ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

উইগুর মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের ওপর গণহত্যা কায়েম করতে চাচ্ছে চীন

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০২০
উইগুর মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের ওপর গণহত্যা কায়েম করতে চাচ্ছে চীন

উইগুর সম্প্রদায়ের মুলসলিমদের মস্তিষ্কটাই বিকল করে দিতে চাচ্ছে কমিউনিস্ট শাসিত চীন। পাকিস্তানি কায়দায় জিনজিয়াং প্রদেশে উইগুর বুদ্ধিজীবীরা এখন চীনা আক্রমণের মূল লক্ষ্য।

তাই জিনজিয়াং থেকে প্রায়শই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হচ্ছেন বুদ্ধিজীবীরা। বিনা বিচারে ভরা হচ্ছে জেলে। তারপর বিচারের নামে প্রহসনে বাড়ছে বন্দিদশা। সাধারণ মানুষের মতোই উইগুর বুদ্ধিজীবীরাও হারিয়ে যাচ্ছেন মূল স্রোত থেকে। যেমন, চলচ্চিত্র পরিচালক হারসান হাসান বা অধ্যাপক তাসপোলাত তাইপ। প্রথম জনের ২০ মাসেরও বেশি জেল খাটার পর ৫ সেপ্টেম্বর ১৫ বছর কারাদণ্ড ঘোষিত হলো। আর দ্বিতীয় জন ২০১৭ সাল থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ। বিচ্ছিন্নতাবাদী তকমা সেঁটে দিয়ে বিচারের নামে প্রহসন চালাচ্ছে চীন। বেঘোরে মরছেন উইগুররা। মানবাধিকার লুণ্ঠিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

প্রথমে আসা যাক হারসান হাসানের প্রসঙ্গে। উইগুরদের দুর্দশার বড় উদাহরণ এই বছর পঞ্চাশের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের ওপর রাষ্ট্রীয় অত্যাচার। মিথ্যা মামলায় তাকে ফাঁসানো হয়েছে। ভাষাতত্ত্ব বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করলেও হাসানের জগৎ ছিল অভিনয়। বাচিক শিল্পী হিসাবে যেমন তার খ্যাতি ছিল, তেমনি ছোট ছোট চলচ্চিত্র পরিচালনাতেও ছিলেন সমান পারদর্শী।  তার নিজেরই ছিল চলচ্চিত্র নির্মাণ সংস্থা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে চীনের একাধিক সেমিনারেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। চীনা ফিল্ম অ্যাসোসিয়েশন এবং চীনা ফেডারেশন অব লিটারারি অ্যান্ড আর্ট সার্কেলসের আয়োজিত প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশও নিয়েছেন তিনি। উইগুর বুদ্ধিজীবী হিসাবে সমাজে তার জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়। কিন্তু এহেন হাসানকেই ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে চীন সরকার আটক করে। কৌতুক অভিনেতা হিসাবে জনপ্রিয় শিল্পীর গায়ে চাপানো হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী তকমা। তার পরিবারকেও আতঙ্কিত করে তোলা হয়। হাসানকে রাখা হয় জরুরি কক্ষে। বন্দিদশার আগে বেশ শক্তপোক্ত ছিলেন হাসান। কিন্তু জেলে ঢুকতেই ভেঙে পড়ে তার চেহারা।  

২০ মাস একরকম বিনা বিচারেই জেলে কাটানোর পর ৪ সেপ্টেম্বর ঘোষিত হাসানের সাজা বিচ্ছিন্নতাবাদী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে খাটতে হবে ১৫ বছরের জেল। একই সঙ্গে তাকে ফাঁসানো হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগেও। তিনি নাকি প্রশিক্ষণ দেওয়ার নামে চীনাদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন! আসলে সবই মিথ্যা ও সাজানো মামলা। জিনজিয়াং প্রশাসন এভাবেই তো উইগুরদের ওপর নির্যাতন চালায়! বিনা বিচারে হাজারো বন্দিদের মধ্যে হাসান একটি উদাহরণ মাত্র। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি উইগুরদের স্বাভাবিক জীবনধারায় বাঁচতে দিতে নারাজ। তাই তাদের হাজার হাজার মানুষকে মগজধোলাইয়ের নামে ভরা হয়েছে তথাকথিত প্রশিক্ষণ শিবিরে। সেখানে নারীদের গায়ের জোরে বন্ধাত্বকরণ চলছে। পুরুষদের খাটানো হচ্ছে বেগার। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে ইসলাম ধর্ম পালনের সমস্ত অধিকার। উইগুরদের নিচুতলার মানুষদের থেকে শুরু করে হাসানের মতো শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরাও নিস্তার পাচ্ছে না চীনের অমানবিক অত্যাচার থেকে।

