ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ ভাদ্র ১৪৩২, ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

আসাদের পতনে প্রয়োজন ছোটো একটা ধাক্কা

কল্লোল কর্মকার, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:০৩, নভেম্বর ২১, ২০১১
আসাদের পতনে প্রয়োজন ছোটো একটা ধাক্কা

ঢাকা: গত বছরের শেষের দিকে পুরো আরব জুড়েই বেজে ওঠে গণবিদ্রোহ আর অভ্যুত্থানের দুন্দুভি। একে ‘আরব বসন্ত’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে পরবর্তী সময়ে।

কেননা, গেল বসন্তের বাউলা বাতাসে জেগে উঠেছিল আরর জাহান। বসন্তের সেই বাতাসের ঝাপটায় প্রথম তেঁতে উঠেছিল তিউনিশিয়া। তারপর, তেঁতে উঠেছিল মরক্কো, মিসর, লিবিয়া, ইয়েমনসহ বিভিন্ন দেশের আপামর জনতা।

এরই ফলশ্রুতিতে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে সিরিয়াতেও। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে সে দেশের জনগণ। প্রতিদিনই তাজা রক্তের নহর বইছে রাজধানী দামেস্কসহ দেশটির বিভিন্ন শহর-উপশহরে।

একদিকে সরকারি অস্ত্রের ঝনঝনানি অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ জনতার আর্তচিৎকার। সেই আর্তচিৎকারের ওপর ভর করে বিক্ষোভকারীরা গড়ে তুলেছে সিরিয়ার জাতীয় পরিষদ(এসএনসি)। সেই পরিষদেরই একজন জেষ্ঠ্য সদস্য খালেদ খোজা। সম্প্রতি সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিদ্রোহে প্রতিবেশি দেশ তুরস্কের অবস্থান নিয়ে একটি তুর্কি সংবাদ মাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেন তিনি।

খালেদ খোজার মতে, সিরিয়ার ক্ষমতাসীন বাথ পার্টির সদস্যরা তাদের ‘প্রাণপ্রিয়’ পার্টি থেকে ‘লাফ’ দিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের জন্য দরকার শুধুমাত্র একটা জাহাজ। আসাদ সরকারের পতন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। আর এজন্য এখন ছোটো একটা ধাক্কাই প্রয়োজন।

প্রশ্ন: আপনার ভাষ্য মতে এসএনসি সিরিয়ার আশি শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে। এটা কি খুবই উচ্চাকাঙ্খী দাবি হয়ে যায় না?

খোজা: সিরিয়ার অনেকেই এই চলমান ব্যবস্থা এবং সরকারের উপর বীতশ্রদ্ধ। তারা প্রতিবাদ করার জন্য একটা জায়গা বা প্লাটফর্ম খুঁজছিল অনেক দিন ধরেই। এসএনসি’র মাধ্যমে তারা প্রতিবাদ করছে এখন। কিন্তু তার মানে এই নয়, আমরা দাবি করছি আশি শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে এসএনসি। তবে সরকার যখন রাস্তায় আমাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া শুরু করলো তখন তো কিছুটা দায়িত্ব আমাদের ওপর এসেই পরে। সিরিয়ার রাস্তাই আমাদের বৈধতা দিয়েছে।
 
প্রশ্ন: রাস্তা বলতে আপনি কি বোঝাচ্ছেন? তাদের সমর্থনকে আপনি এখান থেকে কিভাবে বিচার করবেন?

