ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

মুম্বাই হামলায় জড়িত জঙ্গিদের তালিকা প্রকাশ পাকিস্তানের

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০২০
মুম্বাই হামলায় জড়িত জঙ্গিদের তালিকা প্রকাশ পাকিস্তানের

অবশেষে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা স্বীকার করতে বাধ্য হলো, ২০০৮-এর মুম্বাই হামলায় জড়িত ছিল পাকিস্তানি-জঙ্গিরা। ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এফআইএ) গত ১৮ নভেম্বর স্বীকার করেছে ২৬/১১ হামলা পাকিস্তানের মাটি থেকেই শুরু হয়।

হামলায় যুক্ত ছিলো ১৯ জন পাকিস্তানি-জঙ্গি। জঙ্গিদের বিশদ ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেছে এফআইএ।  

মূলত আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স বা এফএটিএফ-এর সাধারণ অধিবেশনের আগে ইসলামাবাদ নিজেদের স্বার্থেই জঙ্গিদের তালিকা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে। ভারত বহু আগেই ২৬/১১-র হামলায় পাকিস্তানি-নাগরিকদের যোগাযোগের নথি প্রকাশ করেছিল।

এফআইএ ২৬/১১ হামলায় পাকিস্তানি নাগরিকদের সক্রিয় ভূমিকার কথা প্রকাশ করেছে। করাচি থেকে জঙ্গিরা সমুদ্রপথে মুম্বাই রওনার আগে নৌকা থেকে শুরু করে সমস্ত ব্যবস্থাই করেছিল। ৮৮০ পাতার তালিকায় বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছে এফআইএ। মুলতানের মুহাম্মাদ আমজাদ খান জঙ্গিদের মুম্বাই পৌঁছানোর জন্য আল ফৌজ নৌকাটি কেনে। এই নৌকাটি করেই জঙ্গিরা মুম্বাই পৌঁছায়। নৌকার জন্য ইয়ামাহা ইঞ্জিন, লাইফ জ্যাকেট প্রভৃতি সংগ্রহ করে। নৌকাটি আমজাদ কিনেছিল করাচির এআরজেড ওয়াটার স্পোর্টস থেকে ভাওয়ালপুরের শাহিদ গাফুরের নামও রয়েছে এফআইএ-র তালিকায়। আল-হুসেইনি ও আল-ফাউজ নৌযানের নাবিক ছিল সে।  

তালিকায় নৌযানের ৯ ক্রু মেম্বারেরও নাম রয়েছে। এরা সবাই ছিল মুম্বাই হামলার সঙ্গে জড়িত। সাহিওয়ালের মুহাম্মাদ উসমান, লাহোরের আতিক-উর-রহমান, হাফিজাবাদের রিয়াজ আহমেদ, গুরজানওয়ালার মুহাম্মাদ মুস্তাক, ডেরা গাজি খানের মুহাম্মাদ নঈম, সারগোধার আব্দুল শাকুর, মুলতানের  মুহাম্মাদ সাবির, লোধরানের মুহাম্মাদ উসমান, রহিম ইয়ার খান শাখিল আহমেদ-এর নাম প্রকাশ করেছে এফআইএ। পাক-গোয়েন্দারা

অবশেষে স্বীকার করলেন, এরা সকলেই মুম্বাই হামলার সঙ্গে জড়িত লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য। জাতিসংঘ বহু আগেই লস্করকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছে।

২০০৮ সালে পাকিস্তানের বন্দর শহর করাচি থেকে নৌপথে এসে ভারতের বাণিজ্য নগরী মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলা চালায় পাকিস্তানি-জঙ্গিরা। ভয়ঙ্কর জঙ্গি হানায় ভারতীয়রা ছাড়াও আমেরিকা, মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের ১৭০ জন প্রাণ হারান। আহত হন প্রায় ৩০০ মানুষ। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী জঙ্গিদের দমন করতে তিন দিন সময় নেয়। হামলার সঙ্গে যুক্ত আজমল কাসভই একমাত্র জীবিত অবস্থায় ধরা পড়ে। পরে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার ফাঁসি হয়। ফাঁসির আগে আজমল মুম্বাই হামলায় পাকিস্তানি-ষরযন্ত্রের কথা স্বীকার করে। হামলার প্রায় এক যুগ পর পাকিস্তান প্রশাসন অবশেষে প্রকাশ করলো জঙ্গিদের তালিকা। তাও হামলার মূলহোতাদের নাম নেই। ভারত বহু আগেই সমস্ত প্রমাণ দিয়েছিল। কিন্তু এতোদিন সন্ত্রাসীদের আড়াল করে গেছে পাকিস্তান। এখন আন্তর্জাতিক চাপের কাছে মাথানত করতে বাধ্য হলো ইসলামাবাদ।

