ঢাকা: উপমহাদেশের কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে আর নেই। বৃহস্পতিবার ভোরে ব্যাfঙ্গালোরের একটি হাসপাতালে শতকোটি জনগণমননন্দিত এই শিল্পীর জীবনাবসান ঘটে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো জানিয়েছে, গত বেশ ক`মাস ধরে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি।
গত সেপ্টেম্বরে মান্না দে বুধবার শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা ও মূত্রাশয়ের রোগে আক্রান্ত হলে তাকে হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকদের সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে জীবনের সব পালা সাঙ্গ করে চলে যান উপমহাদেশের এই অসামান্য সঙ্গীত প্রতিভা। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঝরে পড়লো সঙ্গীতের এর ধ্রুবনক্ষত্র।
১৯১৯ সালের ১ মে কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে বাবা পূর্ণ চন্দ্র এবং মা মহামায়া দে’র ঘর আলো করে জন্ম নেন তিনি। আসল নাম প্রবোধ চন্দ্র দে হলেও দীর্ঘ ষাট বছরের সঙ্গীতমুখর জীবনে ‘মান্না দে’ ডাকনামেই খ্যাতি লাভ করেন তিনি
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ শীর্ষক বিখ্যাত গানের এই গায়ক বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, অসমিয়াসহ বিভিন্ন ভাষায় অজস্র গান গেয়ে বিশ্ব সঙ্গীতাঙ্গনে নিজের স্থান করে নিয়েছেন। বৈচিত্র্যের বিচারে তাঁকেই হিন্দি গানের ভুবনে সবর্কালের অন্যতম সেরা গায়ক হিসেবে স্বীকার করে থাকেন অনেক সঙ্গীতবোদ্ধা।
গায়ক হিসেবে আধুনিক বাংলা গানের জগতে সর্বস্তরের শ্রোতাদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয ও সফল সঙ্গীত-ব্যক্তিত্ব মান্না দে। বিশেষ করে, হিন্দি ও বাংলা সিনেমায় গায়ক হিসেবে অশেষ সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার এবং মুকেশদের মতো তিনিও ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অর্জন করেন। সঙ্গীত জীবনে তিনি সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেন।
দীর্ঘ প্রায় ষাট বছরের সঙ্গীত জীবনে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ এবং ২০০৫ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবসহ অসংখ্য খেতাব অর্জন করেন তিনি। এছাড়া, ২০০৪ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও ২০০৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ডি.লিট সম্মাননা লাভ করেন। ২০০৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে সম্মাননায় ভূষিত করে ভারত সরকার
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন্মের পর বাবা-মায়ের সংস্পর্শ ছাড়াও, পিতৃসম্বন্ধীয় সর্বকনিষ্ঠ কাকা সঙ্গীতাচার্য (সঙ্গীতে বিশেষভাবে দক্ষ শিক্ষক) কে.সি. দে (পূর্ণনাম: কৃষ্ণ চন্দ্র দে) তাকে খুব বেশি অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেছেন। ‘ইন্দু বাবুর পাঠশালা’ নামে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর স্কটিশ গির্জা কলেজিয়েট এবং স্কটিশ গির্জা কলেজে থেকে স্নাতক শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি তার সহপাঠীদের গান শুনিয়ে আসর মাতিয়ে রাখতেন। কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে এবং উস্তাদ দবির খাঁর কাছ থেকে গানের শিক্ষা লাভ করেন তিনি। ওই সময় আন্তঃকলেজ গানের প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিকভাবে তিন বছর তিনটি আলাদা শ্রেণীবিভাগে প্রথম হয়েছিলেন মান্না দে।
১৯৪২ সালে কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র সাথে মুম্বাই দেখতে যান তিনি। সেখানে শুরুতে কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র অধীনে সহকারী হিসেবে এবং তারপর শচীন দেব বর্মণ’র (এস.ডি. বর্মণ) অধীনে কাজ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অনেক স্বনামধন্য গীতিকারের সান্নিধ্যে আসেন এবং তারপর স্বাধীনভাবে নিজেই কাজ করতে শুরু করেন। ওই সময় বিভিন্ন হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি উস্তাদ আমান আলি খাঁ এবং উস্তাদ আব্দুল রহমান খাঁর কাছ থেকে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তামিল নেন মান্না দে।
