ঢাকা, রবিবার, ৮ ভাদ্র ১৪৩২, ২৪ আগস্ট ২০২৫, ০০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

‘আমরা মরতে চাই তাহলে বেহেশতে গিয়ে খাবার খেতে পারব’

আন্তজার্তিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:২৭, আগস্ট ২৩, ২০২৫
‘আমরা মরতে চাই তাহলে বেহেশতে গিয়ে খাবার খেতে পারব’ ছবি: সংগৃহীত

ইসরায়েলের অব্যাহত হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় মানবিক বিপর্যয় এত নিচে নেমে এসেছে, যা দেখলে যে কোনো মানুষের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে। শুধু গলে না ইসরায়েলিদের পাষাণ হৃদয়।

গত পাঁচ মাস ধরে আমিষ খাওয়ার বিন্দুমাত্র সৌভাগ্য হয়নি অনেক মায়ের। অনেক শিশু ফল-মূল খাওয়া ভুলে গেছে। কেউ কেউ ফলমূল আর সবজি দেখতে কিংবা খেতে কেমন তাও বুঝতে পারে না। খাবার সংকট এমন শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে, গাজার শিশুরা বিভিন্ন সংস্থার কাছে আকুতি জানিয়ে বলছে এ কষ্ট আর সহ্য হচ্ছে না, আমরা মরতে চাই তাহলে বেহেশতে গিয়ে খাবার খেতে পারবে।

গাজা শহরে পাঁচ সন্তান নিয়ে বসবাস করেন ৪১ বছর বয়সী নারী রীম তৌফিক খাদার। গাজার দুর্ভিক্ষ নিয়ে নিজের করুণ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করার সময় তিনি বলেন, দুর্ভিক্ষের ঘোষণা অনেক দেরিতে এসেছে, কিন্তু তবুও এটি গুরুত্বপূর্ণ।

জাতিসংঘ-সমর্থিত এক প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো গাজা উপত্যকার কিছু অঞ্চল জুড়ে দুর্ভিক্ষের ঘোষণার পর সেখানকার বাসিন্দারা বিবিসিকে জানান তাদের করুণ কাহিনি।

ছয় সন্তানের মা রাজা তালবেহ ২৫ কেজি ওজন হারিয়েছেন। গাজা শহরের জেইতুন এলাকায় তার বাড়ি ছিল। কিন্তু এক মাস আগে তিনি তা ছেড়ে চলে এসেছেন। এখন তিনি সমুদ্রের ধারে একটি অস্থায়ী তাঁবুতে থাকছেন।

তিনি বলেন, আমার শরীর গ্লুটেন, মানে শস্য জাতীয় খাবার সহ্য করতে পারে না। তাই বাজারে বা আশপাশে তার খাওয়ার মতো খাবার খুঁজে পাওয়াটা এখন কঠিন বিষয় হয়ে গেছে। যুদ্ধের আগে একটি দাতব্য সংস্থা আমাকে গ্লুটেন-মুক্ত খাবার পেতে সাহায্য করতো। কারণ ওই খাবার কিনে খাওয়া আমার সাধ্যের বাইরে ছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমার যা দরকার, আমি তা বাজারে পাই না। আর পেলেও কিনতে পারি না।  

২৯ বছরের রিদা হিজেহ বলেন, তার পাঁচ বছরের মেয়ে লামিয়ার ওজন ১৯ কেজি থেকে নেমে সাড়ে দশ কেজি হয়ে গেছে। যুদ্ধের আগে লামিয়ার কোনো রোগ ছিল না। সবকিছুই হয়েছে কেবল দুর্ভিক্ষের কারণে। একটি শিশুর খাওয়ার মতো কিছুই নেই। কোনো সবজি নেই, ফল নেই। লামিয়া এখন পা ফোলা, চুল পড়া ও স্নায়ুর সমস্যায় ভুগছে। সে হাঁটতে পারে না। আমি বহু ডাক্তারের কাছে গিয়েছি, ক্লিনিক-হাসপাতাল ঘুরেছি। তারা সবাই বলেছে, আমার মেয়ে অপুষ্টিতে ভুগছে। কিন্তু তারা কেউ কিছু দেয়নি। না চিকিৎসা, না কোনো সহায়তা।  

