ফেসবুকে আমার দেয়াল থেকে একটি ছবি প্রত্যাহার করে নিয়েছি। সারিবদ্ধ একদল শিশুর লাশের ছবি।
ফেসবুকে আরেকটি ছবি প্রচারিত হচ্ছে। একটি আতঙ্কিত ছোট্ট শিশুর মুখে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে রেখেছে একদল বন্দুকধারী। তাদের শুধু পায়ের নিম্নাংশ দেখা যাচ্ছে। একজনের আবার পরনে স্যান্ডেল এবং প্যান্টের একটি পা গুটানো। ইসরাইলি সৈন্যদের নির্মমতার স্বাক্ষর হিসেবে এ ছবি দেখানো হচ্ছে। একটু ভালো করে দেখলেই বোঝা যাবে হয়, এ ছবি অদক্ষ হাতে ফটোশপ করা অথবা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো দেশের অন্তর্কলহের চিত্র। প্রোপাগান্ডার উদ্দেশ্যে বানানো কোনো বিজ্ঞাপনচিত্র হওয়ার সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কিন্তু এ ছবিগুলো মিথ্যে বা ফটোশপ করা হওয়া মানে কি গাজা এবং অন্যান্য অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইলি আগ্রাসন এবং বর্বরতা হচ্ছে না? অবশ্যই হচ্ছে। শুধু আজ নয়, দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনে চলছে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। এ কথা আমাদের কারো অজানা নয়, নতুন করে প্রমাণেরও অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে তা ঘটছে মিডিয়ার ক্যামেরার মাধ্যমে একেবারে আমাদের চোখের সামনেই।
এ হত্যাযজ্ঞ প্রমাণ করতে কি ফটোশপ করা বানানো ছবির প্রয়োজন আছে? এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ন্যায়সঙ্গত আহাজারিকেই কি ছোট করা হচ্ছে না? ফিলিস্তিনের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের সংগ্রামকে যৌক্তিক আর ইসরাইলের অত্যাচারকে প্রতিহত করতে মিথ্যে প্রোপাগান্ডা কি এতোই জরুরি। এসব মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছাড়া ইতিহাস কি ফিলিস্তিনের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে না?
ফেসবুক এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে অনেক সংবেদনশীল বন্ধু ইসরাইলের সাম্প্রতিক সহিংসতা বন্ধে জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানিয়ে স্বাক্ষর সংগ্রহ করছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি মহতি উদ্যোগ। কিন্তু তারা উল্লেখিত ছবি দু’টি ব্যবহার করছেন। এ আবেদনপত্র আদৌ জাতিসংঘে পৌঁছাবে কিনা আমি জানি না। যেখানেই পৌঁছাক না কেন, যদি দেখা যায় একটি সত্যি ঘটনাকে তুলে ধরতে গিয়ে তারা মিথ্যে প্রোপাগান্ডার ফটোশপ করা ছবি ব্যবহার করেছেন তবে সে আবেদনপত্রটি তেমন গুরুত্ব পাবে বলে মনে হয় না।
‘তথ্যগত মিথ্যাচারের’ অজুহাতে আবেদনপত্রটিই নাকচ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তাই প্রবল।
অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বর্তমান সহিংসতার শুরু হয়েছিল যখন তিনজন ইসরাইলি কিশোরকে অপহরণ করে খুন করা হয়। তার প্রতিশোধ হিসেবে একজন ফিলিস্তিনি কিশোরকে বর্বরভাবে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়।
এখন ফিলিস্তিনের প্রতিপক্ষ ইসরাইল প্রথম ঘটনার প্রোপাগান্ডার সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে। ইসরাইল যে দস্যুবৃত্তি করছে তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং বিশ্বমানবতার উচিত সমবেতভাবে তা রুখে দাঁড়ানো। কিন্তু ইসরাইলকে এ সুযোগটি ফিলিস্তিনের ‘হামাস’ করে দিয়েছে। এই হামাস তাদের উত্থানের পর শান্তি প্রক্রিয়াকে নতুন কোনো অগ্রগতিতো দিতেই পারেনি, বরং অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে ব্যহত করেছে আর ইসরাইলকে একের পর এক বর্বর হামলা চালানোর অজুহাত তৈরি করে দিয়েছে।