১৯৪৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘তামান্না’ চলচ্চিত্রে গায়ক হিসেবে মান্না দে’র অভিষেক ঘটে। সুরাইয়া’র সঙ্গে দ্বৈত সঙ্গীতে গান এবং সুরকার ছিলেন কৃষ্ণ চন্দ্র দে। ওই সময় গানটি ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৫০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মশাল’ ছবিতে শচীন দেব বর্মণের গীত রচনায় ‘ওপার গগন বিশাল’ নামে একক গান গেয়েছিলেন মান্না দে। এ গানের কথা লিখেছিলেন কবি প্রদীপ। ১৯৫২ সালে মান্না দে বাংলা এবং মারাঠী ছবিতে একই নামে এবং গল্পে ‘আমার ভূপালী’ শীর্ষক একটি গান গান। এসবের মধ্য দিয়েই সঙ্গীতাঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ও পাকাপোক্ত করেন তিনি এবং জনপ্রিয় গায়ক হিসেবে সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পান।
মান্না দে ভীমসেন যোশী’র সঙ্গে একটি জনপ্রিয় দ্বৈত গান ‘কেতকী গুলাব জুহি’ গান। এছাড়াও, তিনি কিশোর কুমারের সাথে আলাদা গোত্রের দ্বৈত গান হিসেবে ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোরেঙ্গে (শোলে)’ এবং ‘এক চতুর নার (পদোসান)’ গান। এছাড়াও, মান্না দে শিল্পী ও গীতিকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়সহ (হেমন্ত কুমার) আরও বেশকিছু গীতিকারের সঙ্গে বাংলা ছবিতে গান গেয়েছিলেন। দ্বৈত সঙ্গীতে লতা মুঙ্গেশকারের সঙ্গে ‘কে প্রথম কাছে এসেছি (শঙ্খবেলা)’ গান করেছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতসহ প্রায় ৩,৫০০ গান গেয়েছেন এই সঙ্গীতজ্ঞ।
১৯৫৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর দক্ষিণাঞ্চলের কেরালার মেয়ে সুলোচনা কুমারনকে বিয়ে করেন মান্না দে। তাদের সংসারে শুরোমা (১৯৫৬) ও সুমিতা (১৯৫৮) নামে দুই কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তবে, গত বছরই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান সুলোচনা।
পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুম্বাইয়ে কাটানোর পর মৃত্যুর আগে কয়েক বছর ধরে ব্যাঙ্গালোরের কালিয়ানগর শহরে বসবাস করছিলেন মান্না দে।
২০০৫ সালে আনন্দ প্রকাশনীর বাংলাভাষায় তার আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ প্রকাশ করে। পরে এটি ইংরেজীতে ‘মেমরিজ কাম অ্যালাইভ’, হিন্দিতে ‘ইয়াদেন জি ওথি’ এবং মারাঠী ভাষায় ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে ভাষান্তরিত হয়ে প্রকাশিত হয়।
মান্নাদের জীবনী নিয়ে ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে একটি তথ্যচিত্র মুক্তি পায় ২০০৮ সালে। মান্নাদে সঙ্গীত একাডেমী তার সম্পূর্ণ আর্কাইভ বিকশিত ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে।
প্রখ্যাত রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় মান্না দে’র সঙ্গীত সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।
দীর্ঘ প্রায় ষাট বছরের সঙ্গীত জীবনে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ এবং ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবসহ অসংখ্য খেতাব অর্জন করেন তিনি। এছাড়া, ২০০৪ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও ২০০৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ডি.লিট সম্মাননা লাভ করেন।
``তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী/আমি অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি``---মান্নাদের মৃত্যুর বহু-বহু যুগ পরও উপমহাদেশ নানা ভাষার সঙ্গীত পাগল মানুষ এই মহান সঙ্গীতগুরুর কিন্নর কণ্ঠ নরম নীরব হয়ে শুনে যাবে। কেবল শুনেই যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৩
এসএটি/এইচএ/জিসিপি/জেএম
মান্না দে’র জনপ্রিয় গান শুনতে ক্লিক করুন বাংলানিউজরেডিও২৪ এ