ইন্দোনেশিয়ার জাভা অঞ্চলের এক শহরে চৌরাস্তার ওপর একটি গ্রাফিতি দেখতে পাওয়া যায়, যাতে লেখা ‘রিসেট সিস্টেম’। দেশটিতে গত সপ্তাহে প্রাণঘাতী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই গোলাপি আর সবুজ রঙে গ্রাফিতিটি আঁকা হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় চলমান সহিংস বিক্ষোভের সময়ে গোলাপি আর সবুজ রঙ দ্রুতই এক সংহতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। মানুষের অসন্তোষের কারণ অর্থনৈতিক অসমতা আর সংসদ সদস্যদের বিলাসী জীবনযাপন।
জাকার্তার রাজধানীতে দিলা নামে এক অফিসকর্মী তার ডেস্কে বসে ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ প্রোফাইল ছবিতে উজ্জ্বল সবুজ ও গোলাপি ফিল্টার ব্যবহার করলেন। ২৮ বছর বয়সী দিলা বললেন, আমাদের এখন একে অপরের পাশে থাকা দরকার… কারণ এখনও অনেক দূর যেতে হবে। তিনি তার পুরো নাম প্রকাশ করতে চাননি।
গোলাপি রঙটি সেই হিজাবের প্রতীক, যা একজন নারী হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের বাইরে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে পুলিশদের সামনে প্রতিবাদ করেছিলেন। সবুজ রঙটি ২১ বছর বয়সী ডেলিভারিম্যান আফফান কুর্নিয়াওয়ানের প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে। তিনি এক বর্মধারী প্যারামিলিটারি পুলিশ গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন।
যারা কম বেতন পান এবং দীর্ঘ কর্মঘণ্টার মধ্য দিয়ে যান, তাদের মধ্যে এই মৃত্যু ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তারা বিক্ষোভে নেমেছেন। আফফান খাবার ডেলিভারি করছিলেন। তিনি সবুজ জ্যাকেট পরেছিলেন। এই জ্যাকেট ইন্দোনেশিয়ার ডেলিভারি ম্যান, রাইড শেয়ারিং অ্যাপের চালকদের পোশাক। গত বৃহস্পতিবার তাকে হত্যা করা হয়।
অফিসকর্মী দিলা বলেন, আমাদের পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার দরকার, অপরাধীদের ক্ষমা করে দেওয়া চলবে না। এটি শুধু চলমান বিক্ষোভের বিষয় নয়, আগে ঘটানো অন্যান্য ঘটনার ফলও এটি।
প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো ক্ষমতায় আসার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দেশজুড়ে এমন বিক্ষোভ শুরু হলো। তিনি এক সময়ের সেনা জেনারেল ছিলেন।
‘ব্রেভ পিঙ্ক, হিরো গ্রিন’
ইন্দোনেশিয়ার বিক্ষোভ থেকে ‘ব্রেভ পিঙ্ক, হিরো গ্রিন’ আন্দোলন শুরু হয়। এটি প্রাবোও এবং দেশটির সংসদকে বিতর্কিত সুবিধা বাতিল করতে বাধ্য করেছে। এসব সুবিধার মধ্যে ছিল সংসদ সদস্যদের বিদেশ যাত্রা ও বাড়ি ভাতা, যা জাকার্তার ন্যূনতম মজুরির প্রায় ১০ গুণ।
দেশের অর্থনীতি বড় হলেও এর সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। তারা দেখছে রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের ধনী করছে এবং ধনী-গরিবের ফারাক বাড়ছে। অফিসকর্মী দিলা বলছিলেন, সমস্যা পুরো সিস্টেমে। সরকার, সংসদ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক দূরত্ব আছে।
দিলাসহ অনেকে এই আন্দোলনকে অনলাইনে সচেতনতা ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করছেন। কেউ ছবি আঁকছেন, কেউ ওয়েবসাইটে ছবি তৈরি করছেন, যেন লোকজন নিজের ছবি পরিবর্তন করতে পারে। দিলা বলেন, বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা মনে তা লোকজনকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার একটি উপায় এটি।
‘আমরা সমস্যা নই’
একটি রাষ্ট্র-সমর্থিত মানবাধিকার গোষ্ঠী জানিয়েছে, বিক্ষোভে কমপক্ষে ১০ জন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। অন্য একটি এনজিও জানিয়েছে, কমপক্ষে ২০ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
বিক্ষোভ কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে। প্রাবোও, যিনি শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন, মঙ্গলবার রাতে একটি বড় সামরিক কুচকাওয়াজে যোগ দিতে বেইজিং যাচ্ছেন। আগে তিনি এই সফর সাময়িকভাবে বিলম্ব করেন।
প্রাবোও বিক্ষোভের সময় ইন্দোনেশিয়ায় থেকে গিয়ে বলেন, কিছু বিক্ষোভকারীর কর্মকাণ্ড দেশদ্রোহিতা ও সন্ত্রাসের দিকে ঝুঁকছে।
নারী অধিকার নিয়ে পারেম্পুয়ান মহার্ধিকা নামের একটি সংগঠনে কাজ করা মুতিয়ারা ইকা প্রাতিভি বলেন, প্রাবোও যেভাবে বিক্ষোভকে বর্ণনা করেছেন, তা তাকে বিপর্যস্ত করেছে।
তিনি বলেন, জনগণ সমস্যা নয়। আমাদের বিক্ষোভ করার অধিকার আছে, কারণ আমাদের কণ্ঠ কখনও শোনা হয়নি।
গোলাপি ও সবুজ আন্দোলনকে নিয়ে প্রাতিভি বলেন, এটি শুধু রাগ নয়, এটি এক ধরনের সহমর্মিতা যা প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
‘গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি’
২৭ বছর বয়সী মুহাম্মদ দ্বিকি মাহেন্দ্রা জার্মানি থেকে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। সেখানে তিনি শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন নিয়ে মাস্টার্স করছেন।
তিনি এএফপিকে বলেন, আমি মনে করি এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি ভিত্তি, যা সরকারের প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে কাজ করছে। সরকার সাধারণত কমিউনিটি আন্দোলনকে বিদেশি শক্তি দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে করে।
তিনি আরও বলেন, সরকারের জনসংযোগ দুর্বল হয়েছে এবং বিদ্যমান সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান বা জবাব দেওয়া হয়নি।
গোলাপি-সবুজ আন্দোলনের অনুরাগীরা বলছেন, কেবল তখনই আসল পরিবর্তন সম্ভব।
ইনস্টাগ্রামে প্রোফাইল ছবি পাল্টাতে গিয়ে বেন্তেন প্রদেশের ২৫ বছর বয়সী স্পাতিকা উইনুরসিতা বলেন, যখন দেখি অন্যরাও ছবিতে একই ফিল্টার ব্যবহার করছে, তখন আমার বেশ ভালো লাগে।
তিনি বলেন, আমি খুশি যে আমরা একে অপরের পাশে আছি এবং আমাদের স্বপ্নের জন্য লড়াই করছি।
আরএইচ