নিউইয়র্ক: সাংবিধানিক আইনের অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটিয়ে নতুন ইতিহাসের সূচনা করলো যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটরা। অনেক জল্পনা-কল্পনার পর গত বৃহস্পতিবার দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষ সিনেটে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদের ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রধান অস্ত্র খ্যাত ‘ফিলিবাস্টার আইন’ (বিরোধী পর্বের অনির্দিষ্ট কাল বক্তৃতা দেয়ার কৌশল) বাতিল করে আইন পাস হয়েছে।
এই আইন পাসের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ওবামার ‘চেঞ্জ উই নিড’ শীর্ষক নির্বাচনী শ্লোগানের সেই পরিবর্তনেরই পথে নতুন ধারার সূচনা হবে। যদিও পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ঘরেই উঠবে এই পরিবর্তনের ফসল। ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের প্রতিটি কর্মসূচির বিরুদ্ধে রিপাবলিকানদের অব্যাহত বাধায় অতিষ্ট প্রেসিডেন্ট ওবামা ফিলিবাস্টার রোহিত করা ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই নতুন আইনটিতে সমর্থন দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট ওবামার ইমিগ্রেশন সংস্কার বিল, স্বাস্থ্যবীমা নীতি থেকে শুরু করে সর্বশেষ প্রেসিডেন্টের ‘বিচারিক ও প্রশাসনিক মনোনয়ন’র বিরুদ্ধেও রিপাবলিকানদের এই ‘ফিলিবাস্টার আইনের অপপ্রয়োগে’ অতিষ্ট হতে হয় ডেমোক্রেটদের। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ দিনের এই আইনটিই রোহিত করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ ডেমোক্রেটরা।
আইনটি পাসের মধ্য দিয়ে ইমিগ্রেশন সংস্কার বিল, স্বাস্থ্যবীমা নীতি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই প্রেসিডেন্ট ওবামা তথা ডেমোক্রেটদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগেই সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকাকালে প্রেসিডেন্ট ওবামা বিশেষ করে ইমিগ্রেশন সংস্কার বিল ও স্বাস্থ্য বীমা তথা বহুল আলোচিত ’ওবামাকেয়ার’কে বাস্তবে রূপ দেবেন।
গত বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে ডেমোক্রেট সদস্যরা ৫২-৪৮ ভোটে ফিলিবাস্টার আইনের মৌলিক এই পরিবর্তন আনেন। বিচারিক ও প্রশাসনিক মনোনয়নে প্রেসিডেন্ট ওবামার ২১ জন মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে ফিলিবাস্টার’র ব্যবহার প্রবাদের ঠিক ‘বজ্র আটুনি ফস্কা গেরো’র মতই।
প্রেসিডেন্ট ওবামা হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করতে গিয়ে বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেটর এবং আমি নিজেও মনে করি এ ভোট এ বার্তাই দিয়েছে ‘এনাফ ইজ এনাফ’, অনেক সহ্য হয়েছে আর নয়।
শুধুমাত্র বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা স্বাভাবিক নয় উল্লেখ করে ওবামা বলেন, ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্টকে জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলেও তার রাজনীতির বিরোধিতায় রিপাবলিকানরা হিংসাত্মক ও লাগামহীনভাবে ‘ফিলিবাস্টার’কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যক্তি ওবামার যোগ্যতাকে নয়, প্রেসিডেন্টের যোগ্যতাকে রুদ্ধ করা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ওবামা তার প্রতিক্রিয়ায় আরও বলেন, এর ‘মেরিট’ যতটুকুই থাক বা না থাক, শুধু একটি নির্বাচনের (প্রেসিডেন্সিয়াল) ফলাফলকে পুনরায় চ্যালেঞ্জ করাটা স্বাভাবিক নয়।
তিনি বলেন, যদিও দুই দলই অতীতে প্রেসিডেন্টের মতামতের বিরুদ্ধে একবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে ফিলিবাস্টার আইনের ব্যবহার করেছে, কিন্তু বর্তমানে বিরোধিতা যে পর্যায়ে এসেছে সেটা ‘জাস্ট ইজ নট নরমাল। ’ ফিলিবাস্টার’র অপপ্রয়োগ করে রিপাবলিকানরা একের পর এক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে গেছে, অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে এবং গণতন্ত্রকেও আহত করেছে।
উল্লেখ্য, মাত্র কিছুদিন আগেই রিপাবলিকানরা কয়েক সপ্তাহের জন্য সরকার অচল (শাটডাউন) করে দিয়েছিল।
ফিলিবাস্টার আইনে ১০০ আসনের সিনেটে ৪১ জন সিনেটর সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও ৫৯ জনের বিরুদ্ধে যেকোনো বিল বা সিদ্ধান্তই সিনেটে আটকে দিতে পারে। অর্থাৎ ৫১ জনের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্টতা থাকলেও কোনো আইন ৪১ জনের বিরোধিতায় মুখে পাস করা সম্ভব নয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, একজন মাত্র সিনেটরও যে কোনো আইনকে আটকে দিতে পারে।
ফিলিবাস্টার আইন অনুসারে যেকোনো আইন পাসে ন্যূনতম ৬০ জন সিনেট সদস্যের সমর্থন আবশ্যক হবে। মূলত সিনেটে সংখ্যালঘু দলের সাংবিধানিক অধিকার ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায়ই এই আইন প্রচলিত ছিল। বর্তমানে ৫৫ জন সদস্য নিয়ে ডেমোক্রেটরা সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
কিন্তু ডেমোক্রেটদের দৃষ্টিতে সিনেটের ৪৫ জন রিপাবলিকান সদস্যই গণতন্ত্রকেই নুইয়ে দিচ্ছেন।
ডেমোক্রেট নেতারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে সিনেটের এ মেয়াদে রিপাবলিকানরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও ফিলিবাস্টার আইনের ক্ষমতা ব্যাবহার করে কার্যত প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রতিটি পদক্ষেপকেই আটকে দিয়েছেন, যা ডেমোক্রেটদের বিস্মিতই শুধু করেনি, বরং ভবিষ্যতে অকল্পনীয় কিছু দেখার আশংকাও জাগিয়েছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ওবামা’র এই কঠোর পদক্ষেপ ভবিষ্যতে বিচারিক ও নির্বাহী পদে প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে মনোনয়নের ক্ষেত্রে রিপাবলিকানদেরকে আরও বেশি প্রতিহিংসাপরায়ন করে তুলতে পারে।
রিপাবলিকান দলের নেতা ক্যান্টাকি রাজ্যের সিনেটর মিচ ম্যাকনল ফিলিবাস্টার আইন রোহিত করার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, কংগ্রেসে বিরোধী দলের অধিকার সংরক্ষণের এই ‘ঢাল’ ধ্বংস করার জন্য ডেমোক্রেটদের পস্তাতে হবে এবং সেটা যতটা দূরে মনে করা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক আগেই হতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৩