২০০০ সালের শেষ দিকে যখন ‘হাঙ্গার গেমস’ সিরিজের বইগুলো বের হয়, তখন অনেকেই ভয়াল সেই কাহিনি পড়ে শিহরিত হয়েছিলেন। তবে খুব কম পাঠকই হয়তো ভাবতে পেরেছিলেন ভয়ংকর ওই কল্পকাহিনির দৃশ্য একদিন নিজেরাই বাস্তব জীবনে দেখতে পাবেন।
মার্চের শুরু থেকে আমরা পুরোপুরি ইসরায়েলি অবরোধের মধ্যে আছি। পুরো গাজা উপত্যকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষুধা। বেশিরভাগ পরিবার দিনে মাত্র একবার খাবার খেতে পায়। কেউ কেউ দিনের পর দিন কিছুই খেতে পায় না।
মে মাসের শেষ দিকে গাজায় সীমিত পরিসরে ত্রাণ সরবরাহ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)। তারপর থেকে একটু খাবারের জন্য ফিলিস্তিনিরা একপ্রকার মরণ খেলায় নামতে বাধ্য হচ্ছেন।
আমার কিছু প্রতিবেশী ও বন্ধু গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের ত্রাণ কেন্দ্রে গিয়েছিল। কিন্তু আমার পরিবার সে সাহস করেনি। যারা গিয়েছিল, তাদের কাছ থেকে শুধু নৃশংস অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি।
ইসরায়েল ওই ত্রাণ এলাকাকে ‘নেতজারিম করিডোর’ নামে ডাকে। প্রথম যখন এ ‘ত্রাণ এলাকার’ কথা শুনি, মনে হয়েছিল সেখানে তাঁবু থাকবে, মানুষের লাইন থাকবে এবং একটা শৃঙ্খলা থাকবে। কিন্তু যারা ঝুঁকি নিয়ে সাহস করে সেখানে গিয়েছে তারা পেয়েছে শুধু নৃশংসতা আর মৃত্যু।
গাজার পূর্ব প্রান্তের সালাহ আল-দিন সড়কের কাছে বেড়া দেওয়া এলাকায় ওই কথিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র। এটি এতটাই বিপজ্জনক এলাকা, স্থানীয়রা এটিকে ‘মৃত্যু করিডোর’ নামে ডাকে। এর চারপাশে বালি, পাহারায় থাকে বিদেশি সামরিক ঠিকাদাররা। পাশেই ইসরায়েলি ট্যাংক ও সেনাদের অবস্থান।
এখানে ত্রাণ বিতরণের কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি নেই। কখনো কখনো ভোর ৪টায় ত্রাণ কেন্দ্রের গেট খোলে, আবার কখনো পরে। একটু খাবারের জন্য আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই অপেক্ষা করতে শুরু করেন ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিরা।
শেষ পর্যন্ত যখন গেট খোলে, তখন বানের জলের মতো সবাই হুড়মুড় করে ভেতরে ঢোকেন। সেখানে কোনো লাইন নেই, ত্রাণ কর্মী নেই, কোনো দিকনির্দেশনা নেই। চারদিকে শুধু চিৎকার, ধুলোবালি আর ভয়।
আর মাথার ওপরে শকুনের মতো ঘুরতে থাকে ইসরায়েলি ড্রোন। তারপর সেখান থেকে লাউডস্পিকারে চিৎকার- ‘সময় মাত্র চার মিনিট! যে যা পারো নাও। ’
খাবারের বাক্সগুলো ফেলে রাখা হয় বালির মাঝখানে। কিন্তু পরিমাণে খুবই কম। ক্ষুধার্ত মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে খাবারের বাক্সের দিকে। শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি, একজনের গায়ের ওপর আরেকজন পড়ে; ছুরি বের হয়; কিলঘুষির লড়াই বাধে। শিশুরা চিৎকার করে। পড়ে যাওয়া নারী-পুরুষ বালির ওপর হামাগুড়ি দিয়ে একটা খাবারের বাক্স ধরার চেষ্টা করেন। খুবই ভাগ্যবান গুটিকয়েক মানুষই কোনোমতে একটা বাক্স ধরে রাখতে পারে।
