টোকিও থেকে : গত বছর এদিন প্রকৃতির রুদ্ররোষে অসহায় মানুষ হারিয়েছে জীবন, সম্পদ। নিশ্চিহ্ন হয়েছে জনপদ।
১১ মার্চ, ২০১১ শুক্রবার বিকেল দুইটা ৪৬ মিনিট, জাপানের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে শক্তিশালী ৮ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, ইতিহাসে অন্যতম বড় ভূমিকম্প।
ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট সুনামি তোহোকু অঞ্চলের প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলবর্তী এলাকা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। প্রবল বেগে ছুটে চলা পানির উচ্চতা ৪০ মিটার পর্যন্ত উঠে যায়। বিশ্বে নথিভুক্ত এ যাবতকালের মারাত্মক সুনামির মধ্যে এটি ছিল ৪ নম্বরে। সর্বশেষ তথ্য মতে, এই সুনামি ও ভূমিকম্পে নিহত মানুষের সংখ্যা ১৫ হাজার ৮৫৪ জন, নিখোঁজ হয় আরো ৩ হাজার ২৭২ জন। আরেক হিসেবে প্রায় ২০ হাজার মানুষ নিহত হয়।
এর মধ্যে মিয়াগি জেলায় ৯ হাজার ৫১২ জন, ইওযাতে জেলায় ৪,৬৭১ জন ও ফুকুশিমা জেলায় ১৬০৫ জনের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে ২০ হাজার বাড়ি-ঘর ও স্থাপনা ভেসে গেছে। এদের মধ্যে ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ এখনো অস্থায়ী নিবাসে বাস করছে। দুর্ঘটনা পরবর্তী এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সব কিছুই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। প্রচণ্ড শীত আর আশ্রয়হীন মানুষের সেই সময়ের করুণ দিনগুলি মনে করলে এখনও তাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।
১১ মার্চ ভূমিকম্পের উত্সস্থল হোনশুর ১৩০ কিমি পূর্বে যে স্থানে দুটো টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল, সেখানে ভূমিকম্পে একটি টেকটোনিক প্লেট নিচে নেমে যায়। এখন ভূমিকম্প সৃষ্ট সাগর তলার ফাটল পর্যবেক্ষণ করতে সমুদ্রের হাজার মিটার নিচে উচ্চ প্রযুক্তির যান পাঠাচ্ছে জাপান ও জার্মানির বিজ্ঞানীরা।
বিশ্বের ভূমিকম্প সম্ভাবনার দেশ জাপান, আবার ভূমিকম্প মোকাবিলার সেরা দেশও এই জাপান। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতির শহর টোকিও। এই শহরেই যে কোনো মুহূর্তে ফের বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ১১ মার্চের ভূমিকম্পের পরে টোকিওর বে অঞ্চলে টেকটোনিক প্লেট তিনগুণ শক্তিশালী হয়েছে। এমনিতেই এই শহরে প্রতিদিন ৫-৬ বার ভূমিকম্প হয়। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ৭ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৬,৪০০ মানুষ নিহত হবে, ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ আহত হবে এবং ৪ লাখ ৭১ হাজার বাড়ি-ঘর ধসে পড়বে। তবে ভূমিকম্পের মাত্রা ৭ দশমিক ৯ হলে ১ লাখ ৪২ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটবে।
ফুকুশিমা দাইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১১ মার্চের ভূমিকম্পে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই প্লান্টে। পুরো বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ১ নং চুল্লি ভবন হাইড্রোজেন বিস্ফোরণে গুড়িয়ে যায়। ৩ নং চুল্লি ভবনেও বিস্ফোরণ ঘটে। ২ নং চুল্লিও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানি আবর্তিত করে পারমাণবিক জ্বালানি শীতল রাখার যে ব্যবস্থা সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। একই সঙ্গে জ্বালানি দণ্ডগুলো গলতে শুরু করে। এর ফলে বিপুল হারে তেজস্ক্রিয় পদার্থ বাতাস ও সমুদ্রের পানিতে ছড়িয়ে পড়ে।
সর্বশেষে জুন মাসে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বিশেষ ধরনের যান্ত্রিক প্রয়োগের ফলে সেপ্টেম্বর মাস থেকে ফুকুশিমার থেকে বিকিরণ নিয়ন্ত্রণে আসে।
ফুকুশিমা পারমাণবিক চুল্লিটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করার ক্ষেত্রেও নানা প্রতিবন্ধকতা আছে। বর্জ্য স্থানান্তরের জন্য কমপক্ষে ৩ বছর, ক্ষতিগ্রস্ত জ্বালানি দণ্ডকে সরাতে লাগবে ১০ বছর, পুরো প্লান্টটি সম্পূর্ণ বন্ধ করতে লাগবে কমপক্ষে ৩০ বছর। এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ হেরাল্ড ডেন্টনের অভিমত বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের থ্রি-মাইল আইল্যান্ডে পারমাণবিক দুর্ঘটনা সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল । তিনি বলেন, এটি বেশ কঠিন কাজ। বিকিরণ ঠেকাতে নতুন উদ্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের মানসিকতা নিয়ে এগুতে হবে।
ঘুরে দাঁড়ানো আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে জাপান এই মারাত্মক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বলা যায় ইতিমধ্যে অনেকটা কাটিয়েও উঠেছে।
সরকারের নিজস্ব সম্পদ ও সারা পৃথিবী থেকে গৃহীত সাহায্য সহযোগিতার সমন্বয়ে গত এক বছর অনেক অসাধ্য সাধন করেছে । বন্ধ হয়ে যাওয়া বুলেট ট্রেন শিনকানসেন ২৫ এপ্রিল চালু হয়েছে। বিধ্বস্ত সেন্দাই এয়ারপোর্ট এক মাস পরেই নিয়মিত সার্ভিস দিচ্ছে।
এই প্রতিবেদক সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মিয়াগি জেলার ইশিনোমাকি ও কেসেন্নুমা অঞ্চলে দুবার গিয়ে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের ধারা লক্ষ্য করেছে।
শেষ কথা
এই সুনামিতে হাজার হাজার মানুষ ভেসে গেছে। বাড়িঘর বিলীন হয়েছে কিন্তু এই সুনামির ফলে মানুষের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নতুন করে দাঁড়ানোর।
লেখক: সম্পাদক, পরবাস (www.porobas.com), জাপানের বাংলা কাগজ
kaziensan@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১২