ওয়াশিংটন: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের মধুর সম্পর্কটিতে হঠাৎই এসেছে বড় ছন্দপতন। বলা যায়, দীর্ঘ দীর্ঘকালের ঘনিষ্ট সর্ম্পটি এ মুহুর্তে রীতিমতো খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এবারই প্রথম অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছে, হোয়াইট হাউসের চিরাচরিত চোখ রাঙানি এতোদিন মুখ বুজে সয়ে এলেও এই প্রথম পাল্টা জবাব দিতে শুরু করেছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের নতুন নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানী ওয়াশিংটনে গিয়ে বলে এসেছেন পাকিস্তানকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু না দিলে পাকিস্তান তার নিজের মতো করে এগাবে।
পাক সরকারের এহন ধৃষ্টতাতে ভালো চোখে দেখছে না ওবামা প্রশাসন। ওবামা প্রশাসনের ভেতর মহলের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, পাকিস্তানকে এর জন্য ‘চড়া মূল্য’ দিতে হবে।
ওবামা প্রশাসনে এতদিন যাদের পাকিস্তানের প্রতি সহানুভ’তিশীল মনে করা হতো তারাও এখন বেঁকে বসেছেন। তারাও আর পাকিস্তানকে দেখছেন তালেবানের গোপন পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। তাদের ভাষ্য, পাকিস্তানকে আর বিশ্বাস করার যো নেই। পাকিস্তান সরকার ও এর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সন্ত্রাসবাদীদের দিচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদদ। পাকিস্তানে উপরে উপরে বন্ধুর ভাব করে চললেও আড়ালে মার্কিন স্বার্থের পিঠে গোপনে ছুরি চালাচ্ছে।
অবশ্য এ নিয়ে ওবামা প্রশাসনের মধ্যে চলছে বিতর্ক ও ভিন্নমত। খোদ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ জেনারেল মাইক ম্যুলেন জড়িয়েছেন বিতর্কে।
আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর সেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যার ঘটনায়ও তলে তলে আইএসআই জড়িত। এমন প্রমাণও নাকি আছে--- সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তারা এমন দাবি করেছেন।
মার্কিন জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ মাইক ম্যুলেনকে এতোদিন পাকিস্তানের বন্ধু হিসেবেই দেখা হতো। কিন্তু তিনিই এবার পাকিস্তানের কঠোর সমালোচনা করে সিনেটে বললেন, ‘তালেবানের সঙ্গে ঘনিষ্ট হাক্কানি নেটওয়ার্ককে মদদ দিচ্ছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। আইএসআই’এর সমর্থনেই হাক্কানি নেটওয়ার্ক আফগানিস্তানে মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালিয়েছে। ’
ওবামা প্রশাসনও সে বার্তাটাই পৌঁছে দিয়েছে পাক প্রশাসনকে। আর তাতেই অসম দুই বন্ধুরাষ্ট্রের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে কূটনৈতিক বাকযুদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো মিত্ররাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ২০০২ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হাতিয়ে নিয়েও উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গোপনে যুদ্ধ করার দোষে দোষী হল। অথচ চরম অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে বিপুল অর্থ সহায়তা দিয়ে আসছে।
কিন্তু পাকিস্তান `বন্ধুর আলখাল্লা পরে নেমেছে শত্রুর ভূমিকায়’। তাই মাইক ম্যুলেন ও তার সমর্থকরা পাকিস্তানের জন্য তড়িঘড়ি উচিত শাস্তির পক্ষে সোচ্চার । তবে প্রেসিডেন্ট ওবামা চটজলদি কিছু করার আগে ধীরে চলো নীতিতে এগোতে চান।
ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে আরও অভিযোগ করা হয়, নাইন-ইলেভেনের পর থেকে সন্ত্রাবিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সহায়তা করার নামে পাকিস্তান এতাদিন ধরে আসলে আল কায়েদাকেই সাহায্য করে আসছে। এমনকি পরবর্তী বছরগুলোতে তালেবানের শক্তি বৃদ্ধিতেও সাহায্য করেছে তারা। এছাড়া ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার জন্য দায়ী লস্কর-ই-তৈয়বাকেও অর্থ সহায়তা দিয়েছে তারা।
