নিউইয়র্ক: যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ১১ মিলিয়ন কাগজপত্রহীন (আনডকুমেন্টেড) অবৈধদের বৈধতা পাবার স্বপ্ন এবছরেই পূরণ হতে চলেছে। “এদেশে বসবাসকারী ১১ মিলিয়ন (১ কোটি ১০ লাখ) কাগজপত্রহীন অবৈধকে নাগরিকত্ব অর্জনের পথ করে দেবো” ----শনিবার হোয়াইট হাউজের সাপ্তাহিক ভাষণে এই ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
এর আগে মেক্সিকো সফরের শেষ দিন শুক্রবার দেশটির রাজধানীতে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে বারাক ওবামা সুস্পষ্ট করেই বলেছেন, তিনি নিশ্চিত যে এবছরই বিলটি পাশ করবে কংগ্রেস।
এদিকে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অনড় অবস্থানের সাথে এবার যোগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হেভিওয়েট টেকনোলজি কোম্পানিগুলো।
উত্থাপিত ‘ইমিগ্রেশন সংস্কার বিল’টি পাশে জোর লবিং শুরু করেছে তারা। রাজনৈতিক স্টাইলে বিজ্ঞাপন লবিংয়ে অর্থের যোগান দিচ্ছে সিলিকনভ্যালিভিত্তিক এসব কোম্পানি। এছাড়া বিশেষ করে নির্বাচনী রাজনীতিতে ইমিগ্র্যান্ট ভোটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রিপাবলিকান পার্টির ‘ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা’ সংস্কারে ইতিবাচক মনোভাব সুস্পষ্ট।
রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট দুদলের ৮ জন প্রভাবশালী সিনেটর একত্রিত হয়েই ’ইমিগ্রেশন সংস্কার বিল’ এর খসড়া উপস্থাপন করেছেন। ফলে প্রেসিডেন্ট ওবামার এবছরেই ’ইমিগ্রেশন সংস্কার বিল’ পাশের প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রুপ নিতে চলেছে বলে সংস্লিষ্ট সকল মহলই মনে করছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ১১ মিলিয়ন কাগজপত্রহীন অবৈধদের নাগরিকত্ব অর্র্জনের পথ করে দেবেন এই ঘোষণা দিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, “এমনটি ভাববার কোনো কারণই নেই যে, এবছরই ইমিগ্রেশন সংস্কার বিল পাশ হবে না। কারণ যে বিলটি সিনেটে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে সাধারণ জ্ঞানেরই প্রতিফলন হয়েছে। এ বিলটিতে কোনো পক্ষই সবকিছু পায়নি, এমনকি আমি নিজেও যা চেয়েছি তার পুরোটা আসে নি। কিন্তু প্রথম থেকে আমি যে নীতিমালার কথা বলে আসছি, তার সাথে এর সাদৃশ্য রয়েছে। ”
মেক্সিকো সিটিতে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ওবামা বলেন, এ বছরের মধ্যেই কংগ্রেসে পাস হবে ইমিগ্রেশন বিল।
কংগ্রেসে এ বছরের মধ্যেই বিলটি পাশ হয়ে যাবে বলে তিনি সন্দেহমুক্ত। তার বক্তব্যে রিপাকলিকানদের সঙ্গে নিয়ে আর কাজ করার প্রত্যয় ফুটে উঠছিলো। দুই দিনের সফরে মেক্সিকো অবস্থান করছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা।
সেখানেই তিনি প্রথমবারের মতো এতটা নিশ্চিত ভাবে জানালেন এবছরের মধ্যেই নতুন অভিবাসন আইন পাশ হয়ে যাওয়ার কথা। নতুন এ আইনে যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে অবৈধভাবে বসবাসকারী কয়েক মিলিয়ন মানুষ বৈধতা পেতে যাচ্ছে।
ডিপোর্টেশনের কালোছায়া সরে যাবে।
ওবামা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ছেলেবেলায় এসে এখন তারুণ্যে বা যৌবনে উপনীত হয়েছে এমন ছেলেমেয়েদের ওপর থেকে ‘ডিপোর্টেশনের কালো ছায়াটি’ এখন সরে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিতে আরও কিছু সমন্বিত পরিবর্তন এনে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। ওবামা বলেন, বছরের পর বছর ধরে কাজ করে আমরা এবছর আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। আমি পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত যে এ বছরই কংগ্রেস বিলটি পাশ করবে। ওবামা এসময় আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অভিবাসন পদ্ধতি দেশের মূল্যবোধকে সঠিকভাবে তুলে ধরে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বর্তমান পদ্ধতির কারণেই লাখ লাখ মানুষ তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। এছাড়া লাখ লাখ মানুষের ওপর সবসময়ই একটি কালো ছায়া পড়ে রয়েছে যা তাদের জীবন ও জীবীকাকে অনিশ্চিত করে রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধ এটা সমর্থন করতে পারে না।
সাধারণ জ্ঞানের বিল