 জাতিসংঘ বলছে, গাজার সহায়তা প্রবেশের ক্ষেত্রে ইসরায়েল ব্যাপকভাবে বাধা দিচ্ছে। তবে ইসরায়েল এ অভিযোগ অস্বীকার করছে। গাজা জুড়ে অঞ্চলে যে অনাহার চলছে, সে কথাও ইসরায়েল অস্বীকার করেছে, যা ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী, একশোর বেশি মানবিক গোষ্ঠী ও জাতিসংঘের একাধিক সংস্থার বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত।

শুক্রবার জাতিসংঘ-সমর্থিত ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন বা আইপিসি বলেছে, গাজা সিটি ও আশপাশের এলাকায় ‘সম্পূর্ণভাবে মানবসৃষ্ট’ দুর্ভিক্ষ চলছে।

সংস্থাটি সতর্ক করেছে, গাজা উপত্যকার পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ এখন "ক্ষুধা, চরম দারিদ্র্য ও মৃত্যুর" মতো "বিপর্যয়কর" পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

'ইউকে-মেড' নামে একটি ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থার হয়ে গাজায় কাজ করছেন ব্রিটিশ নার্স ম্যান্ডি ব্ল্যাকম্যান। তিনি বলেন, মাতৃত্বকালীন, প্রসবের আগে ও প্রসব-পরবর্তী অবস্থায় যেসব মায়েরা ক্লিনিকে আসেন, তাদের ৭০ শতাংশের শরীরে অপুষ্টি ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। ফলে জন্ম নেওয়া শিশুদের আকার ছোট হচ্ছে এবং তারা বেশ নাজুক।

২০২৩ সালের সাতই অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস আক্রমণ করেছিলো। তখন ইসরায়েলে এক হাজার ২০০ জন নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায় হামাস।

সেই হামলার প্রতিক্রিয়ায়ই ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান চালানো শুরু করে, যে অভিযানে এখন পর্যন্ত ৬২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।

হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অন্তত ২৭১ জন 'দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টিতে' মারা গেছে, যাদের মধ্যে ১১২ জন শিশু।

গাজা শহরের বাসিন্দা আসিল বলেন, "পাঁচ মাস আগে আমার ওজন ছিল ৫৬ কেজি। আজ আমি মাত্র ৪৬ কেজি। "

তিনি জানান, তিনি মাসের পর মাস ধরে কোনো ফল বা মাংস খাননি এবং বেঁচে থাকার জন্য প্রায় সব সঞ্চয় খরচ করে ফেলেছেন।

আসিল তার ননদের সাথে থাকেন। ননদের এক মাস বয়সী সন্তান আছে একটি।

"সে (ননদ) মরিয়া হয়ে সাশ্রয়ী দামে শিশুদের গুঁড়া দুধ খুঁজছে," তিনি বলেন।

তিনি জানান, যদি এটি পাওয়া যায়ও, এর প্রতি ক্যানের দাম পড়ে ১৮০ শেকেল বা ৩৯ ইউরো।

"আমার কাছে কোনো খাদ্য মজুদ করা নেই, এক-দুই সপ্তাহের মতোও না," তিনি যোগ করেন।

"হাজারো মানুষের মতো আমরাও দিন গুণে বেঁচে আছি। "

সেভ দ্য চিলড্রেনের সিনিয়র মিডিয়া ম্যানেজার শাইমা আল-ওবাইদি বলেন, এখানে বসে এই (দুর্ভিক্ষের) ঘোষণাটিকে আপনার চমকপ্রদ কোনো তথ্য মনে হবে না।

বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আল-ওবাইদি বলেন, ২ মার্চ রমজান মাসে হঠাৎ করে সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় তিনি গাজায় ছিলেন। আগের দিন, অফিসে এত গুঞ্জন ছিল যে অবশেষে লেটুস বাজারে এসেছিল এবং সেদিন ইফতারের জন্য তারা কী সালাদ তৈরি করবে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল।

তিনি বলেন, কয়েকদিনের মধ্যেই কোনো ধরনের প্রোটিন বা মাংস পাওয়া যায়নি। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কোনো তাজা ফল এবং কোনো তাজা শাকসবজি ছিল না এবং এক মাসের মধ্যে কোনো ময়দা ছিল না। যদি ময়দা পাওয়াও যেত তবে তা স্বাভাবিকের চেয়ে তিনগুণ বেশি দামে পাওয়া যেত। মানুষ ঘাস খাচ্ছিল, তারা পাতা খাচ্ছিল।

তিনি আরও বলেন, শিশুরা তাকে বলেছিল ‘আমরা মরতে চাই তাহলে বেহেশতে গিয়ে খাবার খেতে পারব’।

জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।