ঢাকা: ভারতের গর্ভ ভাড়া (সারোগেসি) বাণিজ্যিক রূপ লাভ করেছে। দিনকে দিনকে মুনাফা অর্জনের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে সারোগেসি।
বংশগতভাবে সম্পর্ক নেই এমন কোনো নারীর গর্ভে অন্য দম্পতির সন্তান ধারণ ও জন্ম দানের ব্যবস্থা সারোগেসি নামে পরিচিত। সারোগেট মায়ের গর্ভে অন্য দম্পতির ভ্রুণ নিষিক্ত করা হয়।
সারোগেসি ব্যবসার মাধ্যমে ভারত বাৎসরিক ১০০ কোটি ডলার আয় করছে। গর্ভবতী অবস্থায় সারোগেট মায়েদের আশ্রয় কেন্দ্রে থাকতে হয়। সেখানে তাদের সন্তান জন্ম দেওয়ার আগ পর্যন্ত থাকতে হয়। কর্তৃপক্ষের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়।
১৮ বছরের বাসন্তী একজন সারোগেট মা। তিনি বলেন, ভারতে সম্পর্ক ও পরিবারের বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়। একটি শিশুর জন্য একজন যেকোনো কিছু করতে পারে। আমি সারোগেট মা হয়েছি যেন আমার শিশুকে শ্রেষ্ঠ জীবন দিতে পারি, যেটির স্বপ্ন আমি দেখি।
বাসন্তী এখন গর্ভবতী। কিন্তু তার গর্ভে যে শিশু সেটি তার নয়। এটি জাপানি এক দম্পতির। গর্ভ ভাড়া দেওয়ার জন্য আট হাজার মার্কিন ডলার পাবেন তিনি। এতো টাকা বাসন্তীর কাছে স্বপ্নের মতো। গরিব বাসন্তী এখন নতুন বাড়ি গড়েছেন। তার পাঁচ ও সাত বছরের শিশু দুটি স্কুলে পাঠাতে পারছেন।
অর্থের বিনিময়ে গর্ভভাড়া দেওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখেন বাসন্তী।
গুজরাটের আনন্দ শহরের আকাঙ্ক্ষা আইভিএস সেন্টারে ইনজেকশনের মাধ্যমে জাপানি দম্পতির ভ্রুণ তার গর্ভে দেওয়া হয়। আইভিএস সেন্টারে নির্দেশিত একটি আশ্রয় কেন্দ্রে তাকে পাঠানো হয়। সেখানে তাকে নয় মাস থাকতে হবে।
ওই আশ্রয় কেন্দ্রে বাসন্তীর মতো ১০০ জন সারোগেট মা থাকেন। তারা সবাই রয়েছেন গাইনিকোলজিস্ট ডা. নায়না প্যাটেলের তত্ত্বাবধানে।
আশ্রয় কেন্দ্রের প্রতিটি কক্ষে ১০ জন করে সারোগেট মা থাকেন। তাদেরকে নিয়মিত খাবার ও ভিটামিন সরবরাহ করা। কেমন করে চলাফেরা করবে, কখন কি করবে, কখন বিশ্রাম নেবে-সবকিছুই নির্দেশনা মতো করতে হয়।
কিন্তু বাসন্তী মাঝে মাঝে নির্দেশনা মানেন না। তিনি বলেন, আমি এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াই কেননা রাতে আমি ঘুমোতে পারিনা। গর্ভের শিশু বেড়ে উঠায়, আমার বিরক্তি শুরু হয়ে গেছে। আমি খুব দ্রুত বাড়ি যেতে চাই, আমরা স্বামী-সন্তানদের কাছে ফিরে যেতে চাই।
আশ্রয় কেন্দ্রের নিয়ম অনুসারে, গর্ভাবস্থায় থাকার সময় পুরুষের সঙ্গে মেলামেলা করা যাবে না।
সফলভাবে শিশুর জন্ম হলে ভ্রুণদাতা দম্পতির কাছ থেকে ১৮ হাজার মার্কিন ডলার নিয়ে সারোগেট মাকে দেন।
কিন্তু সারোগেট মার কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর দায়ভার চিকিৎসক কিংবা ভ্রুণদাতা দম্পতি নেন না।
যেমন নির্দিষ্ট সময়ের আগে কোনো মা যমজ শিশুর জন্ম দিলে তিনি ১০ হাজার মার্কিন ডলার পান। কিন্তু গর্ভের প্রথম তিন মাসের মধ্যে গর্ভপাত হলে তাকে দেওয়া হয় মাত্র ৬শ মার্কিন ডলার।
ভারতে গর্ভ ভাড়া দেওয়া দ্রুত বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে সারোগেসির জন্য স্বল্প খরচ, মানসম্মত চিকিৎসা সেবা এবং সহায়ক আইনকে নিয়ামক হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
