ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

২৬ অক্টোবর পাকিস্তানের জন্য কালো দিবস

none | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২০
২৬ অক্টোবর পাকিস্তানের জন্য কালো দিবস

ইতিহাসে তথ্য বিকৃতি নতুন কিছু নয়। বরং মাঝে মধ্যেই প্রকৃত সত্য লেখা হয় না ইতিহাস বইয়ের পাতায়।

এটা হয় কখনও বা ঐতিহাসিকদের অজ্ঞানতার কারণে। প্রকৃত সত্য তাদের নাগালে এসে না পৌঁছানোর জন্য তারা ভুল করে ফেলেন। আবার কখনও ইচ্ছাকৃতভাবেই আসল ইতিহাস লুকিয়ে রাখতে এটা করা হয়। কিন্তু সত্য কখনও মাটিচাপা থাকে না। এটাও ইতিহাসেরই শিক্ষা। প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হবেই। আর সত্য উদঘাটিত হলে নতুন করে লেখা উচিত ইতিহাস। আর সেটা না হলে তো তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। তারা জানতে পারবে না প্রকৃত ইতিহাস। ভুল ধারনাগুলি তাদের মনেও থেকে যাবে। তাই প্রকৃত সত্য প্রকাশ পেলে সেটা তুলে ধরা উচিত সঠিকভাবে।

ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের তরুণদের দিকে তাকালে এটা যে কতো জরুরি সেটা বোঝা যায়। দশকের পর দশক ধরে ভুল তথ্য আর মিথ্যা প্রচার করে পাকিস্তান কাশ্মীরী তরুণদের মন বিষিয়ে দিয়েছে। এখনও অনেকের কাছেই গোপন রয়ে গিয়েছে কাশ্মীরের আসল ইতিহাস। এখন সময় এসেছে জম্মু ও কাশ্মীরের তরুণদের সামনে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার। ইতিহাসের আলোকে দাঁড়িয়ে তারাই পারবে নিজেদের ভবিষ্যত ঠিক করতে। আসল সত্য জানলে নিজেরা সমৃদ্ধ হবে নিজেদের মাতৃভূমি সম্পর্কে। ভাঙবে ভুল ধারনা। তাই প্রকৃত সত্য তাদের সামনে তুলে ধরা বিশেষ জরুরি।

প্রতি বছর পাকিস্তান ২৬ অক্টোবর 'ব্ল্যাক ডে' বা কালো দিবস হিসাবে পালন করে। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে আট মাসের যুদ্ধে ভারতের কাছে পরাজয়ের স্মৃতি আগলে তারা আজও পালন করে চলেছে কালো দিবস। ১৯৪৭-৪৮-এর সেই যুদ্ধেও শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়েছিল পাকিস্তান। সেনা জওয়ানদের পাশাপাশি তাদের সাহায্য করতে গিয়ে বহু উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ, পাক-সন্ত্রাসবাদীরাও সেই যুদ্ধে প্রাণ হারায়। দিনটিতে পাকিস্তান তাদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে। সেইসঙ্গে নিজেদের ব্যর্থতার কথাটিও সকলকে মনে করিয়ে দিতে চায়। বড় বেদনার তাদের এই পরাজয়ও। ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর কাশ্মীর আক্রমণের পরিণতি যে ভালো হয়নি সেটা ভালোই বোঝেন পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষ। তবু সেই পরাজয়ের স্মৃতিকে উস্কে দিয়ে আজও চলছে ভারত-বিদ্বেষ বাড়ানোর চেষ্টা। চলছে মিথ্যা প্রচারও।

কালো দিবসে পাকিস্তান শোক প্রকাশ করে নিজেদের দেশের নিহত সেনা ও অন্যান্যদের প্রতি। কিন্তু ভুলেও কাশ্মীর উপত্যকায় নিহত হাজারো মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা কখনও জানায়নি তারা। আসলে কাশ্মীরের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা তাদের নেই। রয়েছে শুধু অশান্তি বাঁধানোর বিষ। তাই পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে হাজার হাজার কাশ্মীরী সেদিন প্রাণ হারালেও আজও নীরব ইসলামাবাদ। সেদিনের নিহতদের মধ্যে বহু মুসলিম থাকলেও তাদের নিয়ে পাকিস্তানি সরকার বা জঙ্গি সংগঠনগুলি আজও কোনও মন্তব্য করেনি। বরং এখনও কাশ্মীরি মুসলিমদের হত্যা করতে জঙ্গিদের মদত দিয়ে চলেছে পাক-সেনারা। মুসলিমদের প্রতি পাকিস্তানের কোনও দরোদই প্রকাশ পায়নি। হিন্দু-মুসলিম-শিখ-সহ সকল সম্প্রদায়ের মানুষকেই সেদিন কতল করেছিল পাকিস্তানিরা। বারামুলা শহরেই পাক-হানাদারদের হাতে প্রাণ হারান ১৪ হাজার মানুষ। ধর্ষিতা হয়েছিলেন বহু কাশ্মীরী নারী।