এফআইএ-র তালিকা মুম্বাইয়ের হামলাকারীদের 'মোস্ট ওয়ান্টেড' বলে বর্ণনা করেছে। বলা হয়েছে ১৯ জন পাকিস্তানি জঙ্গি মুম্বাই হামলার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল। এফআইএ-র ৮৮০ পাতার দলিল দস্তাবেজে লস্কর-ই-তৈয়বা জঙ্গি গোষ্ঠীকে 'বিলুপ্ত' বলেও উল্লেখ করা হয়। ভারত প্রথম থেকেই লস্করের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সরব ছিলো। বহু প্রমাণ তুলে দিয়েছে পাকিস্তানের হাতে। ২০০৮ সালের হামলার পরও পাকিস্তান জঙ্গিদের বিষয়ে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। পরে আন্তর্জাতিক চাপে ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি এফআইএ মুম্বাই হামলা নিয়ে একটি মামলা করে। এখনও পর্যন্ত ২৭ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে তারা। এদের মধ্যে ২০ জনকে অপরাধী হিসাবে ঘোষণা করেছে গোয়েন্দা সংস্থাটি। তবে মামলা এখনও চলছে। আদালত ঘটনার ১২ বছর পরও মামলা শেষ করতে পারেনি।

এদিকে, মুম্বাই হামলায় ব্যবহৃত নৌকার ইঞ্জিন কেনা নিয়ে তদন্তের স্বার্থে জাপানে গিয়েছিলেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)এর গোয়েন্দারা। জাপানে ইয়ামাহা মোটরসের সদর দপ্তর থেকে তারা জানতে পারেন করাচির ইয়ামাহা ডিলারের কাছ থেকে লস্করের অর্থদাতা আমজাদ খান আটটি ইঞ্জিন কেনে। এই নৌযানগুলো থেকেই ১০ পাকিস্তানি-জঙ্গি মুম্বাই হামলায় অংশ নিতে গিয়েছিল।

এফআইএ-র রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, মুম্বাই হামলার আরেক ষড়যন্ত্রকারী লস্কর জঙ্গি। ইফতিহার আলি ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল বা ভিওআইপি-র জন্য ইসলামাবাদের ইওরো ২০০৫ মানি চেঞ্জারে ২৫০ মার্কিন ডলার জমা দেয়। এই ভিওআইপি আল হুসসাইনি ও আল ফৌজ শাহিদ গফফুর নৌযানের ক্যাপ্টেন, ক্রু মেম্বার আবদুল রহমান উসমান, আতিক-উপ-রহমান, রিয়াজ আহমেদ, নঈম, আবদুল শাকুর, সাবির সাল্কি, উসমান, শাকিল আহমেদদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ব্যবহৃত হতো  ভিওআইপি। উসমান জিয়া, আব্বাস নাসির, জাভেদ ইকবাল, মুখতার আহমেদ, আহমেদ সাঈদ ও মুহাম্মাদ খান জঙ্গি হামলায় অর্থায়নে যুক্ত ছিলো। পাকিস্তানি সাংবাদিকদের জন্যও উন্মুক্ত এফআইএ-র রিপোর্টে।  

রিপার্টে বলা হয়েছে, 'ফেডারেল গভর্মেন্ট গোষ্ঠীগুলোকে সনাক্ত করতে একাধিক নতুন আইন সামনে নিয়ে এসেছে। বিভিন্ন প্রাশাসনিক ও নিরাপত্তা বাহিনী একযোগে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারছে এখন। ' এফআইএ মোট ১ হাজার ২১০ জন মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গির নাম প্রকাশ করেছে। বলা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়েই এই তালিকা তৈরি হয়েছে।

সামনের বছরেই বসছে উন্নত দেশগুলোর ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স-এর অধিবেশন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির মতো কঠিন সিদ্ধান্তও গৃহীত হতে পারে। কারণ সন্ত্রাস দমনে ৬টি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল ইসলামাবাদকে। ব্যবস্থা না নিলে কালোতালিকাভুক্ত হওয়ার ভয় রয়েছে ইমরান খান সরকারের।  

তাই এফএটিএফ-এর ভয়ে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিতেই হতো পাকিস্তানকে। মুম্বাই হামলার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেদিকেও নজর ছিল বহু দেশের। তাই ঘটনার ১২ বছর পর পাকিস্তান ২৬/১১-র হামলায় যুক্ত জঙ্গিদের কয়েকজনের নাম প্রকাশ করতে বাধ্য হলো। তারা অবশেষে স্বীকারও করলো, পাকিস্তানের মাটিতেই রচিত হয়েছিল মুম্বাই হামলার ব্লু-প্রিন্ট। পাকিস্তানি-জঙ্গিরা করাচি থেকেই এসেছিল মুম্বাইতে হামলা চালাতে। এর জন্য তারা সময় নিলো ১২ বছর।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।