খোজা: পরপর তিন শুক্রবারের কথা আমি বলতে পারি। যখন সিরিয়ার জনগণ জুমার নামাজ আদায় করে ‘এসএনসি আমাদের প্রতিনিধি’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিছিল করেছিল। রাজপথে মোট তিনটি গ্রুপ সিরিয়ার প্রতিনিধিত্ব করছে। আন্দোলনের স্বার্থে তাদের নাম এই মুহুর্তে বলা যাচ্ছে না। আর এই তিনটি গ্রুপই এসএনসি’কে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সমর্থন দিয়েছে। মুসলিম ব্রাদারহুড, কুর্দি এবং খ্রিস্টানরাও এসএনসি’কে সমর্থন দিয়েছে।
 
প্রশ্ন: বিরোধীদের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হলো তুরস্কে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় তুরস্কের কি ভূমিকা?

খোজা: বাস্তবিক অর্থে, ইস্তান্বুুলে অনুষ্ঠেয় প্রথম কংগ্রেসে তুরস্ক ততটা আগ্রহ দেখায়নি।

প্রশ্ন: কিন্তু কংগ্রেসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

খোজা: মূলত ওটা বিরোধীদের সেই অর্থে কোনও আলোচনা সভা ছিল না। ওটা ছিল বুদ্ধিজীবিদের একটা বৈঠক মাত্র। আর এর আয়োজক ছিলো তুরস্কের একটি এনজিও। কিন্তু বিরোধীরা একে অপরকে ভালোভাবে জানতে পারে এই বৈঠকে। সিরিয়ার প্রশাসন আনাতোলিয়ার বৈঠক প- করতে একদল মানুষ পাঠিয়েছিল। তখন তুর্কি প্রশাসন আমাদেরকে অন্য একটি হোটেলে আমাদের নিজেদের আলোচনা করতে বলে। তারা জানায়, এটা একটা গণতান্ত্রিক দেশ, ‘এখানে মানুষ আলোচনা সভা করতেই পারে। ’
 
প্রশ্ন: তাহলে তুরস্ক কি এই প্রক্রিয়ার পেছনে নেই?

খোজা: না, ব্যাপারটা আসলে তা নয়। আমরাও আসতে চেয়েছিলাম আর তুরস্কও চলে যেতে বলেনি। কিন্তু তুরস্কে যেন এই আলোচনা সভাটি হয় সেজন্য আমরা চাপ দিচ্ছিলাম। অংশগ্রহনকারীদের বেশিরভাগেরই ছিল সিরিয়ার পাসপোর্ট। এক পর্যায়ে আলোচনা সভা করা জন্য কায়রো যাওয়ার কথা হয়েছিল। কিন্তু কায়রোতে আমাদের কিছু বন্ধু আসাদ সমর্থকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়। তারপর আমরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি। আমাদের সঙ্গে গণমাধ্যমও ছিল। প্যারিসে আমাদের বন্ধুরা অবাক হয়ে গিয়েছিল যখন তারা দেখলো আমাদের আলোচনা অনুষ্ঠান কাভার করছে বিশটি ক্যামেরা।
 
প্রশ্ন: তুরস্কের সরকারের সঙ্গে এখন আপনাদের সম্পর্ক কেমন?

খোজা: এসএনসি প্রতিষ্ঠার পর আমরা প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু সেসময় তুরস্ক আমাদের পর্যবেক্ষণ করছিল। তখন আমরা আমাদের প্রথম আলোচনা সভা করলাম তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ দাভুতোগলুর সঙ্গে। দ্বিতীয় আলোচনা সভাটিও ছিল মূলত নৈতিক সমর্থন পাওয়ার জন্য। খুব কম রক্তপাতহীন পন্থায় এই সমস্যার সমাধান চাইছিলো তুরস্ক।

তুরস্ক কখনোই সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিষয়ে কিছু বলেনি। আমরা লিবিয়া থেকে শিক্ষা নিয়েছি। তুরস্ক কখনোই চায় না একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিমকে হত্যা করুক। তুরস্ক আমাদের অর্থনৈতিক সাহায্য করেছে, তবে কোনো গুলি দিয়ে সাহায্য করেনি। তবে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়্যেব এরদোগান বলেছেন, ‘ব্যাপকহারে নৃশংসতা তুরস্ক মেনে নেবে না। ’

সিরিয়ার সাধারণ জনগণকে বাঁচানোর জন্য আরব লীগ যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি মনে করি তুরস্কও এই অবরোধের পক্ষে। আসাদ সরকার যদি আরও সহিংস হয় তাহলে আমাদেরও আরেক ধাপ এগুতে হবে উপায়হীনভাবেই। তখন আমরা সিরিয়াকে নো ফ্লাই জোন হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার দাবি জানাবো।
 
প্রশ্ন: কিন্তু কখন এটা ঘটবে?
 
