ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতিতে আলোচিত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে সম্প্রতি নিজের ইউটিউব চ্যানেলে একটি বিশ্লেষণধর্মী ভিডিও প্রকাশ করেন ভারতের বিশিষ্ট সমর বিশেষজ্ঞ এবং ফোর্স ম্যাগাজিনের সম্পাদক প্রভিন সনি।
এই আলোচনায় তিনি শুধু সামরিক অভিযানের বিশ্লেষণ নয় বরং তা ভারতের বর্তমান নিরাপত্তা নীতি, যুদ্ধনীতির বিবর্তন এবং ভারতীয় বিমানশক্তির ব্যবহারের কৌশলগত প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
এই ভিডিওতে তার করা বিশ্লেষণ পছন্দ হয়নি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের। যার কারণে ভারতে এই ভিডিও ব্লক করে দেওয়া হয়েছে।
তার সেই ভিডিও আলোচনার বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ গুলো বাংলানিউজের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল:
এই ভিডিওর শুরুতেই ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রভিন সনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যে অফিসিয়াল প্রেসব্রিফিং এসেছে, তাতে বলা হয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনী সীমান্ত রেখা অতিক্রম না করেই স্ট্যান্ড-অফ (শত্রুসীমায় না ঢুকে) আক্রমণ করেছে। এই আক্রমণে পাকিস্তান এবং পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের ৯টি সন্ত্রাসী শিবিরে হামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি সন্ত্রাসী শিবির ছিল ভাওয়ালপুরে।
সুতরাং আমরা এখানে সীমান্তরেখা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের একটি লক্ষ্যবস্তুর কথা বলছি। এখানে ভারতীয় বিমানবাহিনী স্ট্যান্ড-অফ অস্ত্রের ব্যবহার করেছে।
এই লক্ষ্যবস্তুগুলো সামরিক ছিল না বরং এগুলো ছিল লঞ্চ প্যাড বা যেসব অবকাঠামো ব্যবহার করে জঙ্গিরা আক্রমণ করা সংঘটিত করেছে। আমরা জানি এই ক্যাম্প ও লঞ্চ প্যাডগুলো অস্থায়ী।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব মিশ্রি যে প্রেস ব্রিফিং করেন তাতে তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। পুরো অভিযান ভারতীয় বিমানবাহিনী করলেও, তিনি কোথাও বিমানবাহিনীর নাম উল্লেখ করেননি। বরং মিশ্রি বলেন, এটি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী করেছে এবং তার মতে এটি এমন একটি পদক্ষেপ ছিল যা সতর্কতার সাথে এবং উত্তেজনা যাতে না ছড়ায় সেই অনুপাতেই নেওয়া হয়েছে।
এক্ষেত্রে প্রভিন সনির অভিমত, মিশ্রির এসব বক্তব্যের ব্যাখ্যার দরকার আছে, কেন তিনি ‘ভারতীয় বিমানবাহিনী’ না বলে ‘সশস্ত্র বাহিনী’ বললেন?
