ঢাকা: সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর প্রথমবারের মতো এ নিয়ে মুখ খুললেন ইতালিভিত্তিক আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড বেনেটনের প্রধান নির্বাহী বিয়াজিও কিয়ারোলাঞ্জা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য হাফিংটোন পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেন, রানা প্লাজায় অবস্থিত নিউ ওয়েভ স্টাইল গার্মেন্টস থেকে তারা পোশাক কিনেছেন।
কিয়ারোলাঞ্জা বলেন, “দুর্ঘটনার সময় নিউ ওয়েভ আমাদের সরাসরি সাপ্লায়ার ছিল না। একটি ভারতীয় সাপ্লায়ার তাদের সাব-কন্ট্র্যাকে দু’টি অর্ডারের কাজ দিয়েছিল। ”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেনেটনের এক কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, বেনেটনের ওই ভারতীয় সাপ্লায়ারের ঠিকভাবে অর্ডার সম্পন্ন করতে সমস্যা হচ্ছিল, তাই তারা অর্ডারের একটি অংশ বাংলাদেশের কয়েকটি কারখানার মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছিল। নিউ ওয়েভ ছিল তার মধ্যে একটি।
তবে কিয়ারোলাঞ্জা জানান, তার কোম্পানি বাংলাদেশে পোশাক তৈরি বন্ধ করবে না। এর কারণ হিসেবে তিনি যোগ করেন, দরিদ্র দেশগুলোর শ্রমিকদের সাহায্য করার জন্য তাদের চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ত্যাগ করা বা ভবিষ্যতে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনো সমাধান নয়। আমি ওই অঞ্চলে জীবনের কিছু সময় কাটিয়েছি। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, বেনেটনসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর এসব দেশের পরিস্থিতি উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমাদের একটি নিরাপদ ও সুস্থ কাজের পরিবেশ প্রয়োজন। ”
তিনি জানান, নিউ ওয়েভ থেকে তারা খুবই অল্প পরিমাণ কাজ করিয়েছেন। ২০১২ সালের ডিসেম্বর ও ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে তারা ২ লাখ শার্টের মতো বানিয়েছেন সেখানে। শার্টগুলো রানা প্লাজায় তৈরি হয়ে তাদের ভারতীয় সাপ্লায়ারের কাছে পৌঁছায়, যেখান থেকে বেনেটনের সব আউটলেটে সরবরাহ করে দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর এতে অবস্থিত কারখানার সঙ্গে বেনেটনের সম্পর্ক নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন বেনেটনের সমালোচনা করে অভিযোগ করে, দরিদ্র দেশগুলোর কম-মজুরি দেওয়ার সুযোগ নিয়ে তারা মুনাফা অর্জন করছে। এর প্রেক্ষিতেই নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করার জন্য হাফিংটন পোস্টকে এ সাক্ষাৎকার দেন বেনেটনের প্রধান নির্বাহী।
রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর প্রাথমিক এক বিবৃতিতে বেনেটন দাবি করেছিল, এর কোনো কোম্পানির সঙ্গে বেনেটনের কোনো সাপ্লায়ার বা ব্র্যান্ডের সম্পর্ক নেই। কিন্তু পরবর্তীতে ধ্বংস্তুপের ছবিতে বেনেটনের লেবেল দেখা যায়। এরপর বেনেটন ওই ভবনের একটি কারখানা থেকে একবার কাজ করানোর বিষয়টি স্বীকার করে। তারা অজুহাত হিসেবে জানায়, জটিল ও বিস্তৃত সাপ্লাই চেইনের কারণে এ সংক্রান্ত তথ্য খুঁজে পেতে সময় লেগেছে।
বেনেটনের প্রধান নির্বাহীর মতে, তারা অর্ডার দেওয়ার আগে নিউ ওয়েভকে যাচাই করে নিয়েছিলেন। সেই যাচাই-বাছাইয়ের মধ্যে ছিল কারখানাটি পণ্যের গুণগত মান রক্ষা করে কিনা, সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করে কিনা ও সেখান কাজের পরিবেশ নিরাপদ কিনা। সর্বোচ্চ মান ও প্রয়োজনীয় স্ট্যান্ডার্ড নিশ্চিত না করায় ভবন ধসে পড়ার এক মাস আগেই নিউ ওয়েভে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছিল বেনেটন। তবে অল্প কাজ করানোয় নিউ ওয়েভের শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে বিস্তারিত কোনো অনুসন্ধান বা সামাজিক অডিট চালানো হয়নি বলে স্বীকার করেন তিনি।
এছাড়া স্প্যানিশ খুচরা পোশাক বিক্রেতা ম্যাঙ্গোও রানা প্লাজার একটি কারখানা থেকে পোশাকের স্যাম্পল কেনার উদ্যোগ নিয়েছিল। হাফিংটন পোস্টকে দেওয়া এক বিবৃতিতে ম্যাঙ্গো স্বীকার করে, তারাও এর আগে কোনো সামাজিক অডিট চালায়নি। তাদের পক্ষে ভবনের গঠনগত ত্রুটি শনাক্ত করা সম্ভবও ছিল না বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে বেনেটন আরও জানিয়েছে, কারখানার ভবনটি যে ঝুঁকিপূর্ণ, তা তাদের জানা ছিল না। স্থানীয় সরকারি সংস্থাগুলোর নথিপত্রেও এমন কোনো ত্রুটি বা ঝুঁকির কোনো উল্লেখ ছিল না। তবে এরপর থেকে বেনেটনের পণ্য যেসব কারখানা ভবনে উৎপাদিত হবে, সেসবের ভবনের নিরাপত্তাও পরীক্ষা করা হবে।
বেনেটনের মতে, তাদের মোট পণ্যের ২ থেকে ৪ শতাংশ বাংলাদেশে তৈরি হয়। তারা অর্ধেক পণ্যের উৎপাদন সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে, বাকি অর্ধেকের জন্য সাপ্লায়ারদের উপর নির্ভর করে।
বেনেটনের বাংলাদেশে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে কিয়ারোলাঞ্জা জানান, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশেও উৎপাদন প্রয়োজন। এর ফলে বেনেটন আরও দ্রুত পণ্য তৈরি করে বিশ্বের বিভিন্ন আউটলেটে সরবরাহ করতে পারবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, লাওস ও মিশরে কম মজুরি থাকলেও বৃহত্তর এশিয়ার বাজারের জন্য বাংলাদেশের বিকল্প নেই, বিশেষ করে টি-শার্টসহ সাধারণ পোশাকের ক্ষেত্রে।
তবে শ্রমিক অধিকার কর্মীরা বেনেটনের নিছক ওয়াদায় সন্তুষ্ট নয়। তারা দ্রুত এসবের বাস্তবায়ন দাবি করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৩ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৩
সম্পাদনা: হাসান শাহরিয়ার হৃদয়, নিউজরুম এডিটর