খোজা: আমরা সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। এর প্রতিফলন আমরা লিবিয়াতে দেখেছি। কোনো প্রকার সহিংস পন্থায় না গিয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যমতের ভিত্তিতে আন্দোলন করাই গুরুত্বপূর্ণ। এনএসসি তাদের দরজা কারও জন্য বন্ধ করেনি। আমরা এই প্রশাসনের সমর্থকদের জন্যও সন্তোষজনক জবাব দিয়ে রেখেছি। সেনাবাহিনী, বাথ পার্টি এবং আসাদ প্রশাসনের অর্থদাতাদের উপর দাড়িয়ে আছে এই প্রশাসন। বাথ পার্টির লোকজন অন্য কোনো জাহাজের জন্য অপেক্ষা করছে। কাছাকাছি হলেই তারা ওই জাহাজে ঝাঁপ দেবে। ব্যবসায়ীরা সিরিয়া থেকে তাদের অর্থ স্থানান্তর করতে শুরু করেছে। প্রশাসন ভেতর থেকেই দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। সময় আসছে, যখন একটা ছোটো ধাক্কাতেই এই প্রশাসনের পতন ঘটবে। এরজন্য ছয়মাস থেকে এক বছরের মতো সময় লাগবে।
 
প্রশ্ন: কিন্তু এখনও অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আসাদ সরকারকে সমর্থন দিচ্ছেন। তারা মনে করছেন আসাদ সরকারের পতন হলে তাদের ওপর হামলা হবে। এমনকি গৃহযুদ্ধের আশংকাও করছে তারা।

খোজা: কিন্তু বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর থেকে কোনো জাতিগত দাঙ্গা হয়নি সিরিয়াতে। যদি এমন হয় যে সুন্নিরা খ্রিস্টানদের গ্রামগুলোতে হামলা চালাচ্ছে। তাহলে বিশ্বাস করুন এই প্রশাসনই এটা তৈরি করবে। আমাদের খ্রিস্টান সমর্থকও আছে।

প্রশ্ন: হামা এবং হোমসের সংঘর্ষের ব্যাপারে কি বলবেন?

খোজা: সেখানে কিন্তু কোনো জাতিগত দাঙ্গা হয়নি। ওখানকার খ্রিষ্টানরা এই প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।

প্রশ্ন: যদি এই প্রশাসনের পতন হয় তাহলে পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য কি পন্থা অবলম্বন করা হবে?

খোজা: আমরা সকল প্রকার স্বশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিপক্ষে। এমনকি জাতিগত দাঙ্গার বিরুদ্ধেও আমরা। যখন এই প্রশাসনের পতন হবে, বুঝতে হবে, এই প্রশাসনের ওপর ভীত হয়েই মানুষ এই প্রশাসনের পতন ঘটিয়েছে। আর তখন দায়িত্ব গ্রহণ করবে এসএনসি।

(খালেদ খোজার জন্ম দামেস্কে কিন্তু তার পৈত্রিক নিবাস তুরস্কে। ১৯৭৯ সালে তার বাবা যখন মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন জানায় তখন খালেদকে সিরিয়ার কারাগারে যেতে হয়। ১৯৮২ সালে তিনি সিরিয়া থেকে তুরস্কে পালিয়ে যান। সেখানেই তিনি একজন ডাক্তার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। )

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।