ঢাকা: ৯/১১ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র যতোটা না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সারা বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায়। এটা এই অর্থে যে, ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা তো বটেই সাধারণ মুসলমানরাও পড়েছে নিরাপত্তা হুমকিতে।
অনেকে অযথা হয়রানির শিকার হয়েছে। সন্ত্রাস দমনের নামে সবচে বিতর্কিত যে কাজটি যুক্তরাষ্ট্র করেছে তা হলো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই বিনা বিচারে দিনের পর দিন আটক রাখা। নির্যাতনের সুবিধার জন্য সুদূর কিউবাতে স্থাপিত গুয়ান্তানামো বে কারাগার এইসব ঘটনার সাক্ষী হয়ে এখনো আছে, থাকবেও চিরদিন।
গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠন এবং সাধারণ মানুষের সমালোচনার মুখে কিছু কিছু বন্দিকে বিচারের আওতায় এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। অনেকে এখনো বন্দি। তাদের মধ্যে কারো মামলা চলছে। ভাগ্যবান কেউ মুক্তি পেয়েছেন। এমনই একজন মুসলমান মুরাট কুনাজ। ‘Five Years of My Life: An Innocent Man in Guantánamo’ বইয়ের লেখক তিনি। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত গুয়ান্তানামোতে বিনা বিচারে আটক ছিলেন তিনি। তারই লেখা স্মৃতিচারণের কিছু অংশ বাংলানিউজ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
গুয়ান্তানামো বে ছেড়ে এসেছি যেখানে টানা পাঁচ বছর দুঃসহ জীবন কাটিয়েছি। ফেরার সময় আমার হাত থেকে কোমড়, কোমড় থেকে পায়ের টাকনু এবং টাকনু থেকে বিমানের বোল্ট পর্যন্ত শেকল দিয়ে বেধে রাখা হয়েছিল। চোখ কান বাঁধা, লম্বা কাপড়ে ঢাকা মাথা। যদিও আমি সেই বিমানে একমাত্র বন্দি তবু আমার পাহারায় ছিল কমপক্ষে ১০ জন সেনা।
আমার জাম্পস্যুটটা কিন্তু গুয়ান্তানামোর কমলা রংয়ের না হয়ে আমেরিকান দেনিমই ছিল। আমি পরে জেনেছি, গুয়ান্তানামো থেকে আমার বাড়ি জার্মানির রামস্টেইন পর্যন্ত যে সামরিক বিমানে করে আমাকে নেওয়া হয়েছিল তাতে খরচ হয়েছিল ১০ লাখ ডলারেরও বেশি।
বিমান ল্যান্ড করার পর আমাকে জার্মান কর্মকর্তাদের হাতে সোপর্দ করার আগে একজন আমেরিকান কর্মকর্তা আমার শেকল খুলে দিল। মার্কিন কর্মকর্তা আমার হাত প্লাস্টিকের দড়ি দিয়ে বাঁধতে চাইল কিন্তু জার্মান কর্মকর্তা তাকে বাধা দিলেন। তিনি জোরালো আপত্তি জানিয়ে বললেন, ‘ইনি তো কোনো অপরাধ করেননি; তিনি এখানে সম্পূর্ণ স্বাধীন মানুষ। ’
ব্রেমেনের মাধ্যমিক স্কুলে আমি খুব একটা ভাল ছাত্র ছিলাম না। স্কুলে পড়েছিলাম, সেটা এখনো আমার মনে আছে: ন্যুরেনবার্গ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর জন্য আমেরিকানরাই পিড়াপিড়ি করেছিল। এর ধারাবাহিকতাই কিন্তু জার্মানির গণতন্ত্রের পথে পথচলা শুরু। কিন্তু আজ ভাবলাম, কী অদ্ভুত! টারমাকে দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই আমেরিকানকেই আইনের শাসনের মৌলিক বিধান শেখাচ্ছে জার্মানরা!
এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম কী করে? ২০০২ সালের ১১ জানুয়ারি কিউবার গুয়ান্তানামো বে’তে আমেরিকার নৌঘাঁটিতে কুখ্যাত বন্দিশিবির স্থাপন করা হয়। সেখানে আমি পাঁচ বছর কাটিয়েছি। এক একটা দিন কী দুঃসহ যন্ত্রণায় মধ্য দিয়ে কেটেছে। আমি কোনো সন্ত্রাসী নই। আল কায়েদার কোনো সদস্য বা সমর্থকও কখনো ছিলাম না আমি। আমি তাদের আদর্শও ঠিক বুঝি না।
এক তুর্কি অভিবাসী দম্পতির সন্তান আমি। বাবা-মারা কাজের সন্ধানে জার্মানি চলে আসেন। আমার বাবা মার্সিডিজের একটি কারখানায় কয়েক বছর কাজ করেছেন। ২০০১ সালে যখন আমার বয়স ১৮ বছর তখন খুব ধর্মপ্রাণ তুর্কি একটি মেয়েকে বিয়ে করি। এরপর থেকেই আরো সুন্দর জীবনের সন্ধানে ইসলাম সম্পর্কে আরো জানার আগ্রহ তৈরি হলো। আমার হাতে যথেষ্ট টাকা ছিল না। আমার শহরের বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেকে পরামর্শ দিলেন, একটি ধর্মী দলের সঙ্গে পাকিস্তানে কোরান শিক্ষা নেওয়ার জন্য যাওয়া যেতে পারে।
পাকিস্তান যাওয়ার সিদ্ধান্তটা নিলাম আমি ঠিক ৯/১১ এর আগে। আমার বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর, বুঝিইনি যে, আফগানিস্তান যুদ্ধ পাকিস্তানে কোনো প্রভাব ফেলবে বা সেখানে গেলে আমার কোনো সমস্যা হবে। সুতরাং আমি নিশ্চিন্ত মনেই সেখানে গেলাম।
এর একদিন জার্মানি ফিরব বলে পাকিস্তানে একটি পাবলিক বাসে করে বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছি, পুলিশ আমাদের বাসটি থামাল। ওই বাসে আমিই একমাত্র অপাকিস্তানি ছিলাম। অনেকে মজা করে বলল, লালচে চুলের কারণে আমাকে আইরিশ মতো লাগে। সুতরাং কাগজপত্র পরীক্ষা করবে এবং কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে বলে পুলিশ আমাকে নামিলে আনল। জার্মান সাংবাদিকরা আমাকে বলেছিলেন, তারা নাকি সেখানে একই ঝামেলায় পড়েন। কিন্তু আমি তো সাংবাদিক নই, একজন পর্যটক। তাদের একথা বুঝাতে চেষ্টা করলাম আমি। পুলিশ আমাকে তাদের হেফাজতে নিল, তবে প্রতিশ্রুতি দিল খুব শিগগির আমাকে বিমানবন্দর পৌঁছে দেবে।
এর কয়েকদিন পরে পাকিস্তানি পুলিশেরা আমাকে মার্কিন কর্মকর্তাদের হাতে সোপর্দ করল। আমি এই ভেবে একটু স্বস্তিবোধ করলাম যে, আমেরিকানরা আমার সাথে ভাল ব্যবহারই করবে।
পরে জেনেছি, আমাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আমেরিকানরা ৩ হাজার ডলার দিয়েছিল। আমি তখন এটা বুঝিনি। তবে দেখলাম সারা আফগানিস্তানে এরকম হাজার হাজার লিফলেট বিমান থেকে ফেলা হচ্ছে। তাতে লেখ রয়েছে, এই তালিকায় নাম রয়েছে এমন তালেবান বা আল কায়েদা সদস্যদের যারাই সংগঠন ছেড়ে দেবে তাদের, তাদের পরিবার, গোষ্ঠী এবং সারা জীবন ভালোভাবে চলতে পারে এমন যথেষ্ট টাকা পয়সা দেওয়া হবে। ঠিক একারণে গুয়ন্তানামোর অনেক বন্দি ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
আমাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হলো আফগানিস্তানের কান্দাহারে। এখানে আমেরিকানরা আমাকে বারবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে থাকল: ওসামা বিন লাদেন কোথায়? আমি আল কায়েদার সঙ্গে ছিলাম কি না? আমি জবাবে ততোবারই তাদের বলেছি- আমি আল কায়েদাতে ছিলাম। বিন লাদেনের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওরা আমার মাথা পানিতে চুবাতো, পেটে ঘুষি দিত, এটাকে ওরা কখনো ওয়াটারবোর্ডিং বলতো না কিন্তু এটা আসলে তার চেয়ে কম কিছু ছিল না। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে ডুবেই মারা যাব।
এক পর্যায়ে আমার হাতে শিকল বেঁধে ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হলো এভাবে কয়েকদিন পর্যন্তও রাখা হতো। মাঝে মাঝে একজন চিকিৎসক এসে দেখে যেতেন ঠিক আছি কি না, এর পর আবার ঝুলে রাখা হতো। সেকি অসহ্য যন্ত্রণা!