প্রভিন বলেন, আমি যখন বিভিন্ন ঘটনা মিলিয়ে দেখি, তখন দেখি ইন্ডিয়া টুডে টেলিভিশনে গৌরভ সাওয়ান্ত উপস্থাপনায় সেদিন তাদের এক প্রতিবেদক সকালের একটি ভিডিও রিপোর্টে বলেন, শ্রীনগর বেসামরিক বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং একটি জেট (ভারতীয়) ভেঙে পড়েছে, যার টুকরোগুলো দক্ষিণ কাশ্মীরের পামপোর অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
সে রিপোর্টার বলেন, ভারতীয় বিমানবাহিনীর সদস্যরা এবং কমান্ডোরা সেখানে এসেছে এবং পুরো এলাকাটি ঘিরে ফেলেছেন। তিনি আরও বলেন জম্মু ও কাশ্মীরে এরকম তিনটি ঘটনা (যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্তের) ঘটেছে।
এর মানে ৭ মে রাতে জম্মু ও কাশ্মীরে অন্তত তিনটি জেট ‘দুর্ঘটনায়’ পড়েছে এবং প্রতিটি স্থানে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সদস্যরা ছিলেন।
একইভাবে, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এবং দ্য হিন্দুতে একই সংবাদ আসে— যদিও হিন্দু সেটি ৪৫ মিনিটের মধ্যে প্রত্যাহার করে— যেখানে বলা হয়েছিল, বাঠিন্ডা বিমানঘাঁটির কাছে একটি জেট বিধ্বস্ত হয়েছে , একজন নিহত এবং নয়জন আহত হয়েছে।
সুতরাং এখানে আমরা চারটি জেট দুর্ঘটনার কথা বলছি যেখানে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ভারত সরকারের পক্ষ হতে এখনও পর্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলা হয়নি, এগুলো কী ধরনের প্লেন ছিল বা যুদ্ধবিমান কি না। ভারতীয় বিমানবাহিনীর সদস্যরা সেখানে কেন ছিলেন, এটা পররাষ্ট্র সচিব মিশ্রির ব্যাখ্যা করার দরকার ছিল। অথচ তিনি তা পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন।
তার ব্যাখ্যা এই জন্যই প্রয়োজন ছিল, কারণ পাকিস্তান বিমানবাহিনী দাবি করেছে যে তারা ভারতীয় বিমানবাহিনীর চার বা পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। তাহলে আপনি যদি সংবাদমাধ্যমে (একই বিষয়ে) কিছু ব্যাখ্যা করেন, তাহলে এই বিষয়টি (যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার) আপনাকে অবশ্যই তুলতে হতো।
কী করে এমন ‘কাকতালীয়’ ভাবে ৬ ও ৭ মে রাতে জম্মু-কাশ্মীর ও পাঞ্জাবে এই ‘দুর্ঘটনা’ গুলো ঘটে?
কিন্তু তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই বলেন, অভিযান এখনো চলছে।
আমি মনে করি এই অভিযান এখানেই শেষ হয়ে গেছে, কারণ আপনি যদি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর দাবি দেখেন, তারা ইতিমধ্যেই তাদের পরিকল্পিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে। তাদের আর কিছু করবার নেই। তবে ভারতের তরফে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করার আছে।
এরপর তিনি বলেন অভিযানটি ‘নন এস্কেলেটরি’ বা অ-উত্তেজনাকর ছিল।
এখন বিশ্বে কোথাও বিমানবাহিনী অ-উত্তেজনাকর শক্তি নয়। যদি আপনি বিমানবাহিনীর মূল বৈশিষ্ট্য দেখেন— তার সবই উত্তেজনাপূর্ণ। এর পাল্লা, দ্রুত এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অন্যটিতে যাওয়ার ক্ষমতা, স্ট্যান্ড-অফ অস্ত্র, যা দূর থেকে আক্রমণ করতে পারে এবং যুদ্ধের রিয়েলটাইম পরিস্থিতির বুঝার প্রযুক্তি সব গুলোই হল— মূলত উত্তেজনা বৃদ্ধিমূলক।
তাই ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিমানবাহিনীর মূল দক্ষতাগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত।
মিশ্রি আরেকটি শব্দ ব্যবহার করেছেন তা হল ‘মাপা প্রতিক্রিয়া’ বা সতর্ক প্রতিক্রিয়া।
এখানে প্রভিন বলেন, অবশ্যই এবারের পদক্ষেপ সতর্কতার সাথে নেওয়া হয়েছিল, যা আমি আমার আগের ভিডিওগুলোতেও বলেছি। কারণ যদি এইবার ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করত, তাহলে তাদের প্রতিক্রিয়া হত কঠোর ও দ্রুত। এমন একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হত যেটা কোনো পক্ষই নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না এবং একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত।
আপনি যদি ২০১৯ সালের অপারেশন ‘বান্দার’ দেখেন, সেখানে তারা অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল এবং পরদিন পাকিস্তান বিমানবাহিনী ‘অপারেশন সুইফট রিটর্ট’ চালায় এবং আমরা জানি সেই অভিযানে কী ঘটেছিল।
তাই এখানে প্রশ্ন করা যেতেই পারে, আর্মি কেন বিমান শক্তিকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করছে না?