বর্বরতার চরম সীমায় পৌঁছেছিল সেদিন পাক-হানাদারেররা। অথচ আজও পাকিস্তান সেই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেনি। হাজার হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করার পরও পাক-নাগরিকেরা কখনও দুঃখ প্রকাশ করেনি। এমনকী, বহু নারী ধর্ষিতা হলেও নীরব পাকিস্তানের তথাকথিত মানবতাবাদীরাও। নিজেদের ব্যর্থতা নিয়েই তাদের যতো মাথাব্যাথা। অথচ তাদের কারণে কাশ্মীরের বহু মানুষ প্রাণ হারালেন, পাকিস্তানি আদিবাসীদের বর্বরতার শিকার হলেন বহু কাশ্মীরি মুসলিম। বহু নারী হারালেন তাদের সম্ভ্রম, তাদের ইজ্জত। অথচ পাকিস্তানিরা সে বিষয়ে আজও নীরব। কাশ্মীর নিয়ে এতো কথা বললেও পাকিস্তানি হামলবাজদের সেদিনের নৃশংসতাকে নিয়ে টু শব্দটিও করতে নারাজ ইসলামাবাদ।

কিন্তু সত্য কখনও ধামাচাপা থাকে না। পাকিস্তানি ফৌজি কর্তার বয়ানেই উঠে এলো প্রকৃত সত্য। গোটা দুনিয়ার সামনে আজ স্পষ্ট, সেদিন বর্বরতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছিল পাকিস্তান। কাশ্মীরেও যে তারা গণহত্যা চালিয়েছে তা সেই ঘটনার সাক্ষী, খোদ পাকিস্তানি সেনাকর্তাই তার বইতে তুলে ধরেছেন। পাক-সেনার অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আকবর খান তার লেখা বইতে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন কাশ্মীর আক্রমণের যাবতীয় কৌশল ও ঘটনা প্রবাহ। আর এই আক্ররণ যে পাকিস্তানি রাষ্ট্রনায়কদের নির্দেশেই সেনাবাহিনী করেছিল, সেটাও জেনারেল সাহেবের বর্ণনায় স্পষ্ট। পাকিস্তানের হতাশা ও ষড়যন্ত্র সবই উঠে এসেছে বইটিতে। কাশ্মীর পেতে মরিয়া দেশটি অত্যাচার ও বর্বরতার সমস্ত রাস্তাই সেদিন ব্যবহার করেছিল। মহারাজা হরিসিং-এর কাছ থেকে কাশ্মীর ছিনিয়ে নিতে সেখানকার বাসিন্দাদের ওপর শুরু হয়েছিল ভয়ঙ্কর অত্যাচার। পাকিস্তানি হানাদারেরাই মহারাজ হরি সিংকে বাধ্য করেছিল ভারতীয় সেনা সাহায্য নিতে। কাশ্মীরের মানুষকে বাঁচাতে ভারতীয় সেনা বাহিনীর সহায়তা ছাড়া সেদিন আর কোনও পথই ছিলো না তার সামনে। এরপরই তো কাশ্মীর ভারতভুক্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। আন্তর্জাতিকভাবেই সেই চুক্তি স্বীকৃত। তারপর থেকেই কাশ্মীর ভারতের অঙ্গ হিসাবে গোটা দুনিয়াতেই স্বীকৃত। কারণ এই অন্তর্ভূক্তি প্রক্রিয়াটিতে অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয় ভারতের স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭। মেজর জেনারেল (অব.) আকবর খান তার বইটিতে এইসব বিষয়ও অবতারণ করেছেন। বহু প্রকৃত সত্য উঠে এসেছে পাকিস্তানি সেনাকর্তার কলামে।

