ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

বাশার আল-আসাদের সাক্ষাৎকার (প্রথম পর্ব)

পশ্চিমাদের কারণেই সিরিয়া-ইরাকে আইএসের উত্থান

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০১৫
পশ্চিমাদের কারণেই সিরিয়া-ইরাকে আইএসের উত্থান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সিরিয়ায় জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিরোধী অভিযান পরিচালনায় গত ২ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্য সরকারকে অনুমোদন দেয় দেশটির পার্লামেন্ট। একইদিন সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সাক্ষাৎকার নেয় যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সানডে টাইমস।



এতে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও রাশিয়ার আইএসবিরোধী অভিযানের মূল্যায়নসহ তার দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, সন্ত্রাস দমনে সরকারের অবস্থান ও আইএসসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন।

গত ৬ ডিসেম্বর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে সানডে টাইমস। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব মঙ্গলবার (০৮ ডিসেম্বর) প্রকাশ হলো। সাক্ষাৎকারের পরবর্তী পর্বগুলোও পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করবে বাংলানিউজ। অনুবাদ করেছেন বাংলানিউজের নিউজরুম এডিটর রাজিউল হাসান।

প্রশ্ন: মি. প্রেসিডেন্ট, আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি জানেন, সিরিয়ায় আইএসবিরোধী যৌথ অভিযানে যুক্তরাজ্য যোগ দেবে কি না, সে বিষয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভোট হচ্ছে (ভোট অনুষ্ঠিত ২ ডিসেম্বর)। যুক্তরাজ্যের এই পদক্ষেপ কতোটুকু সঠিক? আপনি কি একে স্বাগত জানাবেন? আর এই পদক্ষেপ পরিস্থিতির ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে আপনি মনে করছেন?

বাশার আল-আসাদ: আমাকে যদি একটা বই মূল্যায়ন করতে বলা হয়, তাহলে বইটার শুধু একটা লাইন পড়েই তা করতে পারবো না আমি। আমাকে বইটার শিরোনাম, অধ্যায়গুলোর শিরোনাম দেখতে হবে এবং তারপরই আমরা বইটার বাকি অংশ নিয়ে আলোচনা শুরু করতে পারবো। কাজেই আমরা এখন যা আলোচনা করছি, তা শুধ‍ু একটা বিচ্ছিন্ন বাক্যের মতো। যদি আমরা শিরোনামের দিকে যাই, তাহলে দেখবো, এটা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই’।

সিরিয়া সংঘাতের একদম শুরু থেকেই আমরা জানি, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সন্ত্রাসের পক্ষে কাজ করেছে। সিরিয়ার বৈধ সরকারের বাহিনীর সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ না করেই তারা আকাশ ও স্থলে অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু এই অভিযানকে তখনই বৈধ বলা যেতো, যখন কি না তা সরকারি বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত হতো। কাজেই আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, সন্ত্রাস নির্মূলের কোনো ইচ্ছেই তাদের নেই এবং লড়াই পরিচালনায় তাদের কোনো নিয়মতান্ত্রিক পরিকল্পনাও নেই।

এখন আমরা যদি এই পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে আলাদাভাবে বিভিন্ন বিষয়কে বিবেচনায় নিতে চাই, তাহলে চলুন প্রথমেই বাস্তবতার দিকে নজর দিই। এক বছর বা তার বেশি সময় ধরে যৌথবাহিনীর এই যে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, এর ফলাফল কি? তাদের তৎপরতার পরও তো আইএস ও আল-নুসরা বা তাদের সমমনা সংগঠনগুলো সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু যদি রুশ অভিযানের বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করি, তখন বিষয়টা কি দাঁড়ায়?

আইএস ও আল-নুসরা সংকুচিত হতে শুরু করেছে। কাজেই যৌথবাহিনীর সঙ্গে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের যোগ দেওয়ার বিষয়ে যদি বলি, প্রথমত তারা কোনো ফলাফলই দিতে পারবে না, দ্বিতীয়ত এটা ক্ষতিকর ও অনৈতক হবে এবং তা সন্ত্রাসকে আরো উৎসাহিত করবে, যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যৌথবাহিনী এক বছর ধরে করে আসছে। কারণ এটা ক্যান্সারের মতো। আপনি ক্যান্সারকে কেটে ফেলতে পারবেন না। একে কেটে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করলে তা শরীরে আরো ছড়িয়ে পড়ে।

প্রশ্ন: পরিষ্কার হতেই জানতে চাইছি, আপনি কি বলতে চাইছেন, যুক্তরাজ্য যদি অভিযানে যোগ দেয়, তাহলে তা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অনৈতিক হবে?