ভারতে সন্তান জন্ম দিলেও সে সন্তানের ওপর কোনো অধিকার থাকে না সারোগেট মায়ের। এমনকি সন্তান জন্ম দেওয়ার পর সারোগেট মায়ের সেবাও আশা করা হয় না। তাই সহজে অনেকে সারোগেট মায়ের দায়িত্ব কাঁধে নিতে চান।
কিন্ত পাশ্চাত্যে সারোগেট মাকেই সন্তানের প্রকৃত মা ভাবা হয়। এমনকি বায়োলজিক্যাল মা হিসেবে শিশুর জন্ম সনদেও সারোগেট মায়ের নাম লেখা থাকে।
বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গরিবে বাস ভারতে। নিন্দুকে ধারণা, এই দরিদ্রতার সুযোগ নিয়েই তাদের এ ধরনের অভিশাপ ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
প্যাটেলও বলেন ভারতে অসংখ্য গরিব নারী রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দেশে প্রত্যেকের জন্য খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক ও চিকিৎসাসেবা কারও জন্য ফ্রি নয়।
ডা. নায়না প্যাটেল স্বীকার করেন, তার এ পেশা ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, কাজের সময় আমি অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছি এবং সামনে আরও সমস্যার মুখোমুখি হবো কেননা আমাদের কাজটি খুবই বিতর্কিত।
প্যাটেলের মতে, নিন্দুকরা আশ্রয় কেন্দ্রকে ‘শিশু জন্মের ও বিক্রির’ স্থান হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এমনকি কেউ কেউ একে ‘শিশু উৎপাদনের কারখানা’ বলেন।
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ আমাকে আঘাত করে। ’
নিন্দুকদের বক্তব্য, মুনাফার জন্য সারোগেট মায়েদের শোষণ করা হয়। কিন্তু এ অভিযোগ মানতে নারাজ প্যাটেল। বিশ্বের বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো, রাজনৈতিক দলগুলো বা গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রির চেয়ে আরও খারাপ বলে মন্তব্য তার।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি প্রত্যেকই তার নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য একে অপরকে ব্যবহার করছে। ’
তার তত্ত্বাবধানে সারোগেট মা’রা ভালোই রয়েছেন এবং ন্যায্য আচরণই পাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে থাকার সময় সেলাই, রান্নার কাজ শেখানো হয় তাদের। এখান থেকে চলে যাওয়ার পর সম্মানের সঙ্গে যেন নিজের ও পরিবারের অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে-সেজন্য তাদের এসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
অনেকে তৃতীয়বারের মতো গর্ভ ভাড়া দিতে চান। কিন্তু নিয়মানুযায়ী তাদের সে সুযোগটি দিতে পারেন না ড. নায়না প্যাটেল।
ভারতে গর্ভ ভাড়া নিয়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার চিকিৎসা কেন্দ্র বা ক্লিনিকের সংখ্যাও বাড়ছে। এসব ক্লিনিক গর্ভ ভাড়া নিয়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়ার জন্য মক্কেলদের কাছ থেকে ১০ থেকে ২৮ হাজার মার্কিন ডলার সেবা চার্জ নেন।
২০০৮ সালে এক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্যিক সারোগেসিকে বৈধতা দেয় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৩
এসএফআই/জেডএম/আরআইএস