ঢাকা: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার লিখেছিলেন ‘দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর’। কিন্তু নাগরিক মানুষ কথা রাখেনি রবি ঠাকুরের।
১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ দিবাগত রাতে ভারতের মধ্য প্রদেশের রাজধানী ভূপালে ঘটে ইতিহাসের এক ন্যাক্কারজনক শিল্প বিপর্যয়ের ঘটনা। ভূপালে অবস্থিত ‘ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড’এ সূত্রপাত হয়েছিল এক নারকীয় অধ্যায়ের।
শিল্প প্রতিষ্ঠানটির প্ল্যান্ট ফুটো হয়ে মিথাইল আইসোসায়ানাইট (রাসায়নিক নাম) ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ বের হয়। রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে ঘণ্টার মধ্যেই শুরু হয় ভয়াবহ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাৎক্ষণিক ভাবেই মারা যায় দুই হাজার মানুষ। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়টি হলো, বিশাল সংখ্যাক মানুষ মারা যাওয়ার পাশাপাশি অনেকেই হারায় তাদের চোখসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ।
ঘটনা পরবর্তীতে এক বেসরকারি হিসেব মতে তাৎক্ষনিকভাবে মৃতের সংখ্যা বলা হয় ২,২৫৯ জন। কিন্তু মধ্যপ্রদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ছিল ৩,৭৮৭ জন। তবে এসবই হিসেবের কথা। হিসেবের বাইরে আজও ভূপাল ট্রাজেডির কারণে নবজাতক জন্মায় শারিরীক বিকলাঙ্গতা নিয়ে। বিভিন্ন মেয়াদে আরও অনেকেই মারা যায় এই ট্রাজেডির কারণে। যার সঠিক হিসেব রাখা এক অর্থে দু:সাধ্য।
২০০৬ সালের দিকে সরকারি এক হলফনামায় বলা হয়, প্রায় ৫ লক্ষ ৫৮ হাজার ১২৫ জন মানুষ এই বিপর্যয়ের শিকার হয়। প্রায় ৩৮ হাজার ৪৭৮ জন সাময়িকভাবে এবং ৩ হাজার ৯০০ জন স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। তবে সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়, ঐ বির্পযয়ে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল।
‘ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড’ ছিল ভারতীয় ‘ইউনিয়ন কার্বাইড করপোরেশন’ এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৪ সালে ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠানটিকে ‘এভারেডি ইন্ডাস্ট্রিজ ইন্ডিয়া লিমিটেড’ এর নিকট বিক্রি করে দেয়। ভূপাল প্ল্যান্টটি পরে ম্যাকলিওড রাসেল (ইন্ডিয়া) লিমিটেডের নিকট বিক্রি করে দেওয়া হয়। ২০০১ সালের দিকে ‘ডৌ কেমিক্যাল কোম্পানি’ ইউনিয়ন কার্বাইড করপোরেশনটি কিনে নেয়।
এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন ও ভারতের ভূপালের জেলা আদালতে দেওয়ানি এবং ফৌজদারি মামলা হয়। কিন্তু উভয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ইউনিয়ন কার্বাইড করপোরেশন ঐ সময়কার সিইও ওয়ারেন অ্যান্ডারসনের বিরুদ্বে মামলা আজও ঝুলে আছে।
২০১০ সালের জুন মাসে সাবেক সাত কর্মকর্তাকে অবহেলার জন্য জেলে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রহসন হলো এতগুলো মানুষের জীবনের বিপরীতে অভিযুক্তদের কাছ থেকে আদায় করা হয় মাথাপিছু দুই হাজার ডলার করে।
বর্তমান সভ্যতায় শিল্প আর শিল্পায়নের বিকল্প নেই। কিন্তু এই শিল্পায়নের পাশাপাশি প্রকৃতির দিকেও নজর দিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। বিশ্ব ভূপাল ট্রাজেডির মতো নতুন কোনো ট্রাজেডি দেখতে চায় না।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১১