লাইসেন্স পাওয়ায় তারা আরো কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
এতো বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের পর এখন যদি এসব অপারেটর এলটিই অথবা ফোরজি লাইসেন্স চালু করতে চায় তাহলে তাদের ২৬০০ মেগাহার্টজে তরঙ্গ কিনতে হবে। অথচ এই মেগাহার্টজে ৬০ মেগাহার্টজ তরঙ্গের মধ্যে মাত্র ৪০ মেগাহার্টজ সরকারের হাতে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. ফাহিম হুসেইন বলেন, তরঙ্গ বিক্রিতে এই বৈষম্য সমন্বয়হীনতারই ফলাফল। দূরদর্শী লোকেরা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
তিনি বলেন, ফ্রিকোয়েন্সি ও মেগাহার্টজ জনগণের সম্পত্তি। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকতে হবে। কিন্তু এসব অসঙ্গতি তুলে ধরতে কোনো সিটিজেন ফোরাম নেই। কেউ কথা বলে না।
স্বচ্ছতা থাকা জরুরি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ফ্রিকোয়েন্সি ও মেগাহার্টজ সীমিত। অথচ ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দের কোনো ম্যাপিং নেই। এজন্য মাস্টার প্ল্যান থাকতে হবে। সবার অংশগ্রহণে এটি করা জরুরি। সস্তায় তরঙ্গ বিক্রির বিষয়টি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আমরা কিভাবে অ্যাডহক বেসিসে সব কাজ করছি।
তবে কম দামে তরঙ্গ বিক্রির পক্ষে সাফাই গেয়ে টেলিযোগাযোগ সচিব আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ওয়াইম্যাক্স অপারেটরদের গ্রাহক সংখ্যা মাত্র কয়েক লাখ। তাছাড়া তারা ভয়েস সার্ভিস দিতে পারবে না, তাই তাদের কাছে কম দামে তরঙ্গ বিক্রি করা হয়েছে। তবে এটিও করা হয়েছে নিয়মের মধ্যেই।
যদিও শিগগিরই টেলিযোগাযোগ নীতিমালা সংশোধনী আনা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
কার্যত টেলিযোগাযোগ নীতিমালা পুরনো। এতে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অন্যতম হাতিয়ার ইন্টারনেট সম্পর্কে কিছু না থাকায় অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে।
সরকার ১৯৯৮ সালে প্রথম এই টেলিযোগাযোগ নীতিমালা করে। পরবর্তীতে ২০০১ সালে টেলিযোগাযোগ আইন করা হয়। এরপর এই নীতিমালায় বড় ধরনের কোনো সংশোধনী আনা হয়নি।
যদিও সম্প্রতি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শিগগিরই টেলিযোগাযোগ নীতিমালায় সংশোধনী আনা হবে।
টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের সমন্বয়হীনতা ও দূরদর্শিতার অভাব এবং সর্বপরি একটি আধুনিক টেলিযোগাযোগ নীতিমালার অভাবেই দেশের ব্যবহারযোগ্য সম্পদ তরঙ্গ পানির দরে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ ও এখাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তরঙ্গ খুবই সীমিত। তাই যাচ্ছেতাইভাবে তরঙ্গ বিক্রির আগে সমন্বিত নীতিমালা প্রয়োজন। নতুবা এই খাত হুমকির মুখে পড়বে।
ফ্রিকোয়েন্সি ও মেগাহার্টজ সীমিত বলে স্মরণ করিয়ে দিয়ে ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দের কোনো ম্যাপ না থাকারও সমালোচনা করেন তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৪