ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

কালের সাক্ষী ‘সোনামসজিদ’: ঐতিহ্য রক্ষার নেই উদ্যোগ

শরীফ সুমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১০ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১৫
কালের সাক্ষী ‘সোনামসজিদ’: ঐতিহ্য রক্ষার নেই উদ্যোগ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চাঁপাইনবাবগঞ্জের (সোনামসজিদ) শিবগঞ্জ থেকে ফিরে: ‘যখন নামাজ পড়তে বসি মনে হয় ভূমিকম্পে গোটা মসজিদই কাঁপছে। চার রাকাত নামাজে কয়েক দফায় কেঁপে ওঠে শরীর।

প্রচীন মসজিদ; ভয় লাগে কখন না আবার কোথা থেকে কী ভেঙে পড়ে মাথার ওপর! এরপরও আমাদের করার কিছু নেই। মনের মধ্যে ভয়ভীতি চেপে রেখে একমাত্র আল্লাহ’র ওপর ভরসা করেই আমরা নামাজ আদায় করে যাচ্ছি’।

ঐতিহাসিক ছোট সোনামসজিদের হালহকিকত জানতে চাইলে চাপা আতঙ্ক আর ক্ষোভ নিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলেন, প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে অবস্থিত ফিরোজপুর গ্রামের বাসিন্দা মোজাফফর হোসেন।

কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সোনামসজিদের গা ঘেঁষে প্রতি মুহূর্তেই ছুটে চলেছে বাস-ট্রাকসহ অসংখ্য বড় বড় যানবাহন। তাই সময়ে-অসময়ে কেঁপে ‍উড়ছে মসজিদটি।

এ অবস্থায় সুলতানি আমলের স্থাপত্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিম সীমান্তে শিবগঞ্জ থানার ফিরোজপুর মৌজার ছোট সোনামসজিদটির অস্তিত্ব ও ঐতিহ্য রক্ষার দাবি উঠেছে। দ্রুতই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ না নিলে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় জনসাধারণ। ২০০৯ সালে মসজিদটি রক্ষায় বাইপাস সড়ক নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ছয় বছর হতে চললেও এখন পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি!
 
প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী হেরিটেজের সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী বাংলানিউজকে জানান, বড় সোনামসজিদ রয়েছে ভারতের মালদহে। চাঁপাইনবাবঞ্জের পশ্চিমে শিবগঞ্জ থানার ফিরোজপুর মৌজায় স্থাপিত ছোট সোনামসজিদটি সুলতানি আমলের স্থাপত্যগুলোর মধ্যে শিল্প ভাস্কর্যের অন্যতম নিদর্শন। এর গঠনভঙ্গির বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো মসজিদের গম্বুজগুলোর মধ্যস্থলে কেন্দ্রীয় গম্বুজ হিসেবে বাংলাদেশে প্রচলিত চৌচালা বাড়ির চালের মতো পরস্পর তিনটি গম্বুজ সংযোজিত। এছাড়া দুই সারিতে ৩টি করে দুই পাশে রয়েছে আরও ১২টি গোলাকার গম্বুজ। মোট ১৪টি গম্বুজ সোনামসজিদের অপরূপ শোভা ধারণ করেছে।

এ মসজিদের ভেতরটা প্রাচীন গৌড়ের আদিনা মসজিদের অনুরূপ। মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে নারীদের নামাজ পড়ার জন্য একটি স্বতন্ত্র ছাদ রয়েছে। সেখানে যাতায়তের জন্য উত্তর দেওয়ালে একটি সিঁড়িও আছে। সিঁড়ি সংলগ্ন একটি মিনারও রয়েছে আজান দেওয়ার জন্য। ভেতরের ওই ছাদটির একটি প্রস্তরখণ্ড স্থানান্তরিত হয়ে নিকটস্থ হযরত শাহ নেয়ামত উল্লাহর সমাধি প্রাঙ্গণে নীত হয়েছে। সেই সঙ্গে কারুকার্য খচিত মেহরাব রয়েছে মসজিদে।

মাহবুব সিদ্দিকী আরও জানান, মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৮২ ও প্রস্থ ৫২ ফুট, উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট এবং এর চারপাশে অষ্টকোণ বিশিষ্ট সুউচ্চ চারটি বুরুজ আছে। মসজিদটি মূলত ইটের ইমারত হলেও দেওয়ালের বাইরের অংশ পাথর আবৃত। ভেতরের দিকেও দেওয়ালের বেশ অংশ জুড়ে পাথর আবৃত। সামনের দেওয়ালে সমমাপের ৫টি দরজা রয়েছে। এছাড়া মসজিদের গায়ে নানা প্রকার লতাপাতার কারুকার্য তো রয়েছেই।

