ঢাকা: বর্তমান বিশ্বে ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক উত্তেজনার জেরে সুপার পাওয়ারদের মধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে মানুষ যতোটা না শঙ্কিত তার চেয়ে বেশি শঙ্কার বিষয় হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক উষ্ণতা।
আশা করা যায়, বিশেষ করে অর্থনীতিতে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ার কারণে আলোচনার মাধ্যমে হয়ত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানো যাবে অথবা অন্তত দীর্ঘায়িত হবে।
এনিয়ে বিজ্ঞানী, পরিবেশবাদী সংগঠন এবং ভুক্তভোগী দেশগুলোর দফা দফায় বৈঠক কোনো সমাধান খুঁজে বের করতে পারছে না। দায়ী দেশগুলোর এই নিয়ে কতোখানি মাথাব্যাথা রয়েছে তা নিয়ে সাধারণের মধ্যে সন্দেহ দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে কানকুন ও ডারবানের প্রায় ব্যর্থ সম্মেলন এখন হাস্যরসের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এইসব সম্মেলনকে অনেকে হাই প্রোফাইলদের বনভোজন বলেও আখ্যা দিতে কসুর করেন না। এ নিয়ে গবেষকদের আচরণ নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ক্লাইমেটগেট সিরিজ ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর বিজ্ঞানীদের সততা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ক্লাইমেটগেটের তথ্য অনুযায়ী, গবেষকদের অনেকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিতে রাজনীতি ঢুকিয়েছেন। তারা একে রাজনীতিকরণ করার চেষ্টা করছেন।
এইসব দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আর শিল্পোন্নত দেশগুলোর দায় এড়ানো মানসকিতার কারণে বাংলাদেশের মতো সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলোর জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় অনেকটা অনিবার্য হয়ে উঠছে।
সম্প্রতি এক বৈজ্ঞানিক জরিপে দেখা গেছে, পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশেরও বেশি বরফের খনি এন্টার্কটিকায় (দক্ষিণমেরু) বরফ গলে যাওয়ার হার বেড়ে গেছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে সেখানে এত দ্রুতগতিতে বরফ গলছে যে, বরফের বিশাল বিশাল চাঁই বা আইসবার্গ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ফলে সমূদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে ভয়াবহ ভাবে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, দক্ষিণ পেনিনসুলার বিস্তৃত অঞ্চলের পশ্চিম এন্টার্কটিক বরফখণ্ড যে পরিমাণ পানি ধরে রাখে যা গলে গেলে সমূদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০ ফুট বেড়ে যাবে। এরমধ্যেই এন্টার্কটিকার পাইন আইল্যান্ড সংলগ্ন হীমবাহসহ আরো বরফ গলতে শুরু করেছে আশংকাজনক হারে। খুব শিগগির এর প্রভাব পড়বে উপকূলীয় নিচু অঞ্চলে।
এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা বলছেন, হীমবাহ গলা এবং সমূদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার বৃদ্ধি নির্ভর করে মূলত দুই ধরনের বরফের ওপর। যার কিছু রয়েছে ভূপৃষ্ঠের উপর বাকিটা বিস্তৃত সমূদ্রে। এরমধ্যে অবশ্য সাগরে ভাসতে থাকা ফাঁপা বরফখণ্ড সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াবে না কারণ যতোটুকু জায়গা দখল করার তাতো করেই রেখেছে। কিন্তু ভাসমান নিরেট বরফগুলোই ভয়ের কারণ। তার ওপর ছোট পাহাড়গুলোর বরফ গলতে শুরু করলে এন্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ড অঞ্চলই হবে সমূদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতার বাড়ানোর প্রধান অংশীদার।
তবে আগামী শতকে সমূদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ঠিক কতটা বাড়বে সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। সে যাই হোক, এ কারণে বিশ্বের বড় বড় বন্দর শহরগুলোর প্রায় ৪ কোটি মানুষ ভয়াবহ সামূদ্রিক বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। ভয়ের বিষয় হলো, আগামী অর্ধ শতকের মধ্যেই আক্রান্তের এ সংখ্যা প্রায় তিনগুণ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনকি এর থেকে রক্ষা পাবে না যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোও।
যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে- মিয়ামি বিচ, লুইজিয়ানা ও টেক্সাস উপকূল। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, সমূদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা আর মাত্র ১০ মিটার বাড়লেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিটন ডিসির উপকূলীয় অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রায় ৬৮ হাজার মানুষ। অর্থের হিসাবে ক্ষয়ক্ষতি হবে প্রায় ২শ’ কোটি ডলার। তবে মূল ক্ষতিটা হবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর। কারণ এসব দেশের অনুন্নত অবকাঠামোর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা। এরমধ্যে সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে ইতিমধ্যেই পড়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ দেশ মালদ্বীপ। এছাড়া এ অঞ্চলে রয়েছে বাংলাদেশের মতো নিচু উপকূলীয় দেশ।
গবেষণায় দেখা গেছে, সমূদ্রের উচ্চতা আর মাত্র এক মিটার বাড়লেই বাংলাদেশের প্রায় ২২ থেকে ৩৫ লাখ মানুষ হারাবে তাদের বাসস্থান। যা ২০৫০ সালের মধ্যেই ঘটবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এছাড়া এর ফলে মাত্র ১ লাখ ৪৪ বর্গ কিলোমিটারের এই দেশটিতে বিপর্যয় ঘটবে উৎপাদন ব্যবস্থায়ও। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এই দেশটির কৃষি জমিতে সমূদ্রের লবণাক্ত পানি ঢুকে নষ্ট হবে উর্বরতা। ফলে দেশের প্রায় ২০ লাখ কৃষক আবাদি জমি হারিয়ে জীবিকার সন্ধানে ছুটবে শহরের দিকে। এতে শহরগুলোতে চাপ।
সবচে খেদের বিষয় হলো- বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য কিন্তু বাংলাদেশ বা মালদ্বীপের মত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো নয়। শিল্পোন্নত দেশগুলোর সীমাহীন গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ, জৈব জ্বালানির ব্যবহার করার কারণেই এই বিপর্যয় নেমে এসেছে। এ কারণে উন্নত দেশগুলোর কাছে ক্ষতিপূরণও দাবি করে আসছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। উন্নত বিশ্ব বারবার ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিলেও সত্যিকার অর্থে কিছুই করছে না। তাই সমূহ বিপদ এড়াতে যেকোনো মূল্যে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনতে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে দেওয়া প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ দিতে দায়ী ধনী দেশগুলোকে বাধ্য করতে হবে বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ সময়: ২২২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১২