অথচ জাতিসংঘের সাধারণ সভায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান শি জিনপিং নিজেই মতাদর্শগত বিরোধে সহমতের কথা বলে এলেন। বিশ্বনেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, 'আদর্শগত বিরোধের উর্ধ্বে উঠতে হবে সকলকে। ' তার নিজের দেশেই চলছে উইগুরদের মুসলিম ধর্ম থেকে বলপূর্বক কমিউনিস্ট মন্ত্রে দীক্ষিত করার সামরিক প্রচেষ্টা। গায়ের জোরে উইগুরদের ইসলাম ধর্ম বা নিজেদের সংস্কৃতি ত্যাগ করে কমিনিস্টদের শিক্ষায় এবং শি-র আদর্শে দীক্ষিত করে তোলার মরিয়া চেষ্টা চলছে চীনে। শি নিজেই বলেন, 'আমাদের উচিত রাষ্ট্রের স্বাধীন উন্নয়নের আদর্শ ও পথকে শ্রদ্ধা করা। প্রাকৃতিকভাবেও গোটা দুনিয়া বহুত্ববাদে বিশ্বাসী। মানবসভ্যতার উন্নয়নে বিভিন্ন ধারার পথকে আমাদের মান্যতা দিতে হবে। আর তাহলেই মানবসভ্যতা আরও রঙিন, আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। ' শি নিজেই আদর্শগত মতভেদের কথা বললেও তার নিজের দেশেই উইগুররা নিজেদের ব্যক্তি জীবনেও বন্দি হয়ে রয়েছেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাতে।

উইগুরদের ঘোরতর আপত্তি শি-র বক্তব্যে। তাদের মতে, চীনে মোটেই বহুত্ববাদকে সম্মান জানানো হয় না। নিজেদের ধর্মই পালন করতে পারছেন না উইগুররা। মানুষকে বন্দুকের নলের সামনে বাধ্য করা হচ্ছে চীনা জয়গানে। ন্যূনতম মৌলিক অধিকারটুকুও পাচ্ছেন না উইগুররা। তাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মতো আচরণ করছে চীন। বিনা বিচারে ভরা হচ্ছে জেলে। তাদের সাফ কথা, চীন মোটেই সভ্য দেশ নয়। চীন সভ্য দেশ হলে হাজার হাজার উইগুরের মগজধোলাইয়ের নামে বন্দি করে রাখা হতো না। হাসানের মতো শিল্পীদের বিনা বিচারে বা বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে ভরা হতো না জেলে। চীনের এই বর্বর আচরণে গোটা দুনিয়া নীরব দর্শকের মতো ভূমিকা নিতে পারে না বলেও উইগুর দুর্দশার প্রচারকরা মনে করেন। তাদের দাবি, অবিলম্বে চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি নিয়ে সরব হোক বিশ্বজনমত।
 
হাসানের তবু খোঁজ পাওয়া গেছে। কিন্তু তিন বছর ধরে নিখোঁজ তাসপোলাত তাইপ।  জিনজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাইপ ২০১৭ সাল থেকে নিখোঁজ। একজন বিশিষ্ট অধ্যাপক বেমালুব হারিয়ে গেলেন, অথচ চীন সরকার নীরব। উইগুরদের বিশ্বাস, বিচারের নামে প্রহসনের শেষে তাইপকেও হত্যা করেছে চীন। লাশ গুম করেও দেওয়া হয়েছে। জিনজিয়াঙে এ ধরনের ঘটনা অবশ্য নতুন কিছু নয়। উইগুর সম্প্রদায়ের মুসলিম তাইপের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে চীন সরকার কিছু বলছে না। কিন্তু তাইপের বন্ধুরা বুঝে গেছেন, আর পাঁচজন উইগুরের মতোই চরম নির্যাতনের শিকার হয়েও তাকে চলে যেতে হয়েছে না ফেরার দেশে। কারণ উইগুর বুদ্ধিজীবীদের ওপর চীনের রাগ সবচেয়ে বেশি।  

ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা বিবিসিকে চীন বিষয়ক গবেষক মাইকেল কাস্টার বলেছেন, 'সাংস্কৃতিক গণহত্যার শিকার অধ্যাপক তাইপ। তবে তিনি একা নন, চীনে উইগুর মুসলিমদের শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা কমিউনিস্টদের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিয়ানে লিপ্ত চীনা প্রশাসন। ' 

উল্লেখ্য, মাইকেল কাস্টার তার ‘দ্য পিপলস রিপাবলিক অব দ্য ডিসঅ্যাপিয়ার্ড’ বইটির জন্য বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। তাইপের সমসায়িক অধ্যাপকদের বিশ্বাস, বেঁচে থাকলেও তার আর বেশি দিন আয়ু নেই। শিগগিরই হত্যা করা হবে ভূগোলের প্রথিতযশা অধ্যাপককে। অথচ তাইপ ছিলেন চীনেরই রাষ্ট্রায়ত্ত জিন জিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃতী অধ্যাপক। নিখোঁজ হওয়ার আগেও তিনি ব্যস্ত ছিলেন নিজের অধ্যাপনায়। জাপানে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন তিনি।  আন্তর্জাতিক স্তরেও ভূগোলের ওপর তার পাণ্ডিত্য খ্যাতি এনে দেয়। ফ্রান্স তাকে সম্মান জানায়। তিনি নিজে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ২০১০ সালে জিনজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতিও হয়েছিলেন তাইপ।  

তাইপের বন্ধুরা জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে ইউরোপ যাওয়ার সময় বেইজিং বিমানবন্দরে তার বিদেশ যাত্রার অনুমতি বাতিল করা হয়। তিনি ফিরে যেতে চান জিনজিয়াং প্রদেশের রাজধানী উরুমকিতে। কিন্তু তাকে যেতে দেওয়া হয়নি সেখানেও। তারপর থেকে কোনও খোঁজ নেই তাইপের। তার বিরুদ্ধে আগে কোনও মামলা ছিলো না বলে পারিবারিক সূত্রে জানা যায়। এমনকি, বেজিং বিমানবন্দর থেকে অধ্যাপক তাইপ কোথায় গেলেন সেই রহস্যও আজও অজানা। তবে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ এনে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের জেরা করা চলছে এখনও।  

অধ্যাপক তাইপ একা নন, আন্তর্জাতিক ওয়াচডগদের হিসাবে লক্ষাধিক উইগুর এখন চীনে বন্দিদশায় রয়েছেন। গণহত্যা চলছে সেখানে। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে যাবতীয় মানবিক অধিকার। মুসলিমদের ধর্মচর্চা সবচেয়ে বড় অপরাধ কমিউনিস্ট চীনে। 'পুনঃশিক্ষা'র নামে বন্দি করে উইগুরদের কমিউনিজম শেখানো হচ্ছে। প্রতিবাদ করলেই কার্যকর হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।  

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল চীনকে অবিলম্বে উইগুরদের ওপর অত্যাচার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু নয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে পরিচিত চীন আন্তর্জাতিক জনমতকেও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উইগুরদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের বাধ্য করা হচ্ছে ক্রীতদাশের মতো আচরণ করতে। অর্থাৎ নামমাত্র পারিশ্রমিকে উইগুরদের বাধ্য করা হচ্ছে কারখানায় কাজ করতে। বুদ্ধিজীবীরা কোনও কথা বললেই তাদের লাশ পর্যন্ত গুম হয়ে যাচ্ছে। জেলে পচছেন হাজার হাজার উইগুর। আর জেলে না গিয়েও বন্দিশালায় নিজেদের সংস্কৃতি ভোলার পাঠ নিচ্ছেন বাকিরা। সন্তানধারণের স্বাধীনতাটুকুও হারিয়েছেন উইগুর মানুষরা। তাদের পোশাক নির্বাচনের স্বাধনীতাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান যেমন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশের মস্তিস্কটাকেই ভোঁতা করে দিতে চেয়েছিল, চীনও তেমনি রাজত্ব কায়েম করেছে জিনজিয়াঙে। তাইপ বা হাসানদের ঘটনা উদাহরণ মাত্র। বাস্তব পরিস্থিতি আরও নির্মম। কঠোর এবং নিষ্ঠুরও।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০২০
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।