এরই মধ্যে শুরু হয় গুলিবর্ষণ। ভারী ভারী অস্ত্র থেকে ব্রাশ ফায়ার করে ইসরায়েলি সেনারা। মুহূর্তেই কথিত সেই ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের চত্বর রূপ নেয় ‘হত্যাযজ্ঞের ময়দানে’।
তখন প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াতে থাকে ত্রাণ নিতে আসা ক্ষুধার্ত মানুষগুলো। অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানেই মারা যায়। কেউ কেউ আহত অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে মৃত্যু ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। কেউ কেউ বন্ধু, আত্মীয় কিংবা অন্য অপরিচিত কারও কাঁধে ভর করে বেরিয়ে আসে। আর কেউ একা পড়ে থাকে বালির ওপর, তাদের রক্ত ঝরে; মৃত্যু হয়।
গত ২৭ মে থেকে সহায়তা নিতে এসব ত্রাণ কেন্দ্রে জড়ো হওয়া ৬১৩ জনকে ফিলিস্তিনিকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনারা। এসব ঘটনায় আহত হয় চার হাজারের বেশি মানুষ। এখনও প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছেন আরও মানুষ।
আমার বন্ধু নূরের বাবা সুভি তাদেরই একজন ছিলেন। তাদের পরিবারের কাছে কোনো খাবার ছিল না। তাই কিছু ত্রাণ সহায়তা পাওয়ার আশায় নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে বাধ্য হন। ১৪ জুন সকালে সুভি নেতজারিমের ত্রাণ কেন্দ্রে যান, কিন্তু সেখান থেকে ফিরে আসেননি আর।
নূর আমাকে বলেছিল, তারা কীভাবে দরজার পাশে অপেক্ষা করেছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, কোনো খোঁজ নেই, কোনো ফোন নেই, ইন্টারনেটও বন্ধ ছিল। সেই নিঃশব্দতা ছিল ভয়াবহ, অসহনীয়। তারপর হঠাৎ দূরে গুলির শব্দ ভেসে আসে। তখনই তারা বুঝতে পারে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু তার বাবার কাছে পৌঁছার বা যোগাযোগ করার কোনো উপায় ছিল না।
পরে প্যারামেডিকসরা নূরের বাবার মৃতদেহ খুঁজে পান। তিনি নিজের সন্তানের জন্য একটি খাবারের ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফেরার চেষ্টার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
আসার আরেক বন্ধু হালা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের মৃত্যু ফাঁদে নিহত হওয়া খামিসের ঘটনা বললো। খামিস ছিল হালার বোনের স্বামী। মাত্র দুই বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছিল। এখনো কোনো সন্তান হয়নি। কিন্তু পুরো একটি পরিবারের দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে। যুদ্ধের শুরুতে ভাই নিহত হওয়ার পর তার সন্তানদের দেখাশোনা করতে শুরু করেন খামিস।
যখন তাদের খাবার শেষ হয়ে যায়, তখন খামিসের বন্ধুরা অনেক বুঝিয়ে তাকে ত্রাণ নিতে যাওয়ার জন্য রাজি করায়। ২৪ জুন সকালে তারা ত্রাণ কেন্দ্রের কাছে অপেক্ষা করছিল, ঠিক তখনই কেউ একজন চিৎকার করে উঠল- ‘গেট খুলেছে!’