প্রেসিডেন্ট ওবামা আরো বলেন, এই বিল যুক্তরাষ্ট্রের বৈধ ইমিগ্রেশন ব্যবস্থাকে আরো আধুনিক করবে এবং এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভালো বেতনের কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ করে দেবে। বারাক ওবামা বলেন, ‘সাধারন জ্ঞানের বিল’টি সিনেটে উপস্থাপন হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই এই পদক্ষেপ সমর্থন করছে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ১১ মিলিয়ন কাগজপত্রহীন অবৈধদের নাগরিকত্ব অর্র্জনের পথ করে দেবে এই বিল। তার মতে, এই বিল পাশ হলে সীমান্তকে আরো নিরাপদ করবে এবং কাগজপত্রহীন অবৈধদেরকে চাকুরি দেয়ার ক্ষেত্রে মালিকদের জবাবদিহিতা আরো নিশ্চিত করবে।
মেক্সিকো সিটিতেও তিনি বলেন, আমি কংগ্রেসের সঙ্গে কাজ করছি যেন একটি সাধারণ বুদ্ধির অভিবাসন নীতি এ বছরের মধ্যেই পাশ করা হয়। আমরা যাতে আনন্দ করতে পারি। আর আমি নিশ্চিত যে আমরা তা করতে পারবো।
সীমান্তবর্তী দেশ মেক্সিকো থেকেই কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে অবৈধ পথে বিপুল সংখ্যক মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ করেছে। তাদের প্রসঙ্গ টেনে প্রেসিডেন্ট ওবামা হোয়াইট হাউজের সাপ্তাহিক ভাষণে বলেন. সত্য হলো, অতীতের চেয়ে বর্তমানে মেক্সিকো সীমান্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এখন সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। বিগত ২০০০ সালের তুলনায় এরই মধ্যে অবৈধদের প্রবেশে-সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ কমেছে। কিন্তু আরো অনেক কিছু করার রয়েছে কারণ ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছে।
কেন অর্থ ঢালছে সিলিকন ভ্যালির বাঘা কোম্পানিগুলো?
এদিকে খুবই সুকৌশলে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির বড় বড় টেকনোলজি কোম্পানি এবং তাদের সিনিয়র এক্সিকিউটিভরা বিজ্ঞাপনের লবিং ক্যাম্পেইন মাধ্যমে ‘ইমিগ্রেশন সংস্কার বিল’ কে স্পন্সর করতে শুরু করেছে। ‘আমেরিকানস ফর কনজারভেটিভ’ নামে নিজেদেরকে অবিহিত করা যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির সিনিয়র এক্সিকিউটিভদের নতুন একটি গ্রুপ ‘ইমিগ্রেশন সংস্কার বিল’ পাশে অর্থ ঢালছে করছে কারণ, কংগ্রেসে অপেক্ষমান ‘ইমিগ্রেশন সংস্কার বিল’ এ তারা তাদের কোম্পানিগুলোর হাজার হাজার খালি পদে বিদেশি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগের সুবিধা নিশ্চিত করতে পারবে। যা তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে গভীর প্রভাব রাখবে।
‘আমেরিকানস ফর কনজারভেটিভ’ নামের সিলিকন ভ্যালির সিনিয়র এক্সিকিউটিভদের মধ্যে ফেসবুকের মার্ক জুকারবার্গ এবং লিঙ্কডইনের রিড হফম্যানের মতো ব্যক্তিরাও রয়েছেন, যাদের কর্মীদের বেশীরভাগই ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক।
সিলিকন ভ্যালির টেকনোলজি কোম্পানি এবং তাদের সিনিয়র এক্সিকিউটিভদের এই খবর নিউইয়র্ক টাইমসও ফলাও করে প্রকাশ করেছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে আরো বলা হয়েছে ,ইউএস চেম্বার অব কমার্স এবং হেভিওয়েট টেকনোলজি’ কোম্পানিগুলো ‘ইমিগ্রেশন সংস্কার বিল’টি পাশের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা ’ইমিগ্রেশন সংস্কার বিল’এর প্রস্তাবনায় বিদেশি কর্মী নিয়োগের এবং আমেরিকান কর্মীদের ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার ক্ষেত্রেও সমঝোতায় পৌঁছানোর ব্যপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছে।
তবে একই সাথে ভারতসহ অন্যান্য দেশের কন্সালটিং কোম্পানিগুলো অস্থায়ীভাবে বিদেশি কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে আরো কঠোর আইন প্রনয়নে প্রকাশ্যেই আইন প্রনেতাদেরকে উৎসাহিত করছে। যারা বিলটির খসড়া করেছেন তাদের কাছে ‘আমেরিকান টেকনোলজি’ কোম্পানিগুলোর বিশেষ যোগাযোগেই এই সমঝোতায় পৌছানো হয়েছে বলেও সিনেটের সমঝোতাকারীরা স্বীকার করেছেন। কোম্পানিগুলো প্রায়শই আগে ভাগেই জেনে যাচ্ছে, ‘৮ সিনেটরের গ্যাং’ কি কি বিষয় নিয়ে কাজ করছেন।
বাংলাদেশ সময় ০১৪৩ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৩
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর