ঢাকা: দীর্ঘদিন ধরেই অপরিশোধিত তেলের বাজারে সৌদি আরবের একচেটিয়া আধিপত্য। রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশ সৌদির সঙ্গে পেরে ওঠেনি এতোদিন।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে বর্তমানে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৪৪ ডলার (সাড়ে ৩ হাজার টাকা) থেকে ৪৮ ডলারের (৩ হাজার ৮শ’ টাকা) মধ্যে ওঠানামা করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, তেলের দামে এই মন্দাবস্থার পেছনে সৌদি আরবের রয়েছে প্রধান ভূমিকা।
২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, দিনে ১ কোটির বেশি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করে সৌদি আরব। প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলতে গত বছর থেকেই তেল উৎপাদন বাড়িয়ে সরবরাহে তারল্য ধরে রেখেছে দেশটি। তবে এ নীতি কোনো কাজেই আসেনি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
হাতছাড়া হচ্ছে অপরিশোধিত তেলের বাজার:
এশিয়া সবসময়ই সৌদি তেল বাণিজ্যের সবচেয়ে লাভজনক বাজার। তবে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এ বাজার হাতছাড়া হতে আর বেশি দেরি নেই। এরই মধ্যে নাইজেরিয়া, ইরাক, মেক্সিকো ও ভেনেজুয়েলা থেকে তেল আমদানি শুরু করেছে ভারত। অথচ দেশটি এর আগে সৌদি তেলের অন্যতম ক্রেতা ছিল।
সৌদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যতোটা ভাবা হয়েছিলো, ওপেকের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন দেশগুলো তেলের দাম নিম্ন রাখতে ততোটা আগ্রহী নয়। অন্তত স্বল্প-মেয়াদে তো নয়ই। নতুন কূপ খননের চেয়ে তেলের সরবরাহ কমিয়ে আনাই বেশি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হবে।
তেল উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ‘ওপেক’ নামে পরিচিত। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১২। এগুলো হলো- ইরান, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নাইজেরিয়া, ভেনেজুয়েলা, আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গেলা ও ইকুয়েডর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ প্রতিবেদনেই বোঝা যায়, বাজার থেকে প্রতিযোগীদের, বিশেষ করে মার্কিন সস্তা শেল তেল কোম্পানিগুলোকে হটিয়ে দিতে সৌদি আরবের অস্বাভাবিক উচ্চহারে তেল উৎপাদন নীতি কোনো কাজেই আসেনি। উল্টো মার্কিন শেল তেলের প্রতিবন্ধকতাগুলো কেটে যেতে শুরু করেছে। মাঝে কিছু প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার মুখে পড়লেও তা কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি। উল্টো বড় প্রতিযোগীরা ছোট প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিনে নিয়েছে।
পরিশোধিত তেলেও পড়েছে প্রভাব:
পরিশোধিত তেলের বাজারের দিকে নজর দিলেও সৌদি আরবের পতন নজরে পড়ে। বাজার ধরে রাখতে এখানেও রাজকীয় সরকার রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেছে। এশীয় তেল পরিশোধন শিল্পের সঙ্গে চলছে এ লড়াই। দেশটি এশিয়া ও ইউরোপের বাজারে প্রায় ২৮ লাখ ব্যারেল নিম্ন-সালফার সমৃদ্ধ ডিজেল সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে। এর ফলে এই অঞ্চলে তেলের দাম চরম মন্দায় পড়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এশিয়ায় পরিশোধিত তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় পরিশোধক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এর ফলে এই অঞ্চলে অপরিশোধিত তেলের আমদানি কমে যেতে শুরু করেছে। পড়ন্ত এই বাজার ধরে রাখতে সৌদি আরব বাধ্য হচ্ছে মধ্যম ও ভারী অপরিশোধিত তেলের দাম কমাতে।
রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে প্রভাব:
ইয়েমেনে অভিযান পরিচালনা, মধ্যপ্রাচ্যে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, আইএস আতঙ্কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারসহ বিভিন্নখাতে সৌদি সরকারের ব্যয় তুলনামূলক হারে বেড়ে গেছে। কিন্তু সে তুলনায় আয় বাড়েনি। উল্টো বাজার ধরে রাখতে তেলের দাম কমানোয় আয় গেছে কমে। ফলে দেশটি এ ঘাটতি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে পূরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর সৌদি অর্থবাজেট ১৪০ বিলিয়ন ডলারের (১০ লাখ ৮৯ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা) ঘাটতি দেখতে চলেছে।
জাতীয় অর্থনীতির এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সৌদি আরব এখন ঋণপত্র বিক্রির পাশাপাশি তেলের দাম খানিকটা বাড়ানোর চিন্তা করছে। সর্বশেষ খবর, দেশটির রাষ্ট্রীয় পেট্রোলিয়াম কোম্পানি ‘সৌদি আরামকো’ অপরিশোধিত তেলের দাম চলতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে ব্যারেল প্রতি ১ ডলার করে বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলের দাম বাড়ালে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদন বাড়াবে। ফলে দেশটির অপরিশোধত তেল উৎপাদন আরও উৎসাহিত হবে। সেই সঙ্গে সৌদি তেলের ক্রেতাও দ্রুত কমতে শুরু করবে। ফলে সৌদি আরবের অর্থনৈতিক ধস তরাণ্বিত হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০০২৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৫
আরএইচ
** অর্থনৈতিক সংকটের মুখে সৌদি আরব