খামিস তাদের লুকিয়ে থাকার জায়গা থেকে একটু বেরিয়ে এলো, নিজের চোখে দেখার জন্য। ঠিক তখনই ইসরায়েলি কোয়াডকপ্টার থেকে ছোড়া একটা গুলি তার কাঁধ ভেদ করে হৃদপিণ্ডে গিয়ে আটকায়, ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। খামিস রেখে যান এক শোকাহত স্ত্রী আর ক্ষুধার্ত ভাতিজা-ভাতিজিদের।
এ রকম অসংখ্য ঘটনা আছে। এগুলো এতটাই বেদনাদায়ক, হৃদয়বিদারক, যেগুলোর কথা কেউ কোনোদিন জানবে না।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই ঘটনাগুলোকে বলছে ‘ত্রাণ গণহত্যা’ (এইড ম্যাসাকার)। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘যুদ্ধাপরাধ’। কিন্তু এগুলো আসলে সত্যিকারের ‘হাঙ্গার গেমস’।
ক্ষুধা মানুষকে বদলে দেয়। এটি শুধু শরীরকে দুর্বল করে না, এটা আত্মাকেও কঠিন পরীক্ষায় ফেলে। এটি মানুষের বিশ্বাস এবং ঐক্যকে ভেঙে ফেলে। এটি মানুষের খুবই মৌলিক প্রবৃত্তিকে (আদিম বর্বর প্রবৃত্তি) জাগিয়ে তোলে। আর দখলদাররা সেটা জানে এবং তারা সেটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
তাদের এই নিষ্ঠুর হামলা এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা ‘ইউএনআরডব্লিউএ’ নিষিদ্ধ করা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়।
‘ইউএনআরডব্লিউএ’র ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা ছিল সুশৃঙ্খল ও স্বচ্ছতার একটি মডেল। সংস্থার সঙ্গে নিবন্ধিত প্রতিটি পরিবারের একটি পরিচয়পত্র ছিল। যার মাধ্যমে তারা একটি যত্নশীল ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার ত্রাণ গ্রহণ করতো। বিধবা, এতিম, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীসহ সর্বাধিক ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হতো।
এই পদ্ধতি প্রাণঘাতী পদদলন এবং সহিংস সংঘর্ষের ঝুঁকি কমিয়ে আনতো। কারণ জাতিসংঘের এই ত্রাণ ব্যবস্থায় ছিল শৃঙ্খলা, মর্যাদা এবং মানবজীবনের প্রতি সম্মান।
কিন্তু দখলদাররা (ইসরায়েল) এসব কিছুই চায় না। আর সেই কারণে তারা নির্মম খেলা হাঙ্গার গেমসের মতো করে তাদের এই ত্রাণ বিতরণকে ডিজাইন করেছে।
এসব পরিকল্পিত ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে গণ্ডগোল এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য। যাতে ফিলিস্তিনিরা একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে। যাতে ফিলিস্তিনিদের সামাজিক শৃঙ্খলা ও ঐক্য ভেঙে পড়ে।
এক মাস ধরে এসব ত্রাণ কেন্দ্রে কোনো গণহত্যার বিষয়ে ইসরায়েল এবং তাদের সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন অস্বীকার করে আসছিল। ইসরায়েলের এই মিথ্যা অনেকেই বিশ্বাস করেছিল। এখন ইসরায়েলি মিডিয়াই জানিয়েছে, ইসরায়েলি সৈন্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ত্রাণ কেন্দ্রে সহায়তা নিতে আসার ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালাতে। এখন কি বিশ্ব আমাদের বিশ্বাস করবে? তারা কি কোনো ব্যবস্থা নেবে?
গাজায় যা ঘটছে, তা কোনো উপন্যাস নয়। অথবা কোনো ‘হরর’ সিনেমাও নয়। হাঙ্গার গেমস এখন বাস্তব, আর এরই অংশ হয়ে চলছে এক ভয়াবহ গণহত্যা। দুঃখজনকভাবে, বিশ্ব চোখ বন্ধ করে রেখেছে এবং এ নৃশংসতা হতে দিচ্ছে। আর এটিই প্রমাণ করে মানবতা আজ কোথায় পৌঁছেছে!
লেখক: তাকওয়া আহমেদ আল-ওয়াওয়ি একজন কবি; তিনি গাজা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের একজন শিক্ষার্থীও।
এমইউএম/এমজে