বাশার আল-আসাদ: অবশ্যই। সিরিয়া একটি সার্বভৌম দেশ। রাশিয়ার দিকে তাকান। তারা যখন সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করতে চাইলো, প্রথমেই তারা সিরিয়ার সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলো। তারপর তারা একই ইস্যুতে অন্য সরকারগুলোর সঙ্গে আলোচনা করলো। তারপরই তারা অভিযান শুরু করলো। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস মোকাবেলায় এটাই আইনি প্রক্রিয়া। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এই অঞ্চলে আইএস ও আল-নুসরার উত্থানে সহায়তা করেছে।

প্রশ্ন: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, এই অঞ্চলে জঙ্গির উত্থানে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স দায়ী। কিন্তু তারা তো আইএসের উত্থানের জন্য দায়ী নয়। উদাহরণস্বরূপ বলতে গেলেও এ ধরনের মন্তব্য কি কঠিন অভিযোগ নয়?

বাশার আল-আসাদ: সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মন্তব্য থেকেই শুরু করা যাক। তিনি বলেছেন, ইরাক আক্রমণের ফলেই আইএসের উত্থান হয়েছে। এবং আমরা জানি, ২০০৬ সালে ইরাকে আইএস নিজেদের আলাদা রাষ্ট্র ঘোষণা করে। তখন তাদের নেতা ছিলেন আবু মোসাব আল-জেরকাওই। মার্কিন হামলায় তিনি নিহত হন এবং তারাই এর ঘোষণা দেয়। এর অর্থ, মার্কিনিরা জানতো তিনি আছেন, ইরাকে ওই সময় আইএস আছে। মার্কিন হামলার কারণেই সিরিয়ায় সংঘাত শুরুর প্রথমদিকে আইএস আমাদের এখানে ঢুকে পড়ে। ব্লেয়ার এটা স্বীকার করেছেন। এবং বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে, এই অঞ্চলে আইএস ও আল-নুসরার উত্থানে তারাই সহায়তা করেছে।

প্রশ্ন: আপনার কী মনে হয়, সিরিয়ায় আল-কায়েদার যে শাখা, জাবহাত আল-নুসরা রয়েছে, তারা পশ্চিমাদের জন্য আইএসের চেয়ে বড় হুমকি? এবং এ কারণেই কি বলা যায়, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন ভুল শত্রু দমনে উদ্যত হয়েছেন?

বাশার আল-আসাদ: মূল প্রশ্নটা জঙ্গি সংগঠনগুলোর আকার নিয়ে নয়, তাদের আদর্শ নিয়ে। তারা তাদের লোকবল বা ক্ষমতার ওপর ভর করে হামলা করে না। তারা এসব করে তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন ও পথচ্যুত ওয়াহাবি আদর্শের ওপর ভর করে। কাজেই আমরা যদি আইএস ও আল-নুসরার মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে চাই, আদতে কোনো পার্থক্যই খুঁজে পাবো না। কারণ তাদের আদর্শ এক। এটা গেল একটা দিক। অপর দিকটা হলো, আমরা যদি তাদের তৃণমূল সদস্য, অনুসারী ও সংগঠনের মূল সদস্যদের নিয়েও কথা বলতে চাই, তাহলেও কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবো না। কারণ তারা সচরাচরই এক সংগঠন থেকে অপর সংগঠনে যোগ দেয়। এবং এ কারণেই নিজ স্বার্থে স্থানীয় বা ক্ষুদ্র পরিসরে তারা কখনো কখনো একে অপরের সঙ্গে লড়াইয়েও জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বাস্তবত হলো, বৃহত্তর স্বার্থে প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা একে অপরকে সহায়তা করে। কাজেই কোনো সংগঠন বেশি বিপজ্জনক, আপনি তা নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না।

প্রশ্ন: বিমান হামলা পরিচালনার ব্যাপারে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরুন বলেছেন, সিরিয়ায় বর্তমানে ৭০ হাজার বিদ্রোহী রয়েছে, যারা জঙ্গিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। তবে তারা লড়াইয়ের ময়দানে রয়েছে এবং তাদের পশ্চিমারা আইএস বিরোধী লড়াইয়ে ব্যবহার করতে চায়। আপনি কি বলতে পারেন, এই ৭০ হাজার বিদ্রোহীর মধ্যে কোন কোন সংগঠন রয়েছে? আপনি কি সিরিয়ায় এই বিদ্রোহীদের ব্যাপারে ওয়কিবহাল?