তিনি জানান, মধ্যবর্তী দরজার চারপাশের কারুকাজ অধিকাংশই পাথরে খোদাই করা। স্থানীয় লোকেরা গৌড়ের বড় সোনামসজিদের সঙ্গে তুলনা করে একে ‘ছোট সোনামসজিদ’ বলে অভিহিত করে থাকেন। কিছু সংখ্যক স্বর্ণশিল্পী এ মসজিদের সাজ-সজ্জার পরিকল্পনা বা নকশা প্রস্তুত করেছিলেন। পরে এ গম্বুজগুলো সোনালী রঙে গিল্ট (সোনায় বাঁধানো) করা হলে এটি সোনামসজিদ নামে পরিচিতি পায়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বঙ্গের গৌরবময় রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান আলা-উদ-দীন হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ) ৮৯৯ থেকে ৯২৫ হিজরির মধ্যে আলীর পুত্র ওয়ালী মুহম্মদ কর্তৃক ১৪ রজব ছোট সোনামসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। যা মসজিদের সামনের কারুকার্য খচিত দরজার ওপরের অংশের একটি পাথরে উৎকীর্ণ আরবী শিলালিপি থেকে অবগত হওয়া যায়।

মসজিদের ভেতরের আয়তন ৭১ ফুট ৯ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ৪০ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রস্থ। তিন সারিতে বিভক্ত। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদের পশ্চিম দেওয়ালের বহুলাংশ ভেঙে পড়ে। ১৯০০ সালে তা ইট দিয়ে মেরামত করা হয়। সোনামসজিদের আঙ্গিনায় শুয়ে আছেন বাংলার সাত বীরের এক বীর, বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।

ছোট সোনামসজিদের পেশ ইমাম মাওলনা মোহাম্মদ হিজবুল্লাহ্ বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমার নামাজ এবং ঈদের প্রধান জামাতও অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক এ মসজিদে। কিন্তু স্থলবন্দর থেকে আসা ২০-২৫ টনের ট্রাকসহ বড় বড় যানবাহন মসজিদের পাশের রাস্তা ছুঁয়ে যাওয়ার সময় তীব্র কম্পন অনুভূত হয়। প্রথম প্রথম সবার ভয় লাগে। কিন্তু মুসল্লিরা কিছু দিন নামাজ পড়লে অভ্যস্ত হয়ে যান।

মাওলনা মোহাম্মদ হিজবুল্লাহ্ বলেন, ঝুঁকির মধ্যে থাকা এ প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এ কারণে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মসজিদ রক্ষায় ২০০৯ সালে বাইপাস সড়ক নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাব করা হলেও তা এখনও চূড়ান্ত রূপ পায়নি।

কালের সাক্ষী ‘সোনামসজিদ’ উল্লেখ করে ঐতিহ্য রক্ষার জন্য হলেও মসজিদটি রক্ষায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ বাইপাস সড়ক নির্মাণের দাবি করেন তিনি।

এদিকে, সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ জানায় মসজিদ থেকে এক হাজার গজ দূরে বাইপাস সড়ক নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে চিঠি দেওয়া হয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের চিঠির প্রেক্ষিতে ৮৭০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি বাইপাস সড়কের প্রকল্প প্রস্তাব সওজ’র ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে যায়।

পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ২৩ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সফরে গিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সোনামসজিদ সড়ক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। পরে প্রস্তাবিত ওই প্রকল্পের ওপর ২০১৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়। পরে সওজ ও পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কমিটি ওই বছরের ২৩ মে সরেজমিনে সড়ক ও এলাকা পরিদর্শন করে। কিন্তু এরপর আর আলোর মুখ দেখেনি প্রস্তাবিত গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি।

তবে প্রশ্ন করা হলে সওজ চাঁপাইনবাবগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনিতি চাকমা বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। সোনামসজিদ স্থলবন্দরের বিষয়টি মাথায় রেখে সাব রিজিওনাল কানেক্টিভিটির অধীনে চার লেনের একটি প্রজেক্ট রয়েছে। এটি রাজশাহী মহানগরীর নওদাপাড়া আম চত্বর থেকে সরাসরি শিবগঞ্জের বালিয়াদীঘি চেকপোস্ট পর্যন্ত ৮৬ কিলোমিটার সড়ক হবে। ওখানে সোনামসজিদকে বাইপাস করা হয়েছে। এতে মসজিদ রক্ষায় বাইপাস সড়ক নির্মাণ অপরিহার্য বলেও জানানো হয়েছে’।

অদূর ভবিষ্যতে প্রকল্পটি পাস হলেই সমস্যা সমাধান হবে বলে জানান তিনি। এতে ঝুঁকিমুক্ত হবে বহু ঐতিহ্যের সোনামসজিদ।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১১ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১৫
এসএস/আইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।