গত ১০ বছরে যখন প্রধানমন্ত্রী মোদী ক্ষমতায়, তখন সংকটকালে বিমান শক্তি ব্যবহার যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা অপারেশন বান্দারে দেখেছি, আবার অপারেশন সিঁদুরেও।
এর অর্থ হল আপনি একটি উত্তেজনা বৃদ্ধিকারী শক্তিকে অ-উত্তেজক রূপে ব্যবহার করছেন। যুদ্ধের প্রকৃতি যখন প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে, তখন এসব করে আপনি দেশের (ভারতের) ক্ষতি করছেন।
আগে ভারত ও পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর প্রযুক্তি সক্ষমতা ছিল সীমিত। বিমানবাহিনী ছিল সেনাবাহিনীর সহায়ক। সেনাবাহিনী ছিল মুখ্য শক্তি এবং বিমানবাহিনী ছিল সীমিত আকাশ সুরক্ষা প্রদানকারী— এটিকে বলা হত ‘কমব্যাট এয়ার সাপোর্ট’।
ফলে সেনাবাহিনীও খুব বেশি অগ্রসর হতে পারত না কারণ সৈন্য বা ট্যাঙ্কগুলো পাহাড়ি এলাকায় সীমিত পরিসরেই চলতে পারত।
বিশেষ করে যখন আমরা কাশ্মীরের মত সীমান্ত রেখার কথা বলি, তখন উচ্চতা এবং পাহাড়ি অঞ্চলের কথাই বলি। যার ফলে ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারিতে প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধে যে সামরিক রেখা তৈরি হয়েছিল, তা আজও ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’ হিসেবে রয়ে গেছে।
কোনো যুদ্ধেই ভারতীয় সেনাবাহিনী কখনও পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে বা পরাজিত করতে পারেনি যাতে করে সামরিক নিয়ন্ত্রণ রেখাটি একেবারে মুছে দেওয়া যায়।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। প্রচুর প্রযুক্তি এসেছে পাকিস্তান এবং ভারতীয় বিমানবাহিনীতে। এর ফলে বিমানবাহিনী এখন যুদ্ধজয়ের নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছে।
বর্তমান রণকৌশল হল প্রথমে বিমানবাহিনী এয়ার সুপিরিউটি বা নির্দিষ্ট এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, তারপর তার আড়ালে সেনাবাহিনী অগ্রসর হবে। স্থলভাগ দখল করাই হবে সেনাবাহিনীর কাজ, কিন্তু বিমান শক্তির ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কৌশলগত ভুলে ভারতের বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনী দুটোরই প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্ষয় হচ্ছে। কারণ অপারেশন বান্দার এবং অপারেশন সিঁদুরে আমরা দেখেছি, ভারতীয় বিমানবাহিনীর সীমাবদ্ধতা গুলো প্রকাশ পেয়ে গেছে। শত্রু বুঝে যাচ্ছে, আপনার সামরিক শক্তি দুর্বল হচ্ছে, শক্তিশালী নয়।
মিশ্রি বলেছেন আমরা অপারেশন সিঁদুরের মাধ্যমে পাকিস্তানকে শাস্তি দিয়েছি এবং প্রতিরোধ করেছি। বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা।
ডিটারেন্স বা প্রতিরোধ করা মানে হচ্ছে আপনাকে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যেতে হবে না। ডিটারেন্স হল শত্রু আপনার সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর শক্তি দেখে সামরিক পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে। এটিই হল ডিটারেন্স।
কিন্তু আপনি যদি বারবার আপনার বিমানবাহিনীকে সীমিতভাবে ব্যবহার করেন, তাহলে আপনি আপনার ডিটারেন্স বাড়াচ্ছেন না বরং কমাচ্ছেন। তাই পাকিস্তান শাস্তি পায়নি এবং আমি অবাক হব না যদি জম্মু-কাশ্মীরে এবং ভারতের অন্যান্য অংশে সন্ত্রাসী হামলা কমার পরিবর্তে বেড়ে যায়।
তাই সবাইকে সততার সাথে ভাবতে হবে— এই ‘অপারেশন সিঁদুর’ কী অর্জন হয়েছে? কী অর্জন করা উচিত ছিল? এবং এটি আদৌ কি প্রয়োজনীয় ছিল কিনা?
এমএম