বাশার আল-আসাদ: এ ব্যাপারে যদি স্পষ্ট করে আমাকে কিছু বলতে হয়, তাহলে বলতেই হবে, এটা ডেভিড ক্যামেরুনের প্রহসনগুলোর একটা। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। বিদ্রোহীরা কোথায়? ঠিক এই কথাটাই পশ্চিমারা বলে, সিরিয়ায় মধ্যপন্থি গ্রুপ রয়েছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করতে এ ধরনের মন্তব্য প্রহসন ছাড়া আর কি হতে পারে?

দুই মাস আগে রাশিয়ানরা যখন অভিযান শুরু করলো, তখন থেকেই তারা এই মধ্যপন্থি বিদ্রোহীদের ব্যাপারে জানতে চাইছে। কেউই তাদের কোনো উত্তর করতে পারেনি। সত্যি বলতে কি, সংঘাত শুরুর প্রথম থেকেই সিরিয়ায় কোনো মধ্যপন্থি বিদ্রোহী নেই।

যারা সংঘাতে রয়েছে, তাদের সবাই চরমপন্থি। এগুলো শুধু আমি কথার কথা বলছি না, আপনি ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ঘাঁটলেও আমার কথার সত্যতা পাবেন। যাদের কথা বলা হচ্ছে, তারা সবাই তাদের নৃশংসতার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ আপলোড করেছে। তারা তরবারি ব্যবহার করে, তারা শিরোশ্ছেদ করে। এবং আপনি জানেন, অপরাধীর স্বীকারোক্তিই অকাট্য বাস্তবতা। কাজেই এরাই হলো সেইসব মধ্যপন্থি বিদ্রোহী, যাদের কথা ক্যামেরুন বলছেন।

যদি তাদের বিষয়টা এমনই হয়ে থাকে, তাহলে সম্প্রতি প্যারিসে বা তার আগের শার্লি হেবদো কার্যালয়ে কিংবা দশ বছর আগে যুক্তরাজ্যে বা তার আগে স্পেনে অথবা ৯/১১’র নিউইয়র্কে যারা হামলা চালিয়েছে, তাদেরও মধ্যপন্থিবিরোধী বলতে হবে। এটা বিশ্বের কোথাও গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই যে ৭০ হাজার মধ্যপন্থি বিদ্রোহীর কথা বলা হচ্ছে, তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই সিরিয়ায়। এমনকি তাদের সাত হাজারও হয়তো ক্যামেরুন খুঁজে পাননি, হয়তো এমন বিদ্রোহীর সংখ্যা ১০ জনেরও কম হতে পারে।

প্রশ্ন: তাহলে কুর্দি ও ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এসএসএ) সম্পর্কে কি বলবেন আপনি?

বাশার আল-আসাদ: কুর্দিরা সিরীয় বাহিনীর সঙ্গে একই এলাকায় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

প্রশ্ন: কিন্তু তাদের তো সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি তাদের অস্ত্র সরবরাহ, প্রশিক্ষণও দিচ্ছে তারাই।

বাশার আল-আসাদ: তাদের অস্ত্র সহায়তা ও প্রশিক্ষণ সিরীয় সেনাবাহিনীই দিচ্ছে। এর নথিপত্রও রয়েছে আমাদের কাছে। আমরা তাদের অস্ত্র সরবরাহ করেছি, কারণ তারা সিরিয়ার অধিবাসী এবং তারা সন্ত্রাসের নির্মূল চায়। সিরিয়ায় অন্যান্য অনেক সংগঠনকেও আমরা একই কারণে সহায়তা করেছি। এ কাজ করার আরও একটি অন্যতম কারণ হলো, সিরিয়ার সব এলাকাতে আমরা সেনাবাহিনী পাঠাতে পারি না। (চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ০৩১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮ ২০১৫
আরএইচ/টিআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।