কান্দাহারে প্রায় দু্’মাস রাখার পর আমাকে পাঠানো হলো গুয়ান্তানামোতে। সেখানে তারা আরো বেশি মারধর করতো। দিনের পর দিন একা একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটক রাখত, কখনো অত্যন্ত গরম বা বরফ শীতল তাপমাত্রার মধ্যে রাখা হতো এবং টানা কয়েকদিন ঘুমাতে দেওয়া হতো না।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রশ্নগুলোতে কোনো ভিন্নতা ছিল না। সব সময় একই প্রশ্ন করতো। একই গল্প আমি বারবার বলতাম- আমার নাম, পরিবার, কেন আমি পাকিস্তানে গেলাম এসব। কোনো কিছুই তাদের সন্তুষ্ট করতে পারল না। আমি বুঝলাম, প্রশ্নকর্তারা আসলে আমার সত্য কথাগুলো শুনতে মোটেও আগ্রহী নয়।
এতোসব সত্ত্বেও আমার মধ্যে মানবিক আবেগ বেঁচে ছিল। আমি পশু-পাখি খুব পছন্দ করতাম। যে সামান্য রুটি এবং খাবার দেওয়া হতো সেখান থেকে সামান্য একটুকরা রেখে দিতাম, বেড়ার ফাঁক গলে কিছু ইগুয়ানা আসত তাদের জন্য এগুলো আমি রেখে দিতাম। কর্মকর্তারা যখন এটা জানতে পারল তখন তারা আমাকে একটানা ৩০ দিন একা অন্ধকার বাসের শাস্তি দিল।
আমি প্রায়ই কিছু ব্যাপার নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়তাম: আমি কেন এখানে? সব গোয়েন্দা তথ্য দিয়েও যুক্তরাষ্ট্র সততার সঙ্গে বিশ্বাস করবে না যে আমি আল কায়েদা, করবে কি?
২০০৪ সাল গুয়ান্তানামোতে আড়াই বছর কেটে গেছে। আমাকে তথাকথিত কমবেট্যান্ট স্ট্যাটাস রিভিউ টাইব্যুনালে তোলা হলো। একজন সামরিক কর্মকর্তা বললেন, আমি হলাম ‘শত্রু যোদ্ধা’ কারণ ২০০৩ সালে জার্মানিতে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় নাকি আমার বন্ধু জড়িত ছিল। আমার কোনো বন্ধু এমন কাজ করতে পারে আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না, আর যদি করেই থাকে তার তো আমি কিছুই জানি না।
এর সপ্তাহ দুই পরে আমাকে বলা হলো একজন আইনজীবীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়া হবে। তারা একটি বিশেষ সেলে নিয়ে গেল, সেখানে আমেরিকান আইনের অধ্যাপক বাহের আজমির সঙ্গে দেখা হল। আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি এই লোক সত্যিকারের কোনো আইনজীবী। কারণ এখানে জিজ্ঞাসবাদকারীরা সব সময় মিথ্যা বলে আর আমাদের সঙ্গে ছলচাতুরি করে। কিন্তু আজমি সাহেব আমাকে আমার মায়ের হাতে তুর্কিতে লেখা একটি নোট পড়ে শুনালেন। এটা দেখে আমার বিশ্বাস হলো। আসলে জার্মানিতে আমার শহরে মা একজন আইনজীবীর কাছ থেকে শুনেছেন- সেন্টার ফর কনস্টিটিউশনাল রাইটসের আইনজীবীরা গুয়ান্তানামো বন্দিদের জন্য কাজ করছে। আজিমিকে আমার ব্যাপারটি দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
আজমি সাহেব আমার বিরুদ্ধে আনা তথ্য প্রমাণগুলোয় বিশ্বাস করলেন না। খুব দ্রুতই তিনি আমার সেই ‘আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী’ বন্ধুকে সন্ধান করে বের করলেন। সত্য ঘটনা হলো সে তখনো বহাল তবিয়তে জার্মানিতেই আছে এবং ভাল আছে।
এর পর আজমি, আমার মা এবং জার্মানির আইনজীবীরা জার্মান সরকারকে আমার মুক্তির জন্য পদক্ষেপ নিতে চাপ দিলেন। সম্প্রতি আজমি ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জার্মান এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিছু গোয়েন্দা নথি প্রকাশ করেছেন যাতে দেখা যাচ্ছে, উভয় দেশের তথ্য অনুযায়ী আমি নির্দোষ ছিলাম। এর মধ্যে একটা নথিতে বলা আছে, আমেরিকান সামরিক গার্ডরা আমাকে বিপজ্জনক বলে সন্দেহ করেছিল কারণ আমি আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় নামাজ পড়ছিলাম!
মুক্তির পর আমার পাঁচটি বছর কেটে গেছে। সেই বিভিষীকাময় স্মৃতি এখন আমি পেছনে ফেলে এসেছি। আমি আবার বিয়ে করেছি, আমাদের একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান হয়েছে। গুয়ান্তানামোর সেই সব দিনগুলোর কথা চাইলেও ভুলতে পারি না। আমি এখনো ভাবি, কী করে একটা গণতান্ত্রিক সরকার এরকম একটি অসহনীয় অবস্থার মধ্যে বন্দিদের রাখে তাও আবার কোনো প্রকার সুষ্ঠু বিচার ছাড়াই!
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ভাষান্তর: জাহাঙ্গীর আলম, নিউজরুম এডিটর।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১২