সে সময়ে পাক-মার্কিন সম্পর্কে ফাটল ধরে। কিন্তু ২০০৯ সালে সম্পর্ক ঝালাই করতে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে পাকিস্তানকে নিতে কয়েক শ’ কোটি ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ওয়াশিংটন।
কিন্তু কথা রাখেনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী। জেনারেলরা আন্তরিকতার ভানই করেছেন শুধু। আমেরিকার কাছ থেকে পাওয়া ক্রমাগত দান খয়রাত আর কাঁড়ি কাঁড়ি ডলারের পাহাড়ে বসে আমেরিকা বধেরই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন তারা। তারা স্থানীয় ও আফগান জঙ্গিদের গোপন সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। আইএসআই যে ভারতের বিরুদ্ধে হামলার কাজে জঙ্গিদের ব্যবহার করছে এমন প্রমাণও রয়েছে।
অবশেষে পাকিস্তানের ওপর সব আস্থা হারিয়ে এখন ওয়াশিংটন বলছে, যদি তারা এধরনের অভিনয় ও ছলচাতুরি চালিয়ে যায় তাহলে, যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এর সমুচিত জবাব দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্র্র তাদের সেভাবেই বিবেচনা করবে। পাকিস্তানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র বারবারই চেষ্টা করেছে। কিন্তু চলতি বছরে ঘটে যাওয়া কিছু সন্ত্রাসী হামলায় দুই দেশের সম্পর্ক আরও অবনতির দিকে গেছে।
এরপরও যদি পাকিস্তানের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকে? সেক্ষেত্রে চাপ ক্রমাগত বাড়ানো এবং ’যা করা দরকার তা করা`র পথেই এগোবে ওয়াশিংটন। এর মানে, পাকিস্তানে আরও বেশি ড্রোন হামলা এবং সীমান্তে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বিশেষ বাহিনী আরও হামলা চালানো হবে। চালানো হবে অভাবনীয় আকস্মিক হামলাও। যেমনটি চালিয়েছিল আবোটাবাদে এলিট কমান্ডো ইউনিট নেভি সিল বাহিনী---লাদেন হত্যার সফল মিশনে।
পাকিস্তানের জেনারেলরা সে দেশের অভিভাবক সেজে বসে আছেন। তারাই আসলে দেশটির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সেনাপ্রধান কায়ানি এবং তার অনুসারীরা মনে করছেন, তাদের হাতেই আছে তুরুপের তাস। তারা মনে করছেন, ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা পর্যন্ত তারা যদি বর্তমান অবস্থা অব্যাহত রাখতে পারেন তাহলে কিছুই হবে না। ওয়াশিংটন তো আর দীর্ঘদিনের মিত্র হারানোর ঝুঁকি নেবে না! সবকিছুই এক সময় স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তারা এ-ও মনে করছেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা এই বিষয়ে বেশিকিছু করবেন না; কেননা, আগামী বছরেই আমেরিকার নির্বাচন।
ম্যুলেনও খুব শিগগির অবসরে যাবেন। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, পরে যারা আসবেন তারা তার বক্তব্য উড়িয়ে দেবেন। এই সত্যটা পাক জেনারেলরা বেমালুম ভুলে আছেন।
পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে পাঞ্জাব এবং কাশ্মীর ইস্যুতে ৩০ বছর ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কাশ্মির নিয়ে পাকিস্তান যা করছে যেভাবে জঙ্গি-তোষন করছে তারও কড়া সমালোচনা করেছে ওয়াশিংটন। এটা আগে কখনো দেখা যায়নি। এর মানে এ ব্যাপারে ওয়াশিংটন তার পলিসি পরিবর্তন করেছে—এমন ইুঙ্গতও স্পষ্ট।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি ম্যুলেনের বক্তব্যের প্রতিবাদে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র হারাবে’। কিন্তু বেশিরভাগ নীতিনির্ধারকরাই বলছে, ‘এটা পাকিস্তানের এক প্রকার ধাপ্পা। ’
সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাঁড়াশি চাপের মুখে পাকিস্তানের দুর্বল নমনীয়তা কতক্ষণ টিকবে? সে নৈতিক জোর বা সার্বভৌম শক্তি অন্তত পাকিস্তানের নেই।
এরই মধ্যে পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক পারভেজ মোশারফ বলেছেন,‘...যুক্তরাষ্ট্রের উচিত, পাকিস্তানের বাধ্যবাধকতা ও সার্বভৌমত্বকে মেনে নেওয়া। ’
কিন্তু ওয়াশিংটন কী কখনো তা করেছে? সে শুধু পাকিস্তানকে নিজের প্রয়োজনের সময় ইচ্ছেমতো ব্যবহারই করেছে আর ক্রমাগত অধীনতামূলক মিত্রতার জালে বন্দী পাকিস্তান কেবল বিগ ব্রাদার আমেরিকার হুকুম তামিল করেই গেছে। এবারের মতো আগে কখনো শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১১