'রেইডার্স ইন কাশ্মীর' বা 'কাশ্মীরের হামলাকারী' বইটিতে আকবর তুলে ধরেছেন পাকিস্তানি জননেতারা কীভাবে সেনাকে ব্যবহার করেছিল সেদিন। তাদের একটাই লক্ষ্য ছিল, কাশ্মীর দখল। তারজন্য সেখানকার মানুষদের খুন বা ধর্ষণ করতেও পিছপা হয়নি সেনারা। ওপর মহলের নির্দেশই ছিলো, কাশ্মীর চাইই। তারজন্য যাখুশি তাই করো। মহারাজার ওপর চাপ বাড়াতে পাক-বাহিনীর যাবতীয় কৌশল উঠে এসেছে বইটিতে। মহারাজ বাধ্য হয়েছিলেন ভারতের সাহায্য নিতে। অবশ্য মহারাজা হরি সিং প্রথম থেকেই চেয়েছিলেন স্বাধীন কাশ্মীর অথবা ভারতে যোগদান। কিন্তু পাকিস্তানে সঙ্গে কখনওই যেতে চাননি তিনি। কিন্তু পাকিস্তানি রাজনৈতিক শক্তি সেনাকে কাজে লাগিয়ে দখল করতে চেয়েছে কাশ্মীর।

কাশ্মীরে পাকিস্তানি হানার ইতিহাস অবশ্য সকলেরই জানা। এর পক্ষে বহু তার প্রমাণও রয়েছে। ঐতিহাসিকরা আগেও বহুবার তুলে ধরেছেন সেই তথ্য। কিন্তু পাকিস্তানি রাজনৈতিক জগতের সঙ্গে সেনাদের সম্মিলিত এই আক্রমণের ছক এবং নরসংহারের বিস্তারিত তথ্য সে দেশেরই একজন সেনাকর্তার লেখায় এর আগে সেভাবে উঠে আসেনি। কাশ্মীরি জনগণের ওপর নেতাদের নির্দেশে পাক-সেনা ও তাদের মদতকারী পাঠান বা অন্যান্য জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ যে বর্বরতার পরিচয় সেদিন দিয়েছে, সেটিও উঠে এসেছে বইটিতে। পুরোটাই হয়েছে পাকিস্তানি রাষ্ট্রনায়কদের ইচ্ছায়। মোহম্মদ আলি জিন্নাসহ পাকিস্তানের নেতারা সকলেই জানতেন কাশ্মীরের সেই ভয়ঙ্কর সেনা-সন্ত্রাসের ঘটনা। আকবরের বই থেকে স্পষ্ট, তাদের মদতেই হয়েছে সেনা-সন্ত্রাস। মহারাজা হরি সিং ও কাশ্মীরের বাসিন্দাদের আতঙ্কিত করে তোলাই ছিল পাকিস্তানের কৌশল। সেই কৌশলের কারণে প্রাণ দিতে হয়েছে হাজারো কাশ্মীরী যুবককে সেদিন। নারীরা অনেকেই হয়েছিলেন ধর্ষিতা।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশেই পাক-সেনারা সেদিন বেআইনিভাবে কাশ্মীর আক্রমণ করে। মহারাজা হরি সিংকে বাধ্য করে ভারতের অঙ্গ রাজ্য হিসাবে কাশ্মীরের যোগদানে। আসলে জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানি নেতাদের আরও ক্ষমতা, আরও এলাকা এবং আরও প্রভাব-প্রতিপত্তির নেশা গ্রাস করেছিল। নেতাদের সেই লোভের কারণেই কাশ্মীর আক্রমণ করতে বাধ্য হয় পাক-সেনা। আর তার পরিণামে হার মানতে হয় ভারতের কাছে। আসলে নিজেদের স্বার্থেই পাকিস্তানি রাষ্ট্রনায়কেরা শুরু থেকে ব্যবহার করেছে 'জম্মু কাশ্মীর ইস্যু'। জম্মু বা কাশ্মীরের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্রমাত্র ভালবাসা কখনওই প্রকাশ পায়নি। তাই ১৯৪৭-এর ৮ মাস যুদ্ধে কাশ্মীরের মাটিতে মানবাধিকারকে লুণ্ঠন করেছে পাক-সেনারা। উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল মানুষ খুনে। নির্বিচারে কাশ্মীরিদের হত্যা করে। ধর্ষিতা হন কাশ্মীরি মা-বোনেরা। আর সবটাই হয়েছিল নেতাদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে। আজও সেই ধারাই চলছে উপত্যকায়। ফলে আকবরের বইটি অত্যন্ত সময়োপোগী। কাশ্মীরের তরুণদের অনেক ভুল ধারনাই লোপ পেতে পারে।  দেরিতে হলেও পাকিস্তানি সেনাকর্তার লেখা 'রেইডার্স ইন কাশ্মীর' হামলাকারীদের চিনতে অনেককেই সাহায্য করবে। বইটি অনলাইনে পিডিএফ ফরম্যাটেও পাওয়া যাচ্ছে।  

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।