গত দুই দশক ফিলিস্তিনের নেতৃত্বের ইতিহাস কেবল সন্দেহ, অবিশ্বাস আর অন্তর্কলহের ইতিহাস। যার ফলে তাদের মুক্তি সংগ্রাম এগিয়ে যাওয়ার বদলে বারবার পিছিয়ে গেছে, মুখ থুবড়ে পড়েছে।
ইয়াসির আরাফাত ছিলেন তার সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ছাড়া প্রথম ও একমাত্র গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুকে ঘিরে অস্পষ্টতা ও সন্দেহ, এ প্রসঙ্গে নতুন নেতৃত্বের কোনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও বক্তব্যহীনতা, আরাফাত পরবর্তি শান্তি প্রক্রিয়ার স্থবিরতা, হামাসের উত্থানের মাধ্যমে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি বারবার ইসরাইলকে আলোচনার টেবিল থেকে সহিংসতায় ফিরে যাওয়ার অজুহাত সৃষ্টি করে দিয়েছে।
আরাফাত উত্তর ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে মারওয়ান বারগুতিকে সবচেয়ে বাস্তবানুগ, প্রজ্ঞাবান, ক্যারিশমাটিক ও গ্রহণযোগ্য নেতা বলে ধরা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তিনি বিনা বিচারে ইসরাইলের কারাগারে বন্দি আছেন। তার মুক্তির জন্য তেমন কোনো দাবি বা পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অথচ এ সংঘাতময় কয়েক বছরেও বহুবার দুই পক্ষের আলোচনা ও দর কষাকষি হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে, এমন কি বন্দি বিনিময়ও হয়েছে। অথচ মারওয়ান বারগুতিকে মনে করা হয় ইয়াসির আরাফাতের উত্তরসূরি যার মধ্যে বিভক্ত ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ করার সম্ভাব্যতা আছে। এমনকি ইসরাইলের উদারপন্থী মহলেও তিনি গ্রহণযোগ্য।
নেলসন ম্যান্ডেলা একবার বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ’। সেই ম্যান্ডেলাও ফিলিস্তিন সংকটে মধ্যস্থতা করার জন্য ইয়াসির আরাফাতের অনুরোধ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কারণ, ম্যান্ডেলা জানতেন যে, জাতি নিজেরাই যেখানে ঐক্যবদ্ধ নয় সেখানে এ মধ্যস্থতার চেষ্টা অর্থহীন এবং তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিন সমস্যার সামরিক সমাধান মোটেও সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অন্তর্ঘাত পরিহার করে ফিলিস্তিনিদের নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্পও নেই। তবে সবচেয়ে আগে যা করতে হবে তা হচ্ছে, ইসরাইলকে আগ্রাসন শুরু করা বা অব্যাহত রাখার কোনো অজুহাতই দেওয়া চলবে না। ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনের চারপাশে ঐক্যবদ্ধ আরব বিশ্ব একসঙ্গে দাঁড়ালেই কেবল ইসরাইলের আগ্রাসন মোকাবেলা করা যাবে। অন্যথায় এ অশুভ শক্তির আগ্রাসন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রতিষ্ঠিত সত্যকে ফটোশপ করা মিথ্যে প্রোপাগান্ডা দিয়ে মোকাবেলা করার চেষ্টা করে লাভ নেই।
আমরা অলরেডি কনভিনসড। আমাদের কনভিন্স করার জন্য মিথ্যে প্রচারের প্রয়োজন নেই। সামনের কঠিন লড়াইটিকে দয়া করে কেউ খেলো করবেন না।
**গাজায় হামলা: সোশাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড়
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫২ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৪